কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহের ঈদুল ফিতরের জামাতের বিশালত্ব যেন সকলেরই চিরচেনা। এবারের ঈদ জামাত যেন অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে এক বিশাল জনসমুদ্রের রূপ নিয়েছে। ঈদের আগের দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলার বহু মুসল্লি শোলাকিয়ার জামাতে নামাজ আদায়ের আকর্ষণে চলে আসতে শুরু করেন। আর আজ ঈদের দিন ভোর বেলা থেকে যেন জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশপাশের অন্যান্য জেলা থেকে জনস্রোত বইতে থাকে ঈদগাহ অভিমুখে। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুসল্লিদের ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করেছেন। পথে পথে অনেকেই ১০-২০ টাকা করে পলিথিনের জায়নামাজ বিক্রি করেছেন। জামাত শুরু হয় সকাল ১০টায়। এর অনেক আগেই ঈদগাহ মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। জামাতে ইমামতি করেন শহরের বড় বাজার জামে মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

এই ঈদগাহের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য অনুসারে তিন দফা গুলি ফুটিয়ে শুরু হয় জামাত। জামাত শুরুর ১৫ মিনিটি আগে তিনটি, ১০ মিনিট আগে দুটি এবং ৫ মিনিট আগে একটি শর্টগানের গুলি ফুটিয়ে জামাত শুরুর সংকেত দেওয়া হয়। প্রথম গুলিটি ছোঁড়েন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী। গুলি ছুঁড়ে জামাতের সংকেত দেওয়ার এই ঐহিত্য বিশ্বের বুকে একমাত্র শোলাকিয়া ঈদগাহের বলে মনে করা হয়। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শহরকে বেশ কিছু তোরণ ও উৎসব পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

এবারের ১৯৮ তম জামাতে মুসল্লিদের যে বিপুল পরিমাণ ঢল নেমেছিল, তাতে মূল মাঠের আশপাশের রাস্তা, পার্শ্ববর্তী নরসুন্দা নদীর বিশাল সেতু, আশপাশের বাসাবাড়ির আঙিনা, পতিত জমিতেও মুসল্লিরা কাতার বেঁধে নামাজ আদায় করেছেন। ঈদগাহের পাশেই পর্দাঘেরা একটি জায়গায় মহিলাদের জন্যও পৃথক জামাতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

২০১৬ সালে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর থেকেই নেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রায় ১১শ’ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি সেনা সদস্য, ৫ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার-ভিডিপির সদস্যরা নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।

পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল ৬৪টি সিসি ক্যামেরা। ছিল বেশ কয়েকটি ক্যামেরাবাহী ড্রোন। মাঠে ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের ৬টি ওয়াচ টাওয়ার। গড়ে তোলা হয়েছিল আর্চওয়েসহ চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মুসল্লিদের তল্লাশি করে মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয়। মাঠের পাশেই মোতায়েন ছিল ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ও মেডিক্যাল ক্যাম্প। পর্যাপ্ত সুপেয় পানি এবং ওজুর সুব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। দূরের মুসল্লিদের আসার জন্য সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে এবং সকাল ৬টায় ভৈরব থেকে দু’টি ঈদ স্পেশাল ট্রেন কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। নামাজ শেষে দু’টি ট্রেন আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।

জামাত শুরুর আগে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী ও ঈদগাহ কমিটির পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রতমত সমবেত মুসল্লিদের স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

জামাত শেষে মোনাজাতে ইমাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বাংলাদেশের উত্তরোত্তর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় যেসব ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, তাদের শহীদি মৃত্যু কবুল করার জন্যও সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ল ক য ঈদগ হ র ম হ ম মদ ঈদগ হ র ব যবস থ র জন য হয় ছ ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

ছোঁয়াচে রোগের হাসপাতালে কেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। এই রোগের সংক্রমণ-ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ৬০ বছর আগে শহর থেকে কিছুটা দূরে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে স্থাপন করা হয় ১০০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। তখন সেখানে জনবসতি ছিল কম, প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল নিরিবিলি। ২৮ দশমিক ২৯ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল এলাকায় ছিল পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, ছিল পুকুর, গাছগাছালি। পরে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি), ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনো (আইএইচটি)। এতে করে  বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আয়তন সংকুচিত হয়েছে, নিরিবিলি পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জনসম্পৃক্ততা বাড়ায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সেবা ও চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার ওপর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় স্থাপিত হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তলাবিশিষ্ট ভবনে স্থানান্তর করার কথা। ২০১৮ সালে হাসপাতালের সমস্ত স্থাপনাসহ খালি জমি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে  হস্তান্তর করা হয়। এতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সেবা ও চিকিৎসা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসম্পৃক্ত স্থানে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যক্ষ্মা রোগীদের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ বাধ্যতামূলক।
এ ব্যাপারে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক তত্ত্বাবধায়ক ডা. এসএম নুরুল করিম বলেন, ‘যক্ষ্মা ছোঁয়াচে রোগ। বর্তমানে যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে এমডিআর ও এক্সডিআরের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। এসব রোগীর যক্ষ্মা সাধারণ ওষুধে ভালো হয় না। হাসপাতালে ভর্তি রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিতে হয়। রোগীদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ দরকার।’
বর্তমানে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অধীনে আছে মাত্র সাত একর জমি। খালি জায়গা আছে ৯ একর।  সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৬০ বছরে বারবার সংকুচিত হয়েছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিধি। ফলে যক্ষ্মা রোগীর যে পরিবেশে চিকিৎসা পাওয়ার কথা সেটা পাবেন না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সাধারণ যক্ষ্মা, এমবিআর যক্ষ্মা, প্রিএক্সডিআর যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জানা যায়, ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জায়গায় চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ১০ তলা ভবন তৈরির কথা রয়েছে। বর্তমানে স্থাপিত তিনতলা ভবনে চলছে মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। 
সরেজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ প্রায় প্রতিদিন রোগীতে ভর্তি থাকে। ভবনের নিচতলায় পুরুষ ও দ্বিতীয় তলায় নারী রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে ৩৫ জন যক্ষ্মা রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য জনবল কর্মরত রয়েছেন। 
যক্ষ্মা রোগীদের কফ পরীক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে রয়েছে জিন এক্সপার্ট নামের কফ পরীক্ষার আধুনিক মেশিন। হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন ও অডিও মেট্রিক মেশিনও রয়েছে। 
২০২৪ সালে ৫৮৯ জন, ২০২৩ সালে ৭২০ জন, ২০২২ সালে ৫৯৫ জন যক্ষ্মা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব রোগী এমডিআর ও এক্সডিআরে আক্রান্ত। তাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের দূর-দূরান্ত থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন।

জানা যায়, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল স্থানান্তর করা হবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ তলা বিশিষ্ট ভবনে। হাসপাতাল স্থানান্তর নিয়ে যক্ষ্মা রোগীর অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ। আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জনসম্পৃক্ত স্থানে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যক্ষা রোগীদের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ বাধ্যতামূলক। তাই যক্ষ্মা রোগী ও তাদের স্বজনদের দাবি করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যেন অন্য কোন স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক এবং ব্যক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. দিদারুল আলম বলেন, ‘যেসব রোগী ছয় মাসেও চিকিৎসায় ভালো হয় না, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। যক্ষ্মা শতভাগ নিরাময়যোগ্য রোগ। এই রোগীদের চিকিৎসা নিরিবিলি ও জনসম্পৃক্ত নয় এমন হাসপাতালে হওয়া দরকার।
এদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসা। প্রায় ৬০ বছর আগে নির্মিত হাসপাতাল ভবন ৭ বছর আগে ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা করে গণপূর্ত বিভাগ। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে চিকিৎসা সেবা। গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটির বিভিন্ন অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লেও নতুন স্থাপনা নির্মাণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে স্থাপনা ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছোঁয়াচে রোগের হাসপাতালে কেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়