দেশের অর্থনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য আমাদের একটা ছোট গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপেরই একজন হুমায়ুন কবীর, যাকে আমরা আন-ট্রেডিশনাল অর্থনীতিবিদ বলি, তিনি অক্টোবর মাসে হুট করে বলে বসলেন, আমাদের সামনের রোজায় তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে। সেই সময়ে দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে, রিজার্ভের ওপর চরম চাপ, মাত্রই রেমিট্যান্স বয়কট থেকে উঠে আসছে দেশ। ফলে আমরা থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
বাস্তবতা হলো তখন আমাদের রেমিট্যান্স মাত্রই ২ দশমিক ৫ বিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা ছুলো। হ্যাঁ! ওই অবস্থা থেকে রেমিট্যান্স বাড়তে পারে যদি সরকার ডলারের মূল্যমান কমিয়ে দেয় আরও, অথবা প্রণোদনা দেয়। সরকার ডলারের মূল্য খুব বেশি বদল করেনি। এখনো হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি। আর আমরা তিন বিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছি (৩১ মার্চের পুরা ডেটা এলে আমরা জানব), আর তার পুরোটাই আমাদের প্রবাসী ভাইবোনদের কৃতিত্ব।
দেশের বাইরে যখন যাই, প্রায় সব জায়গায় আমাদের প্রবাসী ভাইদের পাই। সেটা ইউরোপ হোক বা থাইল্যান্ডের কোনো দোকানে। বাংলায় কথা শুনলেই তাদের কী আকুতি! অনেকে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশও করতে পারে না। চুপ করে তাকিয়ে থাকে।
নেদারল্যান্ডসের বিরিয়ানি খেতে বসে যেমন বিল দিতে গিয়ে শুনি ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট, টেরও পাইনি, এক চাটগাঁইয়া ভাই ছিল সার্ভিংয়ে বা থাইল্যান্ডে আম কেনার পর ফোনে বাংলা বলছি শুনেই আমার থেকে ফল নিয়ে নতুন একঝুড়ি থেকে আম বেছে দিল এক সিলেটি ভাই। আর দামও নিজে থেকেই কমিয়ে নিলেন। এমন অনেক ভালোবাসাই পাই বিদেশে ঘুরতে বা কাজে গেলে।
প্রবাসীদের দেশপ্রেমের সব থেকে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রেমিট্যান্স বয়কট। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সব থেকে কম রেমিট্যান্স এসেছিল গত বছরের জুলাই মাসে। আওয়ামী সরকার এত আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল যে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছিল।
আরব আমিরাতে তো আন্দোলনকারী প্রবাসীদের গ্রেপ্তারও করা হলো। দীর্ঘ সাজার মুখোমুখিও হয়েছিলেন তাঁরা। আওয়ামী লীগ সরকারও সেই প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ায়নি। উল্টো তাঁদের বিষোদ্গার করেছে। পরে তো তাদের পতন হলোই। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর প্রচেষ্টায় কারাগারমুক্ত হলেন আরব আমিরাতের সেই ভাইয়েরা।
নতুন সরকার যখন রিজার্ভ নিয়ে চাপে, বাইরের ঋণও পাওয়া যাচ্ছে না, বিনিয়োগ পরিস্থিতিও স্থবির, তখন আবারও ত্রাতা হয়ে এলেন আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা। এ বছরের বাজেট প্রস্তাবের সময় বিশ্বব্যাংকের একটা পূর্বাভাস ছিল, ২৪ বিলিয়ন হবে এক বছরে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো আর তত্ত্ব মেনে চলেন না। তাঁরা সাময়িক লোভ বাদ দিয়ে দেশের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো শুরু করেন। ফলাফল এই মাইলস্টোন।
গত বছর ঠিক এ সময়েই হতাশার কথা লিখতে বসেছিলাম। এ সরকারের শুরুতেও আশা করতে পারিনি তেমন একটা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দারুণ প্রচেষ্টা এখন আশার সঞ্চার করছে। তাদের এ চেষ্টা আর ফলপ্রসূ হবে, যদি তাঁরা পাচার হওয়ার অর্থ ফেরত আনতে পারে। যদি পারে, তাহলে আসলে আমাদের আর লোনের জন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। সেই সুসময়ের অপেক্ষায় সারা দেশ এখন তাকিয়ে।এখন কথা হচ্ছে, এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা কি আমাদের কাছে প্রাপ্য সম্মান পান? ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রবাসে থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ১৯ হাজার ৩৮৭ জন। এক কোটির ওপর প্রবাসী আছেন, যাঁদের নেই কোনো ভোটের অধিকার। তাঁরা বেশির ভাগ সময়েই আমাদের দূতাবাসগুলো থেকে যথাযথ সেবা ও সুবিধা পান না। নিদারুণ মানবেতর জীবন যাপন করে খেয়ে না–খেয়ে তাঁরা দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।
তাঁদের অনেক টাকায় আবার মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে নেন। যেমন ফ্লাইটের টিকিটের ক্ষেত্রে এত দিন আমরা সেটি দেখেছি। এ ছাড়া ন্যূনতম ট্রেনিং ছাড়া অনেকে চলে যাচ্ছেন, যাঁরা জানেনও না কীভাবে কথা বলতে হবে। এ ছাড়া অবৈধ পথে গিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের লাশও তো আসে না এ দেশে। বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা তো অহরহ হচ্ছে।
একবার এয়ার ইন্ডিয়ার এক ফ্লাইটে মিডল ইস্ট থেকে আসা এক বাংলাদেশি ভাইকে পেয়েছিলাম, যিনি ক্ষুধায় চিৎকার করে কাঁদছিলেন। তাঁর কাছে টাকা ছিল না যে কিছু কিনে খাবেন। যেখানে বাংলাদেশি শুধু ছিলাম এই অধম। সেই যাত্রায় ব্যবস্থা করে দেওয়া গেলেও অন্য সময়? দুবাইয়ে বিমানের টিকিটের বিশাল লাইন হয়।
আগেই পোশাক–আশাক দেখে বা কথাবার্তা শুনে আলাদা করে ফেলা হয় মানুষদের। যাঁরা শ্রমজীবী, তাঁদের জন্য থাকে লম্বা লাইন ও চেকিং। ঢাকা এয়ারপোর্টের খারাপ ব্যবহারের শিকার হতে হয় তো অহরহ। হ্যাঁ, তাঁরা অনেক কিছু জানেন না। কিন্তু কেউ কি তাঁদের শেখানোর বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে?
পাকিস্তানের রেমিট্যান্স ২০২০ সাল পর্যন্তও বাংলাদেশ থেকে কম ছিল। তারা এখন ৩০ বিলিয়ন পার করে ফেলেছে? আমাদের কবে হবে? আগামী মাসে রেমিট্যান্স কম আসবে, সরকার কি প্রস্তুতি নিয়েছে? আমাদের রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে অবশ্যই ‘হোয়াইট কলার’ চাকরির জন্য মানুষ পাঠাতে হবে। এর জন্য করতে হবে শিক্ষা থেকে ট্রেনিং—সবকিছুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
দিতে হবে প্রবাসীদের নিরাপত্তা, সুবিধা। এ খাতে আমাদের ৩৫ বিলিয়ন রেমিট্যান্স আসা অসম্ভব নয়। কিন্তু চেষ্টাটা আসতে হবে সরকার থেকেই। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে, টিকিটের দাম কমিয়েছে, এয়ারপোর্টের অবস্থা আগের থেকে ভালো, বেশ কিছু ট্রেনিংয়ের পরিকল্পনা ও পলিসি বানানোর কাজও চলছে। সামনে হয়তো আরও কিছু পরিবর্তন দেখতে পাব।
এখন আসি আরেকটা সুখবরে। মাস শেষ হওয়ার আগেই দেশের মোট রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) দেশের মোট রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ঋণ আসেনি, অন্য কোথাও থেকে বড় কোনো ঋণও নেই। বড় বড় বিনিয়োগের কথা হচ্ছে, কিন্তু এখনো সেই অর্থে বিনিয়োগ আসেনি। এ অবস্থায়ও কিন্তু আমাদের রিজার্ভের পতন ঠেকানো গেছে। শুধু ঠেকানো নয়, এটা এখন বাড়ছে।
সরকার এলসির পেমেন্ট করে দিচ্ছে, ঋণের সুদ পরিশোধ করছে, শুধু তা–ই নয়, তারা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের যে পেমেন্ট অনেক দিন ধরে বাকি ছিল, তা পরিশোধ করে দিচ্ছে। সেই জন্যই এত রেমিট্যান্স আসার পরও আমাদের রিজার্ভের বৃদ্ধি তুলনামূলক কম। কিন্তু এই পেমেন্টগুলো পরিশোধের ফলে দেশের অর্থনীতি অনেকটা স্থিতিশীল।
গত বছর ঠিক এ সময়েই হতাশার কথা লিখতে বসেছিলাম। এ সরকারের শুরুতেও আশা করতে পারিনি তেমন একটা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দারুণ প্রচেষ্টা এখন আশার সঞ্চার করছে। তাদের এ চেষ্টা আর ফলপ্রসূ হবে, যদি তাঁরা পাচার হওয়ার অর্থ ফেরত আনতে পারে। যদি পারে, তাহলে আসলে আমাদের আর লোনের জন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। সেই সুসময়ের অপেক্ষায় সারা দেশ এখন তাকিয়ে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব স দ র আম দ র র র প রব স র জন য হওয় র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউরোপের শক্তিশালী পরিকল্পনা রয়েছে
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ‘প্রয়োজনে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে ইউরোপের ‘একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা’ রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে, ট্রাম্প ২এপ্রিলকে আমেরিকার ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে প্রচার করে আসছেন। ওই দিন তার প্রশাসনের উগ্র অর্থনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি বড় ধরনের শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং গাড়ি আমদানির উপর আগ্রাসী মাত্রায় শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে।
উরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাহী প্রধান উরসুলা ভন ডের লেইন বলেছেন, “ইউরোপ এই সংঘাত শুরু করেনি। আমরা অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে চাই না, তবে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করব।”
সোমবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জানিয়েছিলেন, ট্রাম্প বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তার শুল্ক পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন। তিনি কী ঘোষণা করবেন সে সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত তথ্য দেননি।
ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি ভন ডের লেইন জানিয়েছেন, ইউরোপ ‘আলোচনার জন্য উন্মুক্ত।’
তিনি বলেছেন, “আমরা এই আলোচনাগুলোকে শক্তিশালী অবস্থান থেকে এগিয়ে নেব। ইউরোপের কাছে বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রযুক্তি, আমাদের বাজারের আকার পর্যন্ত অনেক তাস রয়েছে। কিন্তু এই শক্তি আমাদের প্রস্তুতির উপরও নির্ভর করছে। সব উপকরণ টেবিলে রয়েছে।”
ইইউ কীভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে সে সম্পর্কে ভন ডের লেইন অবশ্য বিস্তারিত জানাননি, তবে গত মাসে ব্লকটির আলোচনায় ট্রাম্পের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় ২৬ বিলিয়ন ইউরো (২৮ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের আমেরিকান পণ্যের উপর পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। এসব পণ্যের মধ্যে মধ্যে নৌকা, বোর্বন এবং মোটরবাইক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ঢাকা/শাহেদ