বাউফলের পাঁচটি এটিএম বুথের একটিতেও টাকা নেই, ঈদের আগে বিপাকে গ্রাহকেরা
Published: 30th, March 2025 GMT
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বেসরকারি চারটি ব্যাংকের পাঁচটি এটিএম বুথ (অটোমেটেড টেলার মেশিন) রয়েছে। কিন্তু বুথগুলোতে টাকা না থাকায় আজ রোববার পাঁচটি বুথের কোনোটি থেকেই টাকা তুলতে পারছেন না গ্রাহকেরা। এতে বিপাকে পড়েছেন ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজ এলাকায় আসা ঘরমুখী গ্রাহকেরা।
যদিও ঈদ উপলক্ষে দেশে টানা ৯ দিন ছুটিতে গ্রাহকদের নির্বিঘ্ন লেনদেনের সুবিধার্থে ব্যাংকের অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথে পর্যাপ্ত টাকা রাখার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সোমবার (২৪ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঈদে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস), কিউআর কোড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া এটিএম বুথে সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করা ও এটিএম বুথে কোনো ধরনের কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে দ্রুত তা সমাধান করা এবং পর্যাপ্ত টাকার সরবরাহ নিশ্চিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি বুথে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বুথ পরিদর্শন করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাউফল উপজেলায় চারটি ব্যাংকের পাঁচটি এটিএম বুথ রয়েছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুটি এবং ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের একটি করে বুথ রয়েছে।
আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কালাইয়া বন্দর শাখার মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এটিএম বুথ বন্ধ। শার্টারে দেওয়া নোটিশে লেখা রয়েছে, ‘আউট অব সার্ভিস’। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার ওই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ঈদের ছুটিতে এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা রাখার নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকেরএদিকে সরেজমিনে উপজেলা সদরের ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতে দেখা গেছে, নিরাপত্তাকর্মী আছেন। কিন্তু টাকার লেনদেন বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে কালিশুরী বন্দর শাখা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এটিএম বুথও।
উপজেলার ফজলুল হক ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, গত বৃহস্পতিবার বেতনের টাকা ব্যাংকের হিসাব নম্বরে ঢুকেছে। নানা ব্যস্ততার কারণে ওই দিন টাকা উত্তোলন করতে পারেননি। ভেবেছিলেন, এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করবেন। আজ টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে জানতে পারেন, কোনো বুথেই টাকা নেই। অভিন্ন কথা বলেন কালিশুরী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো.
পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা থেকে ঈদ করতে বাউফলে এসেছেন মো. হুমায়ন কবির নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসার পথে ছিনতাইয়ের ভয়ে সঙ্গে করে নগদ টাকা নিয়ে আসিনি। চিন্তায় ছিল, এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করে খরচ করব। কিন্তু এটিএম বুথে টাকা না থাকায় বিপাকে পড়েছি।’
বুথে টাকা না থাকার সত্যতা নিশ্চিত করে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কালাইয়া বন্দর শাখার ব্যবস্থাপক মো. আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক না খোলা পর্যন্ত (আগামী রোববার) বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে দুঃখ প্রকাশ করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হক ইসল ম ব উফল উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ভেড়াডহর গ্রামে উরিগানের আসরে
এক পক্ষে প্রায় ৫০০ মানুষ। আরেক পক্ষে অন্তত ৭০০। চলছে পাল্টাপাল্টি গানের লড়াই। তা দেখতে জড়ো হয়েছেন আরও হাজারো নারী-পুরুষ। মধ্যচৈত্রের চামড়াপোড়া গরমে শিল্পী-দর্শনার্থী সবাই দরদর করে ঘামছেন। কিন্তু বিরামহীনভাবে দুই পক্ষই পাল্লা দিয়ে গান গাইছে। কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে ‘বিনা যুদ্ধে’ ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ ছাড় দিতে নারাজ!
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন গানের লড়াই চলে সুনামগঞ্জের হাওর-অধ্যুষিত শাল্লা উপজেলার ভেড়াডহর গ্রামের নতুন হাটিতে। সেদিন ছিল ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র। খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে ২৮ মার্চ ২০২৫। খুব সকালে সিলেট থেকে রওনা দিই। সঙ্গী ছিলেন বন্ধু প্রদীপ রঞ্জন বৈষ্ণব ও সংবাদকর্মী দীপ্ত বৈষ্ণব। প্রদীপের গ্রামের বাড়ি মুছাপুর। তাদের গ্রামের পাশেই ভেড়াডহর। মূলত প্রদীপের আমন্ত্রণেই সেখানে উরিগান দেখতে যাওয়া।
হিন্দুধর্মীয় উৎসব দোলযাত্রাকে উপলক্ষ করে বসন্তকালে গাওয়া হয় উরিগান। এসব গান ‘হোরিগান’ বা ‘দোলের গান’ নামেও পরিচিত। বিশেষত সুনামগঞ্জের শাল্লা, দিরাই ও জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন আর নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলায় উরিগানের প্রচলন বেশি। এর বাইরেও হাওরাঞ্চলের নানা গ্রামে দোল উৎসবে উরিগান গাওয়া হয়। তবে বৈষ্ণব ও কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে এ গানের চর্চা তুলনামূলকভাবে বেশি।
কবিগান কিংবা মালজোড়া গানের মতোই উরিগান হলো প্রতিযোগিতামূলক গান। পার্থক্য কেবল এটাই, কবিগান ও মালজোড়াগানের আসর বসে গ্রামীণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য, অন্যদিকে উরিগান পরিবেশিত হয় অনেকটা হিন্দুধর্মীয় আচার-রীতির অংশ হিসেবে। অবশ্য আরেকটু পার্থক্য রয়েছে, কবিগান ও মালজোড়া গানে মাত্র দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী পাল্টাপাল্টি গান-কথায় বাহাস জমান, বিপরীতে উরিগানে একেকটি পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কমসে কম কয়েক শ শিল্পী থাকেন! এমন বর্ণিল আর প্রাণবন্ত গানের ধারা সংগীত-সংস্কৃতিতে কমই আছে।
উরিগানকে সংগীতের একটি পরিচ্ছন্ন ধারা বলে মনে করা হয়ে থাকে। এ গানের চারটা পর্ব রয়েছে—ঝুমুরগান, লাসগান, চাইলগান ও চলতিগান। এসব মূলত নারীবর্জিত গানের ধারা। পুরুষেরাই নৃত্যসংবলিত এ গানের শিল্পী। বাড়ির উঠানে কিংবা মাঠে সমবেতভাবে কয়েক শ শিল্পী একই সঙ্গে এ গান পরিবেশন করেন। এক পক্ষের পরিবেশনার পর অপর পক্ষ একই আঙ্গিকের পাল্টা গান পরিবেশন করেন। এভাবেই দিনভর গান শেষে উপস্থিত দর্শনার্থীদের বেশির ভাগের মতামতের ভিত্তিতে একটি পক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নারীরা উরিগানে অংশ না নিলেও শ্রোতা হিসেবে তাঁদের অংশগ্রহণ ঠিকই থাকে।
২.
ভেড়াডহর গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য গ্রামটিতে পৌঁছার আগেই প্রদীপের সুবাদে প্রাথমিক অনেক তথ্য জানা হয়ে যায়। যেমন ভেড়াডহর গ্রামবাসীর আমন্ত্রণে পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুর গ্রামের বাসিন্দারা উরিগান গাইতে ভেড়াডহরে এসেছেন। রীতি অনুযায়ী এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে উরিগান গাইতে আমন্ত্রণ জানান। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট ওই গ্রামের পুরুষদের প্রায় সবাই সাতসকালে গাইতে আসেন।
পরম্পরা অনুযায়ী কবিরপুর গ্রামের মানুষেরাও সেদিন সাতসকালে ঝুমুরগান গাইতে গাইতে নিজেদের গ্রাম থেকে ভেড়াডহর গ্রামে প্রবেশ করেন। ভেড়াডহর গ্রামে ঢুকে ঝুমুরগান গেয়ে তাঁরা মূলত নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। দুপুরে পৌঁছার কারণে সে আনুষ্ঠানিকতা আমাদের দেখা হয়নি, তবে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানুষের আলাপ থেকে তা ঠিকই জেনে যাই। আমরা যখন গ্রামটিতে পা রাখি, ততক্ষণে লাসগানের পরিবেশনা শুরু হয়েছে।
হিন্দি-বাংলামিশ্রিত লাসগান মগ্ন হয়ে গাইছেন কবিরপুর গ্রামের শিল্পীরা। লাসগান শেষ করেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে কয়েক শ মানুষ সমবেত কণ্ঠে চাইলগান পরিবেশন করেন। চাইলগানে নৃত্যসংবলিত শারীরিক কসরতের পাশাপাশি শিল্পীরা দুই হাত ওপরে তুলে হর্ষধ্বনিসহযোগে লাফানোর মতো করে অনবদ্য এক দৃশ্যের জন্ম দেন। তাঁদের পরিবেশনার পর একই রকমভাবে ভেড়াডহরের গ্রামবাসীও গানে গানে কবিরপুরবাসীকে পাল্টা জবাব দেন।
শিল্পীরা জানান, ভেড়াডহরের লোকেরা উরিগানের আয়োজক হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁরা রাইপক্ষ, আর কবিরপুরের মানুষ আমন্ত্রিত দল হওয়ায় তাঁরা শ্যামপক্ষ। সে ধারা মোতাবেকই গান পরিবেশিত হয়।
উরিগান উপলক্ষে এভাবেই সাজানো হয়েছিল দোলবেদি