ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমার, তবু থামেনি জান্তা বাহিনীর বিমান হামলা
Published: 30th, March 2025 GMT
দুদিন আগে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে ১ হাজার ৬০০–এর বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেশজুড়ে ভূমিকম্পের ধ্বংসচিত্র ছড়িয়ে আছে। ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও দেশের যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির জান্তা সরকার।
জাতিসংঘ একে সম্পূর্ণরূপে ‘জঘন্য এবং অগ্রহণযোগ্য’ বলে বর্ণনা করেছে।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুস বলেছেন, ভূমিকম্পের পর যখন মানুষ উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তখনো সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে—এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।
টম অ্যান্ড্রুস মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে এখনই সব ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ করতে বলেছেন।
প্রায় চার বছর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা পুনর্দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী।
গত শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে মিয়ানমার। ভূমিকম্প আঘাত হানার তিন ঘণ্টার কম সময়ে স্থানীয় সময় শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উত্তরের রাজ্য শানের নাউংচোতে বিমান হামলা চালায় জান্তা বাহিনী। হামলায় সাতজন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে বিবিসি বার্মিজ।
এ ছাড়া দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো উত্তর-পশ্চিমের সাগাইং অঞ্চলের চ্যাং-ইউ শহরে বিমান হামলার খবর দিয়েছে। সাগাইং ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল। জান্তা বাহিনীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো লড়াই করে যাচ্ছে।
থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছের অঞ্চলগুলোতেও বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের উৎখাত হওয়া বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করছে দ্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, তাদের সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে দুই সপ্তাহের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখবে। আজ রোববার থেকে তা শুরু হবে। তবে আক্রান্ত হলে তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
জান্তা সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের পর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আরও বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুনমিয়ানমারে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়াল১৪ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র র খবর
এছাড়াও পড়ুন:
‘মা, বিছানা রেডি করো, আমি ঘুমাব’, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে আরাফাতের ফোন
ঈদের আগে কয়েক দিন বেচাবিক্রির ব্যস্ততায় একদম ঘুমাতে পারেননি কসমেটিকস দোকানের বিক্রয়কর্মী আরাফাত হোসেন। ভোরে গাড়িতে উঠে মাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, `মা, বিছানা রেড়ি করো। বাড়িতে এসে ঈদের নামাজ পড়ে ঘুমাব।’ কথামতো মা বিছানা তৈরি করে রেখেছিলেন। কিন্তু চির ঘুমে আচ্ছন্ন আরাফাতকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এল বাড়ির উঠানে। মায়ের যত্ন করে গুছিয়ে দেওয়া বিছানায় নয়, আরাফাতকে শোয়ানো হলো মাটির বিছানায়।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নে বান্দরবান জেলার সীমান্তে বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলি মাঠ ও পাহাড়ি এলাকার মাঝখানে আধার মানিক গ্রামের অবস্থান। গ্রামের হাঙ্গর খালের কুল ঘেঁষে সেনের চর এলাকায় গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে আরাফাতের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায়।
আরাফাতের বাবা ওই এলাকার কৃষক আব্দুল মোতালেব(৫০) ওরফে সোনা মিয়ার বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স থামতেই কয়েক শ মানুষ ছুটে আসেন। তাদের কয়েকজন আরাফাতের লাশ কাঁধে তুলে নিয়ে সরু মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে হেঁটে চললেন। ৩ মিনিট পর মাটির তৈরি আরাফাতদের বাড়ির উঠানে লাশ পৌঁছাতেই নারীদের কান্নায় আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ঘুমানোর কথা বলে এভাবেই চির দিনের জন্য আরাফাত ঘুমিয়ে পড়বে তা কে জানত?
গতকাল সকাল সোয়া ৭টার দিকে আরাফাত হোসেন (২১) ও রিফাত হোসেন (১৮) নামের লোহাগাড়ার আধার মানিক গ্রামের দুই তরুণসহ সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলা অংশের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও মিনিবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ৫ তরুণ নিহত হন। আহত হন আরও ৯ জন। নিহত তরুণদের মধ্যে আরাফাতসহ ৪ জন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা এবং ১ জন পাশের সাতকানিয়া উপজেলার।
নিহত তরুণদের সবাই একে অপরের বন্ধু ও পরিচিতজন। তাঁরা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজার এলাকায় বিপণিবিতান ও কসমেটিকসের দোকানে চাকরি করতেন। গ্রামে অপেক্ষারত প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়িতে ফিরছিলেন তাঁরা।
পুলিশ জানায়, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা থেকে চট্টগ্রামগামী একটি মিনিবাসের সঙ্গে কক্সবাজারগামী সৌদিয়া পরিবহনের একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়। এতে গাড়ি দুটির সামনের অংশ দুমড়ে–মুচড়ে যায়। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় লোহাগাড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন।
আরাফাত ও রিফাত ছাড়া নিহত বাকি তিনজন হলেন লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের বাগমুয়া সগিরা পাড়া এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে নাজিম উদ্দিন (২৮), একই উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সুখছড়ি খলিফার পাড়া এলাকার আমির হোসেনের ছেলে জিসান হোসেন (১৯) এবং সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের ডেলিপাড়া এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক আহমদ (১৮)।
গ্রামের দুই তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় আধার মানিক গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। ছিল না ঈদের আনন্দ। গতকাল সকাল ৮টার দিকে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গ্রামের বাসিন্দারা। ৯টায় ওই গ্রামের প্রধান মসজিদে ঈদের নামাজ হওয়ার কথা ছিল। পুরুষরা ততক্ষণে সব প্রস্তুতি সেরে মসজিদে জড়ো হয়েছেন। নারীরাও রান্নার কাজ সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অতিথি অ্যাপায়নের।
কিন্তু সকাল ৮টায় মুঠোফোনে আসা এক দুর্ঘটনার সংবাদে স্তব্ধ হয়ে যায় আধার মানিক গ্রাম। মুহূর্তেই গ্রামের মানুষের ঈদ আনন্দ পরিণত হয় বিষাদে। থেমে যায় পুরো গ্রামের ঈদ উৎসব।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে গ্রামের হাঙ্গর খালের কুল ঘেঁষে সেনের চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
আরাফাতের নিথর দেহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে আনা হয় বাড়ির উঠানে। ছেলের লাশ দেখেই আরাফাতের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা খুরশিদা বেগম অজ্ঞান হয়ে যান। উঠানের এককোণে বসে বিলাপ করছিলেন আরাফাতের বাবা আবদুল মোতালেব।
প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে আরাফাত সবার ছোট। উখিয়ার কোর্ট বাজারে ৭ হাজার টাকা বেতনে একটি কসমেটিকসের দোকানে চাকরি করত সে। এ বছর আমি তরমুজ চাষ করেছিলাম। আরাফাত তরমুজ খেতে ভালোবাসত। সব তরমুজ বিক্রির পর একটি বড় তরমুজ রেখে দিয়েছিলাম তার জন্য।’
আবদুল মোতালেব আরও বলেন,‘ ঈদের আগে কয়েক দিন বেচাবিক্রির ব্যস্ততায় একদম ঘুমাতে পারেনি আরাফাত। ভোরে বাসে উঠে মাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, ``মা, বিছানা রেডি করো। বাড়িতে এসে ঈদের নামাজ পড়ে ঘুমাব।" মায়ের পাতানো বিছানায় ঘুমাতে না পারলেও এখন চির ঘুমে আরাফাত।’
আরাফাতের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে নূর জাহান বিবির পাড়া এলাকায় নিহত আরেক তরুণ রিফাত হোসেনের (১৮) বাড়ি। রিফাতের বাবা বদিউল আলম গরুর ব্যবসা করেন। পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল। ৪ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রিফাত স্থানীয় আধার মানিক পিডিসি উচ্চবিদ্যালয়ের এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাটি ও টিনের তৈরি রিফাতদের ছোট ঘরে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় রাখা হয়েছে রিফাতের লাশ। পাশে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন মা নুরুন্নাহার বেগম। প্রতিবেশী স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
কথা হয় রিফাতের বড় বোন জোবাইদা আক্তারের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রমজানে স্কুল ছুটি থাকায় এক মাসের জন্য চাচাতো ভাইয়ের কাপড়ের দোকানে কাজ করতে গিয়েছিল রিফাত। পরিবারের সব সদস্যের জন্য কাপড় কিনে বাড়ি ফিরছিল সে। দুর্ঘটনার ১৫ মিনিট আগেও বোনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। বলেছিল, ``আপু আর বেশি দূরে নয়, একটু পরই দেখা হবে।'''
শোকের মাতম চলছে নিহত অন্য তিন তরুণের এলাকায়ও। তাঁরা সবাই দোকানের কর্মচারী এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের দিন ফাঁকা মহাসড়কে বাস দুটির বেপরোয়া গতি ছিল। তা ছাড়া বিপজ্জনক বাঁকের কারণেও দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি জব্দ করে এবং লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।