গাজা এখন ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এক নগরী। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও ফিলিস্তিনি জনগণ ঈদ পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পবিত্র রমজান মাস ফিলিস্তিনিদের কেটেছে দুঃসহ কষ্টে। ১ মার্চ ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রথম দফার যুদ্ধবিরতি শেষ হয়। এর পর থেকে গাজায় আবার হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। রোজার মধ্যেও খাবার নেই, মাথা গোঁজায় ঠাঁই নেই তাঁদের। কষ্টে, অনাহারে কাটছে মানুষের জীবন।
হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে এ মাসের শুরু থেকে গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে দেয়নি ইসরায়েল। ফলে আবার গাজা ছেড়ে পালাতে হয়েছে অনেক পরিবারকে। এই অনাহার ও কষ্টের মধ্যেও ঈদ পালন করতে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। রোজার মাস শেষ হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে আজ ঈদ উদ্যাপিত হবে। কিন্তু ঈদ যেন গাজাবাসীর জন্য নয়। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ‘তাঁদের উদ্যাপনের কিছুই নেই’।
১৮ মার্চ ইসরায়েল গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করেছে। এতে গত ১১ দিনে ৮৯০ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যে ইসরায়েলি হামলায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। নিহতদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। এ ছাড়া কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজা উপত্যকায় কোনো খাবার বা ত্রাণ প্রবেশ করতে পারেনি। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত অস্থিতিশীল।
ইসরায়েলি হামলার মধ্যে গাজাবাসীর জন্য এটা হবে দ্বিতীয় ঈদ। প্রথম ঈদের সময় ইসরায়েলি ভয়াবহ হামলার রেশ এবারও তাঁদের টানতে হচ্ছে। কিন্তু এবার আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাঁরা। ভেবেছিলেন যুদ্ধবিরতি হবে। ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে হামলা কিছুটা কমেছিল। তবে ১৮ মার্চ থেকে গাজায় আকস্মিক হামলা চালিয়ে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফেলে ইসরায়েল। তাদের হামলায় কয়েক শ মানুষ মারা যান। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ হামলার নির্দেশ দেন।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এ সময় হামাসের হাতে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে চাপ দেওয়া হয়। হামাসের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়নের দাবি করা হয়। এতে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও একযোগে সব জিম্মিকে মুক্তির কথা বলে হামাস। ইসরায়েলি প্রস্তাবে হামাস রাজি না হওয়ায় গাজায় ত্রাণসহায়তা বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল।
একটি নাজুক যুদ্ধবিরতির মধ্যে রোজা পালন শুরু করেছিলেন গাজাবাসী। তাঁদের আশা ছিল স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে যাবে হামাস ও ইসরায়েল। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ায় ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য আবার বদলে গেল।
অ্যাম্বুলেন্সে হামলা
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী শনিবার স্বীকার করেছে, গাজার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে তারা সন্দেহজনক যান হিসেবে চিহ্নিত করে এগুলোতে গুলি চালিয়েছে। হামাস একে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে হামলায় অন্তত একজন নিহত হয়েছেন। গত রোববার রাফার তাল আল-সুলতানে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা ছাড়াও গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ২৭৭।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত হানছে। ট্রাম্প ‘প্রথম দিনেই’ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কোনো শান্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কবে স্বীকার করবে যে তারা ব্যর্থ হচ্ছে?
শুরুতে ট্রাম্পের দাবি ছিল খুব সহজ, ‘যুদ্ধ থামাও, আলোচনায় বসো।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রথম ফোনালাপের পর তিনি বলেছিলেন, খুব দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা হলো পুতিন ও তাঁর ক্রেমলিনের ছোট একটি দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে এমন এক জটিল ও অসম্ভব শর্তের গোলকধাঁধায় ফেলেছেন, যেখান থেকে বেরোনো কঠিন। এত দিন ধরে এই নাটক চলার পর এমনকি সবচেয়ে বোকা আলোচকেরও বোঝার কথা, পুতিনের যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনা বা সময়সূচিও মানবেন না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন যখন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি মূলত রুশ সামরিক শক্তির ওপর ভরসা করেছিলেন, যাতে তিনি ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। প্রথমে তাঁর সেনাবাহিনীতে প্রায় দুই লাখ ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন। এরপর তিনি কয়েক দফা আংশিক মোতায়েন এবং বিশাল আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে তা প্রায় ছয় লাখে নিয়ে যান।
এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সাত–আট লাখ সেনা হতাহত হয়েছেন, যার মধ্যে দুই লাখের বেশি নিহত হয়েছেন। এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরও কথিত শক্তিশালী রুশ সেনাবাহিনী এখন ইউক্রেনের আগের চেয়ে কম ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মাত্র ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভূখণ্ড রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সামরিকভাবে পুতিনের যুদ্ধকে এক ভয়াবহ ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। হয়তো তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কোনো না কোনো বড় সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর সম্ভাবনা খুবই কম।
রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনের তুলনায় যুদ্ধে বেশি সংখ্যায় সেনা পাঠাতে পারবে, বেশি বোমাও ফেলতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে থাকা সেনাদের মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, আত্মরক্ষা যত সহজ, আক্রমণ করা ঠিক ততটাই কঠিন। এর মানে দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত পুতিন কোনো ধরনের বিজয়ের ছবি তুলে ধরতে চাইলে তাঁকে রুশ সেনাবাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি ভরসা করতে হবে।
তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।এ কারণে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার জন্য পুতিন তাঁর হাতে থাকা সব কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। সবাই জানে, ট্রাম্প প্রশংসায় দুর্বল হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ নিয়েই পুতিন বাড়াবাড়ি রকমের চাটুকারিতা করছেন। তিনি দাবি করেছেন, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘চুরি’ হয়েছিল এবং যদি ট্রাম্প তখন ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ কখনোই হতো না।
এমনকি পুতিন বলেছেন, ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ওপর হামলার পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রার্থনাকক্ষে গিয়ে ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি ক্রেমলিনের দরবারি শিল্পীকে দিয়ে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে তা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।
শুধু প্রশংসা নয়, পুতিন ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফকে ব্যবসার প্রলোভনও দেখাচ্ছেন। রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রথম আলোচনায় পুতিনের দল একটি বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনার তালিকা নিয়ে আসে, যেগুলো নাকি বাস্তবায়ন করা হবে যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে ছেড়ে দেন এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
উইটকফ জানিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠকের একটি বড় অংশ এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পকে রুখতে চীন-ইউরোপ কি হাত মেলাবে১৯ এপ্রিল ২০২৫দুই ধরনের কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন জানেন, কীভাবে কাজ করতে হয় এবং তিনি জানেন, কার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এমন কিছুতে রাজি হবেন, তার কোনো লক্ষণও নেই। তিনি নির্দ্বিধায় ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই তথাকথিত আলোচনায় ক্রেমলিন মূলত দুটি দাবি তুলেছে। প্রথম দাবি হলো, ইউক্রেন যেন লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন—এই চারটি অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। উইটকফ এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একপ্রকার রাজিও হয়ে গেছেন: যুক্তরাষ্ট্র নাকি রাশিয়ার দখল করা এই চার অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার মালিকানা মেনে নিতে প্রস্তুত।
কিন্তু রাশিয়া এখনো এ চার অঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে (যেখানে যুদ্ধের আগে এক মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল) এখনো ইউক্রেনীয় পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার এসব শহর হেলায় ছেড়ে দিলে টিকে থাকতে পারবে না। হয়তো ইউক্রেন বর্তমান যুদ্ধরেখাকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘জমে থাকা’ সংঘাত মেনে নিতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি নয়।
রাশিয়ার দ্বিতীয় দাবি হলো, ইউক্রেনের ওপর নিরাপত্তাগত কর্তৃত্ব বজায় রাখা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি বা সহায়তা যেন না থাকে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্য পদ প্রশ্নে হার মানিয়েছেন এবং তিনি সম্ভবত পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিতে যাচ্ছেন।
কিন্তু এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা শুরু হয়। পুতিন ও ট্রাম্প—দুজনেই ইউরোপীয়দের আলোচনার টেবিলে আনতে চাননি। কিন্তু এটাই ভালো হয়েছে। ইউরোপীয়রা যদি ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন, তাহলে পুতিন ও ট্রাম্প যা-ই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত হোন না কেন, তা বাস্তব মাটিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এ অবস্থায় ইউরোপের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় তাস। যদি তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে, তাহলে ইউক্রেনকে ‘মিউনিখ চুক্তি’র মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া উচিত, যেভাবেই হোক তাঁরা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখবেন।
তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।
● কার্ল বিল্ডট সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ