পুনর্বাসনে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে
Published: 29th, March 2025 GMT
রাত সাড়ে ৩টা বাজে। বাবি ভাত খাবে। ফ্রিজে শুধু ভাত আর করলা ভাজি। মাছ-মাংস কিছু নেই। খেতে বসে মুখের ভাত ছুড়ে মারল আমার গায়ে, হাতে কামড় বসিয়ে দিল। তারপর বাবি খাও, খাও বলে আদর করে একটুখানি খাওয়ালাম। কারণ পেট খালি থাকলে সে একটুও ঘুমাবে না। পরে পরিষ্কার করে নিলাম। আমার ছেলে বাবির কথা বলছি। ওর অটিজম আছে। ১৫ বছরের বাবি নিজের রুটিনের বাইরে গেলেই বিরক্ত হয়। দিন-মাস-বছর পেরিয়ে যায়, রুটিনে অভ্যস্ত করে বাবিদের জীবন সহজ হয়ে এলেও বাবা-মায়ের যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না।
আজকাল দেখলেই বুঝতে পারি, কার অটিজম আছে, কী করতে হবে! কেউ কেউ ফোন করেও জানতে চায়। আবার কেউ বলে– না, না, ওর কোনো সমস্যা নেই। ও কেবল কথা বলে না। একটা বল নিয়ে সারাদিন থাকে। নিজে নিজে কথা বলে আর ইলেকট্রিক সুইচ অফ-অন করে। আগে একটু বোঝাতে চেষ্টা করতাম। এখন বলি, তেমন সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে। মনে মনে বলি, বয়স যত বাড়বে সমস্যা তত বহুমুখী হবে। সেটি কত ধরনের আপনি ধারণাও করতে পারবেন না।
অনেক বাবা-মা হয়তো বিরক্ত হন। তবুও দেখলে বলি, ওর টয়লেট ট্রেনিং আছে তো? এখনই করান, একটু বড় হলেই আর পারবেন না। না, না, ঠিক আছে, ও পারে! বাহ্, খুব ভালো। এক বাবা ফোন করে বললেন, একজন স্পিচ থেরাপিস্টের নাম্বার দিতে পারেন? ছয় মাস করালে কথা বলবে না? আমি বললাম, বলতে পারে। তবে আপনি সময় নষ্ট করবেন না। স্পেশাল স্কুলে দেন। মূলধারায় ও টিকতে পারবে না। বাবা ফোন কেটে দিলেন। আমিও বাবিকে মূলধারার স্কুলে রেখেছিলাম অনেক বছর, গাইড টিচার দিয়ে। লাভ কিছু হয়নি। আমাকে ফিরতে হয়েছে, অমোঘ গন্তব্যে, স্পেশাল স্কুলে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, অটিজমের কারণ জিনগত বা পরিবেশগত হতে পারে। যে কারণেই হোক, অটিজম সারাজীবনের সমস্যা। একে সারাজীবন ধরে লালন করতে হয়। তবে শুরুতে শনাক্ত করতে পারলে বাবা-মা এটিকে স্বীকার করে নিয়ে দ্রুত কাজ করতে পারলে সমস্যাগুলো কমিয়ে রাখা যায় বা উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা যায়।
অটিজমের ক্ষেত্রে বাবা-মা মানতে চান না। এত ফুটফুটে বাচ্চা; কেবল কথা বলছে না, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। ওর বাবাও দেরিতে কথা বলেছে। এগুলো ধরে বসে না থেকে একটু অন্যরকম বুঝতে পারলে কাজ শুরু করতে হবে। কী করবেন তারা? রাজধানী ঢাকা ছাড়া অন্য শহরগুলোতে এই সেবা তেমন নেই। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে বিনা পয়সায় এই বিশেষায়িত সেবা দেওয়া হয়। বেশির ভাগ বাবা-মা এটি জানেন না। তাই বুঝে উঠতে পারেন না কোথায় যাবেন। ফলে দেরি হয়ে যায় সমস্যাগুলো ধরে কাজ করতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত বাবা-মা এই সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, বুঝতে পারেন না।
সরকারিভাবে শিক্ষাকে ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বলা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে এ ধরনের শিশুকে ভর্তি নিলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাবে তারা সেখানে টিকে থাকতে পারে না। স্কুলের অন্যান্য শিশু এমনকি অভিভাবকরাও এ ধরনের বাচ্চার ব্যাপারে অসহিষ্ণু। তারা চান না তাদের সন্তান একটা বিশেষ শিশুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে লেখাপড়া করুক।
শহরে সম্পন্ন পরিবারের অটিজমের শিশুরা স্পেশাল স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। এগুলো ব্যয়বহুল। সাধারণ বাবা-মায়ের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। সরকারিভাবে বিশেষায়িত স্কুল ও এসব শিশুর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারলে জনসংখ্যার একটি বিশেষ অংশ ঘরে বসে থাকবে নয়তো রাস্তায় বসে থাকবে। প্রতিমুহূর্তে অটিজম আক্রান্ত বাবা-মায়ের যে কথাগুলো বুকের পাঁজর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়, সেটি হচ্ছে– বাবা-মা যখন না থাকবে তখন এই বাচ্চার কী হবে! এর উত্তর বাবা-মায়েরা এখনও খুঁজছেন। রাষ্ট্র ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই রাষ্ট্রে সুস্থ-সবল, বুদ্ধিমান মানুষও যেমন নাগরিক; তেমনি এই কম বোঝা, না-পারা মানুষগুলোও তাদের সহ-নাগরিক।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদের ছুটিতে কি ফোনেই সময় কাটাচ্ছেন
ছবি: পেক্সেলস