নতুন করে বোমা বর্ষণে স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে। গাজাবাসী নিরন্তর বাস্তুচ্যুতি ও ক্ষুধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। পাঁচ সন্তানের মা উরুদ আসফুর অষ্টমবারের মতো বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তিনি জানান, অন্য গাজাবাসীর মতো তাদেরও ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েল। 
গাজার খান ইউনিসের কাছে লোকজনে ঠাসা ইউএনআরডব্লিউএ’র একটি স্কুলে অস্থায়ী তাঁবুতে বসে আছেন ২৬ বছর বয়সী পাঁচ সন্তানের জননী উরুদ আসফুর। তিনি কিছুটা হলেও ঘরের মতো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলের অবিরাম ১৫ মাসের অবরোধে স্কুলটি আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। তবে ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় এখানে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল। এখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির নির্দেশে আশ্রয়কেন্দ্রটি আবারও ভরে উঠেছে। খান ইউনিসের পূর্বাংশ ও উত্তর বেইত হানুন থেকে আতঙ্কিত পরিবারগুলো এখানে আশ্রয় নিচ্ছে।  
যা তারা শেষ বাস্তুচ্যুতির সময় বাঁচিয়ে এনেছিলেন, তা দিয়ে উরুদ আসফুরের স্বামী আহমেদ তাদের পুরোনো তাঁবু দ্রুত সাজাচ্ছেন। ইসরায়েলি হামলায় তাদের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে অনেক আগে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর তারা অষ্টমবারের মতো বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির সময় তারা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন। ইসরায়েলের পুনরায় বোমাবর্ষণ সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।
দুই কন্যা– তিন বছরের সানা ও দুই বছরের আমিরাকে জড়িয়ে ধরে উরুদ আসফুর বলেন, ‘আমি ঈদে আমার বাচ্চাদের কিছু আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম– হয়তো নতুন জামা কিনে দেব বা মিষ্টি। কিন্তু ইসরায়েল আমাদের ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে, আমাদের বাড়ি ও নিরাপত্তার মতোই।’ 
উরুদ আসফুরের তিন ছেলে– আদম (৮), আবদুল্লাহ (৭) ও হাসান (৬) তাদের বাবার সঙ্গে বেকারি ও পানির লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। উরুদ বলেন, ‘সারাবিশ্বের শিশুরা যেখানে ঈদ উদযাপন করছে, সেখানে আমার বাচ্চাদের খাবার ও পানির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি উৎসবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এমনকি রমজানও। আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধ শেষ হচ্ছে। এখন শুধু সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের একমাত্র সংগ্রাম।’
সপ্তাহখানেক আগে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ, ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে হামাসের হাতে আটক ব্যক্তিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যেই গাজাবাসী আবারও বোমাবর্ষণের নির্মম মূল্য দিচ্ছে।  
যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও আর্টিলারি গাজায় অবিরাম হামলা চালাচ্ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার বেশির ভাগই শিশু ও নারী। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে।
এ হামলায় দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির সময় অস্থায়ীভাবে চালু হওয়া দোকান ও বাজারগুলো আবারও পরিত্যক্ত। স্বাভাবিক জীবনের যে কোনো সম্ভাবনা এখন ধোঁয়া ও ধ্বংসস্তূপে মিলিয়ে গেছে।
৫২ বছর বয়সী আমাল আহমেদ তাঁর নাতিকে যখন সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, তখন সে বসেছিল তাদের বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে উদ্ধার করা জিনিসের স্তূপের ওপর। পরিবারের অন্য সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তারা পূর্ব খান ইউনিসের ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাড়ার কাছে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। আমাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম জীবন আবার গুছিয়ে নিতে পারব। এমনকি ঈদের কুকিজ বানানোরও প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, শুধু কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করার জন্য। ইসরায়েলের যুদ্ধ সেই আশাও শেষ করে দিয়েছে।’
আমালের ছয় সন্তান ও সাত নাতি-নাতনি এখন বিভিন্ন জায়গায় আছে। তাঁর ছেলে মোহাম্মদের এক সন্তান কয়েক মাস আগে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল, এখন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আমালের সন্তানদের মধ্যে নেসমা (২২), মাহমুদ (১৯) ও মুয়াতাজ (১৫) তাঁর সঙ্গেই আছে, কিন্তু তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত।  
আমাল আহমেদের স্ত্রী বলেন, ‘ইসরায়েল চায় আমরা হয় মরব, নয়তো দেশ ছাড়ব। আমার স্বামীও ঈদের আগে ছেলেমেয়ের জন্য কিছু কিনতে টাকা ধার করেছিল। কিন্তু এখন আমাদের আবারও একমাত্র লক্ষ্য– এই গণহত্যা থেকে বেঁচে থাকা।’ রাগান্বিত আমাল বলেন, ‘আমাদের কি অনন্ত দুঃখেই বাঁচতে হবে? আমাদের বাচ্চারা কি মুসলিম বিশ্বের অন্য শিশুদের মতো আনন্দ পাওয়ার অধিকারী নয়? ইসরায়েল চায় আমরা হয় মরব, নয়তো দেশ ছাড়ব।’
যুদ্ধ গাজার ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ঈদের জন্য পণ্য মজুত করা দোকানিরা এখন তাদের খালি দোকান দেখছেন। গত কয়েক সপ্তাহে খাদ্যের দাম কমলেও এখন তা আবার বেড়ে গেছে এবং সরবরাহ আবারও কমে আসছে।
খান ইউনিসের জালা স্ট্রিট, যেখানে ঈদের কেনাকাটায় পোশাকের দোকানগুলোতে ভিড় লেগে থাকত, এখন সেই দৃশ্য কল্পনাতীত। ৩২ বছর বয়সী দোকানদার নাসার আল-মাসরি তাঁর দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন। মাত্র দু’দিন আগেও যে দোকান ভরে ছিল ক্রেতায়। এখন নতুন পোশাকের র‍্যাকগুলো ফাঁকা। নাসার জানান, বোমাবর্ষণ শুরু হওয়ার পর মানুষ কেনাকাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা জানে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
ইসরায়েল ফের আক্রমণ শুরু করার আগে গাজার সীমানা বন্ধ  এবং ২ মার্চ থেকে জরুরি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আটার অভাবে বেকারিগুলো বন্ধ, হাসপাতালগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। দৈনন্দিন জিনিসপত্রের জোগান দেওয়া এখন এক নিদারুণ সংগ্রাম।  
গাজার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড.

মুয়াফফাক আল-কাফারনা সতর্ক করেছেন, এই আক্রমণ সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে পারে এবং এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা। এই যুদ্ধ শুধু হামাসের বিরুদ্ধে নয়; এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ভাঙার, বেসামরিক মানুষকে হতাশার দিকে ঠেলে দেওয়ার এবং তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করার একটি কৌশল। নাকবা বা ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির শঙ্কা দীর্ঘদিন ধরে ছিল। জাতিগত নির্মূলীকরণ বরাবরই ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক নীতির অংশ। আক্রমণের মাধ্যমে হোক বা জীবনকে অসহনীয় করে তোলার মাধ্যমে– তাদের লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলা।’
উরুদ ও আমালের মতো বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর কাছে এই রাজনৈতিক বিতর্ক বিমূর্ত। তাদের কাছে যা মূর্ত তা হলো, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ঈদে তাদের প্রার্থনা– এই নিরন্তর কষ্টের অবসান হোক। আসফুর তাঁর মেয়েদের জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমরা জানি না কখন এই যুদ্ধ শেষ হবে; কিন্তু আমরা এটা জানি– গাজা রক্তাক্ত হচ্ছে, বিশ্ব এখনও নীরব দর্শকের ভূমিকায়।’ v
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: খ ন ইউন স র ত র সময আম দ র র জন য আনন দ ইসর য আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে পাঁচটি রাজ্য সরকার চায় বিএমজেপি

কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি দেশকে পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত করে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা প্রচলনসহ পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি (বিএমজেপি)। দলটি বলেছে, বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও ভূ-রাজনীতির কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। পৃথিবীর কোনো পরাশক্তি বাংলাদেশকে ছোট করে দেখতে পারবে না। সেজন্য প্রতিবেশী দেশসহ সব দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। অবশ্যই সেই সম্পর্ক হবে সমমর্যাদা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে।

সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত বিএমজেপি এর সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়। 

দলটির পাঁচদফা দাবিতে আরও রয়েছে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ আদর্শ প্রতিষ্ঠা; সর্বস্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা; জাতীয় শিক্ষাক্রমের সব পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলনশীল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পাঠদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার পর দলটির পক্ষে আয়োজিত প্রথম এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিএমজেপি সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল। দলকে নিবন্ধন দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ভয়কে জয় করে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে বিএমজেপি।

তিনি বলেন, ছাত্রদের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছে। এ কাজে সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনী নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উত্তরণে বড় রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকাও প্রশংসনীয়।
  
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএমজেপি এর মহাসচিব দিলীপ রায়, যুগ্ম মহাসচিব ডা. ফাইজুর রহমান, অ্যাডভোকেট তারক চন্দ্র রায় ও অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার সূত্রধর।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ