আর পাঁচজন নিষ্ঠাবান সংবাদ-সচিবের মতোই শফিকুল আলম প্রত্যাশিতভাবে বলেছেন যে, বেইজিং সফরকালে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে শুক্রবারের আলোচনা ছিল ‘উষ্ণতাপূর্ণ এবং অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ’।
সন্দেহ নেই, মুহাম্মদ ইউনূস গতবছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটি নিয়ে যেমন ঢাকা, তেমনই বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। সেটি কেবল এ কারণে নয় যে, এ বছর বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পূরণ হচ্ছে; বরং এ কারণেও যে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশ সামনে এসেছে।
ইউনূস-শি বৈঠকের পর প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখলে অবশ্য সফরটিকে বহুলাংশে গত বছরের জুলাইয়ে হাসিনা-শি বৈঠকেরই সম্প্রসারণ মনে হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতির আগে আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ওই সফর ও বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে এবারের মতোই এক চীন নীতি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পরও শুল্কছাড় সুবিধা, আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে পারস্পরিক সমর্থন প্রভৃতি বিষয়ে ঐকমত্য ব্যক্ত হয়েছিল। এমনকি বাংলাদেশ থেকে চীনে ‘ফ্রেশ ম্যাঙ্গো’ রপ্তানির বিষয়টি সেবারও ছিল। দুটি আলোচ্য বিষয় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এবারের চীন সফরকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত বছরের সফর থেকে মৌলিকভাবে আলাদা করেছে।
কাকতালীয়ভাবে, দুই আলোচ্য বিষয়ই পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পে নিবারণ ও হরসুন্দরীর মাঝখানে দৃশ্যত অনুপস্থিত থেকেও শৈলবালা যেভাবে কার্যত প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে; সেভাবে এবারের বৈঠকে বাংলাদেশ-চীন আলোচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল ভারত।
প্রথমটি হচ্ছে, যৌথ ঘোষণার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছ, মোংলা বন্দর সুবিধার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণকে বাংলদেশ স্বাগত জানায়। অনেকের মনে আছে, গত বছর জুলাই মাসে ভারতের বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল যে, মোংলা বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ভারত। পরে তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ভারতীয় ঋণ সহায়তা বা লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারতীয় পক্ষ মোংলায় কিছু ‘উন্নয়ন কাজ’ বাস্তবায়ন করছে মাত্র। বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পায়নি। অবশ্য গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ভারতের বন্দর, শিপিং ও নৌপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তাদের দেশ ‘যত দ্রুত সম্ভব’ মোংলা বন্দর সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে চায়।
শেষ পর্যন্ত মোংলা বন্দরে ভারত নয়, চীনের অংশীদারিত্বই নিশ্চিত হলো। বস্তুত মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরের আগে ‘মোংলা বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প নিয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের মধ্যে কমার্শিয়াল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে (বাসস, ২৫ মার্চ ২০২৫)।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়েছিল ২০১৫ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে। মোংলা বন্দর বিষয়ে চীনা কোম্পানির সর্বশেষ সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে ভারতের এক দশকের উদ্যোগ কার্যত সমুদ্রে পড়ে গেল।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরকে বিশেষ করে তুলেছে, সেটি হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের পুনঃপ্রবেশ। যৌথ ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমআরপি) চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ পক্ষ স্বাগত জানায়।’
আমরা জানি, ২০১৯ সালের জুন মাসে চীনা কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ (টিআরসিএমআরপি) নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রসর হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। সপ্তাহখানেক পর, ২৮ ডিসেম্বর (২০২৩) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবে ভারতের আপত্তি থাকলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এগোতে হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন। কিন্তু দিল্লি সফরে গিয়ে হাছান মাহমুদ ৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের ভোট মিটে গেলে তিস্তা নিয়ে সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। ওই বছর জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই পক্ষের ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ সংক্রান্ত ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল– ‘উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মত সময়সীমার মধ্যে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ এ ছাড়া ‘আউটকাম’ তালিকায় বলা হয়েছিল– ‘ভারতের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা (সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে) বাংলাদেশ সফর করবে।’
বলা বাহুল্য, এরপর তিস্তা দিয়ে তিরতির করে যতটা পানি গড়িয়েছে, ঢাকার ঘটনাপ্রবাহ তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে এগিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব যেমন সবচেয়ে তলানিতে নেমে এসেছে, তেমনই চীনের প্রভাব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফর সামনের দিনগুলোতে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
মনে আছে, গত বছর ২১-২২ জুন শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের পর মূলত তিস্তা প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলেছিল, দিল্লি ‘কনুই মেরে’ বেইজিংকে সরিয়ে দিয়েছে (ইন্ডিয়া এলবোস আউট চায়না ফ্রম রিভার কনজারভেশন প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ, ডেকান হেরাল্ড, ২৩ জুন ২০২৪)। মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সফরের মধ্য দিয়ে বেইজিং দৃশ্যত দিল্লিকে পাল্টা কনুই মারল। শুধু এক তিস্তা নয়, প্রধান উপদেষ্টা চীনের পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেভাবে ‘কয়েকশ নদী’ ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীনের কাছ থেকে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তাতে এটিকে ‘তিস্তা প্লাস’ তাৎপর্য বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে; রিভারাইন পিপলের গবেষণায় আমরা দেখেছি, মোট আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩টি। এক তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা যদি ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলে; প্রশ্ন জাগে, সব আন্তঃসীমান্ত নদীতে চীনের সম্পৃক্ততার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
এসব প্রশ্নও সংগত, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারত দ্বৈরথে বর্তমান অবস্থান ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে কতটা সুবিধা দেবে? সম্ভাব্য অসুবিধাই বা কী? এতে করে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়ল না কমল? নির্ভর করছে আমাদের দক্ষতার ওপর। কারণ ভূ-রাজনীতি মানেই টেস্ট ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি নয়। কোনো এক সফর দিয়ে ভিনি, ভিডি, ভিসি মনে করার ব্যাপার তো নয়ই।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ন সফর প রকল প গত বছর র জন ত বল ছ ল মন ত র হয় ছ ল সরক র সফর র বছর র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
চীন সফরের ‘তিস্তা প্লাস’ তাৎপর্য
আর পাঁচজন নিষ্ঠাবান সংবাদ-সচিবের মতোই শফিকুল আলম প্রত্যাশিতভাবে বলেছেন যে, বেইজিং সফরকালে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে শুক্রবারের আলোচনা ছিল ‘উষ্ণতাপূর্ণ এবং অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ’।
সন্দেহ নেই, মুহাম্মদ ইউনূস গতবছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটি নিয়ে যেমন ঢাকা, তেমনই বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। সেটি কেবল এ কারণে নয় যে, এ বছর বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পূরণ হচ্ছে; বরং এ কারণেও যে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশ সামনে এসেছে।
ইউনূস-শি বৈঠকের পর প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখলে অবশ্য সফরটিকে বহুলাংশে গত বছরের জুলাইয়ে হাসিনা-শি বৈঠকেরই সম্প্রসারণ মনে হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতির আগে আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ওই সফর ও বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে এবারের মতোই এক চীন নীতি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পরও শুল্কছাড় সুবিধা, আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে পারস্পরিক সমর্থন প্রভৃতি বিষয়ে ঐকমত্য ব্যক্ত হয়েছিল। এমনকি বাংলাদেশ থেকে চীনে ‘ফ্রেশ ম্যাঙ্গো’ রপ্তানির বিষয়টি সেবারও ছিল। দুটি আলোচ্য বিষয় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এবারের চীন সফরকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত বছরের সফর থেকে মৌলিকভাবে আলাদা করেছে।
কাকতালীয়ভাবে, দুই আলোচ্য বিষয়ই পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পে নিবারণ ও হরসুন্দরীর মাঝখানে দৃশ্যত অনুপস্থিত থেকেও শৈলবালা যেভাবে কার্যত প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে; সেভাবে এবারের বৈঠকে বাংলাদেশ-চীন আলোচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল ভারত।
প্রথমটি হচ্ছে, যৌথ ঘোষণার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছ, মোংলা বন্দর সুবিধার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণকে বাংলদেশ স্বাগত জানায়। অনেকের মনে আছে, গত বছর জুলাই মাসে ভারতের বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল যে, মোংলা বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ভারত। পরে তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ভারতীয় ঋণ সহায়তা বা লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারতীয় পক্ষ মোংলায় কিছু ‘উন্নয়ন কাজ’ বাস্তবায়ন করছে মাত্র। বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পায়নি। অবশ্য গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ভারতের বন্দর, শিপিং ও নৌপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তাদের দেশ ‘যত দ্রুত সম্ভব’ মোংলা বন্দর সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে চায়।
শেষ পর্যন্ত মোংলা বন্দরে ভারত নয়, চীনের অংশীদারিত্বই নিশ্চিত হলো। বস্তুত মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরের আগে ‘মোংলা বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প নিয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের মধ্যে কমার্শিয়াল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে (বাসস, ২৫ মার্চ ২০২৫)।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়েছিল ২০১৫ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে। মোংলা বন্দর বিষয়ে চীনা কোম্পানির সর্বশেষ সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে ভারতের এক দশকের উদ্যোগ কার্যত সমুদ্রে পড়ে গেল।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরকে বিশেষ করে তুলেছে, সেটি হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের পুনঃপ্রবেশ। যৌথ ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমআরপি) চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ পক্ষ স্বাগত জানায়।’
আমরা জানি, ২০১৯ সালের জুন মাসে চীনা কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ (টিআরসিএমআরপি) নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রসর হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। সপ্তাহখানেক পর, ২৮ ডিসেম্বর (২০২৩) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবে ভারতের আপত্তি থাকলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এগোতে হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন। কিন্তু দিল্লি সফরে গিয়ে হাছান মাহমুদ ৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের ভোট মিটে গেলে তিস্তা নিয়ে সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। ওই বছর জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই পক্ষের ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ সংক্রান্ত ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল– ‘উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মত সময়সীমার মধ্যে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ এ ছাড়া ‘আউটকাম’ তালিকায় বলা হয়েছিল– ‘ভারতের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা (সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে) বাংলাদেশ সফর করবে।’
বলা বাহুল্য, এরপর তিস্তা দিয়ে তিরতির করে যতটা পানি গড়িয়েছে, ঢাকার ঘটনাপ্রবাহ তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে এগিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব যেমন সবচেয়ে তলানিতে নেমে এসেছে, তেমনই চীনের প্রভাব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফর সামনের দিনগুলোতে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
মনে আছে, গত বছর ২১-২২ জুন শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের পর মূলত তিস্তা প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলেছিল, দিল্লি ‘কনুই মেরে’ বেইজিংকে সরিয়ে দিয়েছে (ইন্ডিয়া এলবোস আউট চায়না ফ্রম রিভার কনজারভেশন প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ, ডেকান হেরাল্ড, ২৩ জুন ২০২৪)। মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সফরের মধ্য দিয়ে বেইজিং দৃশ্যত দিল্লিকে পাল্টা কনুই মারল। শুধু এক তিস্তা নয়, প্রধান উপদেষ্টা চীনের পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেভাবে ‘কয়েকশ নদী’ ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীনের কাছ থেকে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তাতে এটিকে ‘তিস্তা প্লাস’ তাৎপর্য বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে; রিভারাইন পিপলের গবেষণায় আমরা দেখেছি, মোট আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩টি। এক তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা যদি ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলে; প্রশ্ন জাগে, সব আন্তঃসীমান্ত নদীতে চীনের সম্পৃক্ততার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
এসব প্রশ্নও সংগত, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারত দ্বৈরথে বর্তমান অবস্থান ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে কতটা সুবিধা দেবে? সম্ভাব্য অসুবিধাই বা কী? এতে করে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়ল না কমল? নির্ভর করছে আমাদের দক্ষতার ওপর। কারণ ভূ-রাজনীতি মানেই টেস্ট ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি নয়। কোনো এক সফর দিয়ে ভিনি, ভিডি, ভিসি মনে করার ব্যাপার তো নয়ই।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com