বহুদিন আগের কথা। আমি তখন আমেরিকার অরেগন রাজ্যে বাস করি। সদ্য ফেলে আসা বাংলাদেশের স্মৃতি হৃদয়ে তখন বারবার জেগে ওঠে। এমন প্রবাস কষ্টের সময়ে এসেছিল চিঠিটি। প্রসঙ্গ রমজান ও ঈদ। লেখিকার অনুরোধ আমি যেন আসন্ন ঈদুল ফিতর নিয়ে একটা কবিতা লিখে পাঠাই। সত্তরের দশকের শেষে দেশ ছাড়ার আগে বিভিন্ন সাহিত্যের আসরে ছিল আমার পদচারণা, তার কারণে হয়তো এ অনুরোধ। আমাদের ব্যবহারিক জীবন চলত আধুনিক গ্রেগরিয়ান মাস– গ্রিক রোমান দেবদেবীর নামাঙ্কিত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ইত্যাকার নামকে ঘিরে। আর ঈদ-রমজান আবর্তিত হতো চাঁদকে ঘিরে। চাঁদের আবির্ভাব, বৃদ্ধি, পূর্ণিমায় পরিণত হওয়া ও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাওয়া। 

এমন নিশাচরী প্রাকৃতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে আমাদের ধর্মীয় ও উৎসবের দিন ও রাতগুলো। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, ধর্মের বাইরে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক/সাহিত্যিক বলয়ে আমরা মুসলমানরা ঈদ ও রমজানকে বর্ণনা ও গ্রহণ করতে পারিনি। যেভাবে হিন্দু ধর্ম ঋতু ও প্রকৃতিকে ঘিরে পূজাকেন্দ্রিক সাহিত্যের সম্ভার রচনা করেছে, বাঙালি মুসলমান তার যাপিত জীবনের আচারসর্বস্ব ধর্মকে শিল্পের মোড়কে গ্রহণ করেনি। 

শত শত বছর পূর্ববঙ্গ ও সিলেটের মুসলমানদের যাপিত জীবন আবর্তিত হয়েছে হিজরি পঞ্জিকাকে ঘিরে। সে পঞ্জিকা ঘিরে আমরা পালন করেছি আশুরা, মহররম, শবেবরাত, ঈদ, রমজান প্রভৃতি অনুষ্ঠান। বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান প্রাকৃতিক উৎসব যেমন– চৈত্রসংক্রান্তি, বসন্ত উৎসব, নববর্ষ ইত্যাদি এসেছে বাংলা মাসগুলোকে কেন্দ্র করে। আশ্বিন, ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ প্রভৃতি মাস হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি পরিচায়ক বাঙালিত্বের নিশানদার এবং তাদের কেন্দ্র করেই আমরা তৈরি করেছি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের রোজনামচা। রবীন্দ্রনাথ শরতের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে লিখেছেন– ‘এসো গো শারদ লক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে’– এই যে ধর্ম ও প্রকৃতিচিন্তাকে মিলিয়ে তৈরি করা এক গভীর সাংস্কৃতিক দ্যোতনা, এটা আমরা মুসলমানেরা রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে করতে পারিনি। এই মিলন ঘটানোর সময় ফুরিয়ে যায়নি।  

আমাদের চান্দ্রিক মাসগুলোর নাম আরবি। ১৩০০ বছর পরেও আমরা এ নামগুলো আত্মস্থ করতে পারিনি। আমি আমার সেই গুণমুগ্ধ পত্রলেখিকার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তাঁর তাগাদায় একটা ঈদকেন্দ্রিক গভীর কবিতা লিখতে সেদিন ব্রতী হয়েছিলাম। মনের গভীরে সন্ধান করছিলাম এমন এক ঈদের চিত্রকল্প, যা উৎসারিত আমাদের নদীবিধৌত গ্রামীণ আবহাওয়া থেকে। ‘চাঁদের কসম খাওয়া রাত’ কিংবা ‘সেমাই গন্ধে ভরা ভোর’ এমন চিত্রকল্প মনে এসেছিল। অঘ্রানের ধান কাটা মাঠকে নিমেষে ঈদের ময়দানে পরিণত করে ভূস্বামী আশরাফ ও কৃষক আতরাফেরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেছে প্রার্থনায়। অতএব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এক নতুন সাম্যবাদ, ঈদকে নিয়ে এমন এক প্রগতিশীল চিন্তায় শিহরিত হয়েছিলাম।

আমার দীনিয়াতের শিক্ষক ছোটবেলা হাদিস শিখিয়েছিলেন– ‘আস্ সিয়ামু, যুন্নাতুন’। রোজা হচ্ছে চাল কিংবা বর্মস্বরূপ। কেন বর্ম? কিসের বিরুদ্ধে বর্ম? যুগ যুগ ধরে মানুষ প্রচুর খাওয়াদাওয়াকে মনে করেছে ভোগ এবং অনশনকে মনে করেছে উপাসনা। খ্রিষ্টধর্মে ইস্টারের সময়ে রয়েছে লেন্টের অনশন, যা এক সময় ছিল চল্লিশ দিনের। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মেও আছে ধর্মের খাতিরে অন্ন পরিহারের নিয়ম। ইসলাম এই মানবিক প্রেরণাকে জোরালো স্বীকৃতি দিয়ে একটা পুরা চান্দ্রমাসকে এ আচারের অনুগত করে এক তাৎপর্যময় সামাজিক, মানবিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে। শৈশবে এক গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে খেতে পাওয়া ও না-পাওয়ার নাগরদোলায় আবিষ্ট থাকত মানুষ, সেই পরিবেশে আমি রোজা রাখার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তারপর দীর্ঘদিন চলে গেছে, বহু মহাদেশে, অনেক জীবন ছেনে আবার থিতু হয়েছি শৈশবের সেই গ্রামে। এ বছর কাটিয়েছি রমজানের অনেকগুলো দিন। সিলেটি ভাষায় আমরা সাহ্‌রিকে বলি ‘ফতা খাওয়া’, ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে গভীর রাতে ফতা খাওয়ার জন্য সে যুগে সবাইকে ডাকা হতো। 

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলার মানুষ শহরমুখী হলো, রমজান ও ঈদের জন্য কিন্তু গ্রামমুখী হতে ভুলল না। শুধু তৈরি করল রমজান ও ঈদকে ঘিরে নাগরিক উৎসব, যার প্রবল পরাকাষ্ঠা এবার দেখেছি ঢাকায় ও আমাদের জেলা শহরগুলোতেও। ভাজা, ছোলা, ডালের পেঁয়াজু, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, জিলিপি, শরবত ইফতারকে কেন্দ্র করে। গেল বছর রোজার ঠিক আগে আমি সময় কাটিয়েছিলাম মিসর ও জর্ডানে। শুনেছিলাম কায়রোর রমজান ও ঈদ উৎসবের কথা।
এবার ঢাকা ও বাংলাদেশ ঘুরে মনে হলো, আমাদের রমজান ও ঈদ উৎসব পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আমরা এই বিশাল ধর্ম-নিঃসৃত সাংস্কৃতিক যজ্ঞকে চিরকালীন সাহিত্যে পরিণত করব; যা আমাদের বিশ্বাস ও জীবনের যাপিত সময়ে, তা চলে আসুক আমাদের গল্পে, গানে, কবিতায়। যে নৈতিক ঢাল ও সংযম রোজার অবদান, তা ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের জীবনে। প্রতিদিনের ইফতারের আনন্দ আর মাস পেরিয়ে ঈদের আসন্ন আনন্দ যেন হয়ে ওঠে এক শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ গড়ার অঙ্গীকার।

ঈদ আসন্ন। ঘটনাক্রমে আমি আবার বিদেশে। কিন্তু আমি একটা চক্রাকার সময়গোলকে দেখতে পাচ্ছি আমার শৈশব, আমার গ্রাম। আজীবন রেমিট্যান্সযোদ্ধা আমি দেখতে পাচ্ছি আমার সমস্ত জীবনকে। এ জীবনে রূপকল্প রমজান এবং ঈদ। এ জীবন ক্ষুধা পেরিয়ে আনন্দের, এ জীবন ত্যাগ ও তিতিক্ষা পেরিয়ে পরিপূর্ণতার। ঈদ ধন্য হোক। ঈদ মোবারক।
গ্রামীণ চাঁদ নিঃসৃত রূপকল্প ছাপিয়ে ঈদ হয়ে উঠেছে নগরের। চাঁদরাতের হুল্লোড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের নারীরা। সালোয়ার-কামিজ ও রুপালি-সোনালি কারুকাজে নতুন স্বপ্ন বস্ত্রশিল্পের। এ আয়োজনে আছে নিত্যনতুন শিল্পের ইঙ্গিত। নীল নদ, দজলা ফোরাত কিংবা বুড়িগঙ্গার পারে ঈদকে কেন্দ্র করে রচিত হচ্ছে নতুন ফ্যাশন। নগরের ঈদ। প্রবাসের ঈদ ধ্বনিত হচ্ছে জমকালোভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই পণ্যবাদী বাণিজ্যিক ঈদকে মেলাতে হবে সমাজ নির্মাণের  চেতনার সঙ্গে। প্রেরণামূলক কবিতা ও সংগীতের সঙ্গে। বহুকাল আগে নজরুল লিখেছিলেন– ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’। কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণে আমি লিখেছিলাম–
‘চাঁদের কসম খাওয়া রাত পেরিয়ে অন্তহীন সোনালী ভোরের’ কথা। আগামীর তরুণ-তরুণীরা গ্রহণ করুন ঈদকে আরও ব্যাপক মহিমায়। আবারও ঈদ মোবারক।

আবেদ চৌধুরী: জিন বিজ্ঞানী 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: রমজ ন ও ঈদ ক ন দ র কর ম সলম ন আম দ র জ বন র

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও চাঁদরাতে বাংলাভিশনের ‘উৎসবে আনন্দে’

এক যুগের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাভিশন চাঁদরাত ঘিরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারও প্রচার করতে যাচ্ছে বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান ‘উৎসবে আনন্দে’। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচার হবে ঈদের আগের দিন রাত ৮টা ১ মিনিটে।
ঈদ আয়োজনের পাশাপাশি জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশন ২০ বছরে পদার্পণ করছে। এবারের আয়োজনে অংশ নেবেন জনপ্রিয় তিন ফোকশিল্পী বিউটি, আশিক ও দীপা।

তাঁরা গান শুনিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করবেন। লোকসংগীতের ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে অনুষ্ঠানটিতে শিল্পীরা চিরায়ত বাংলা গানের কালজয়ী এবং জনপ্রিয় গানগুলোই এ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করবেন বলে জানানো হয়েছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

বাংলাভিশনের অনুষ্ঠানপ্রধান তারেক আখন্দ চাঁদরাত উপলক্ষে বলেন, ‘এবারের চাঁদরাত আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে, কারণ, এটি ভিন্ন এক পটভূমিতে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। একই সঙ্গে দর্শকপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন বাংলাভিশনের ১৯ বছর পূর্তি; ২০ বছরে পদার্পণ—যা আমাদের জন্য এক আনন্দঘন মুহূর্ত। আমরা চাই, এই উৎসবমুখর সময়কে চাঁদরাতের আয়োজনে আরও রঙিন করে তুলতে। সে লক্ষ্যে, প্রতিবছরের মতো এবারও লোকগীতি নিয়ে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। আশা করছি দর্শকেরা এক ভিন্ন আমেজে চাঁদরাত উপভোগ করবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামী বছর থেকে আরও বড় পরিসরে ঈদ আয়োজন করা হবে: আসিফ মাহমুদ
  • একটা জিনিস বুঝেছি, বাবা-মা ছাড়া ঈদ করা কঠিন: ন্যান্সি
  • সেই সুযোগ এখন আর হয় নেই: ন্যান্সি
  • ঈদে সেই সুযোগ এখন আর হয় নেই: ন্যান্সি
  • ঈদের দিনটা কেটে যায় কাজে, নিজের জন্য আর কিছুই থাকে না
  • আগামীতে আরও বড় পরিসরে ঈদ আনন্দ উৎসবের ঘোষণা আসিফ মাহমুদের
  • বছর ঘুরে আবারও এল খুশির ঈদ
  • তারেক রহমানের ঈদ শুভেচ্ছা, চাইলেন স্বৈরাচারের বিচারও
  • চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ
  • প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও চাঁদরাতে বাংলাভিশনের ‘উৎসবে আনন্দে’