শুক্রবার যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের কেন্দ্রস্থলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে বহু লোক নিহত হয় এবং দেশটির সামরিক জান্তা তৎক্ষণাৎ আন্তর্জাতিক মহলে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। ভূমিকম্পটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল ও বহুমুখী অঞ্চলজুড়ে। এতে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধকবলিত গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ কম্পন অনুভব করা গেছে, যা যানজটপূর্ণ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের চকচকে সুউচ্চ ভবন পর্যন্ত স্পর্শ করেছে। এমনকি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দূরবর্তী এলাকা ও পাহাড়বেষ্টিত ইউনান প্রদেশেও ঝাঁকুনি টের পাওয়া গেছে। চার বছর ধরে গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারের জান্তা সরকারপ্রধান মিন অং হ্লাইং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। আর ‘সাহায্য করতে ইচ্ছুক যে কোনো সংগঠন ও জাতিকে দেশটির অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে এগিয়ে এসে লোকদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য খোলাখুলি আহ্বান জানিয়েছেন।’ 

মিয়ানমারের কিছু অংশে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সাহায্যের জন্য মিন অং হ্লাইংয়ের অপ্রত্যাশিত আহ্বান মূলত দেশটিতে ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের মাত্রা তুলে ধরে। তার জান্তা বাহিনী দেশটিকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছে। রক্তাক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বংসী সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে চার বছরের গৃহযুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে মিয়ানমার বিপর্যস্ত। এতে জান্তা বাহিনী দেশব্যাপী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট সংঘাতে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশটির যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই।     
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যার কর্তৃত্ব এখন বিদ্রোহী নৃ-গোষ্ঠী ও মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। এতে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এগুলো সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এনইউজি বা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের অধীনে পিডিএফ বা পিপল’স ডিফেন্স ফোর্স। সুতরাং আপনি চলমান ঘটনার পুরো চিত্র বুঝতে পারবেন না।  

ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে প্রতিবেদন এখনও পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি। পরিস্থিতির পুরো চিত্র সামনে আসতে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে। মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির পরিচালক অবস্থা ‘ভয়াবহ’ হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন। মোহাম্মদ রিয়াস এক বিবৃতিতে বলেছেন, যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্ত ও যাতায়াত ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে সীমিত পরিমাণে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। উদ্ধার কমিটির প্রধান আরও বলেন, ‘অবকাঠামো ও বাড়িঘরের ধ্বংস, জীবনহানি ও ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলোর আহতদের ঘটনা খাটো করে দেখা উচিত নয়।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহায়তাদানকারী দলগুলোর অবাধ প্রবেশের জন্য ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জন্য ভূমিকম্পের ‘চেয়ে খারাপ ঘটনা আর কিছু হতে পারে না’। মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রু বলেন, ভূমিকম্পটি একটি বিপর্যয়ের ওপর আরেকটি বিপর্যয়। ২০ মিলিয়নের বেশি লোকের ইতোমধ্যে মানবিক সহায়তা দরকার হয়ে পড়েছে এবং প্রায় ৩৫ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে ভিটেমাটি হারিয়েছে। এ সময় অ্যান্ড্রু সিএনএনকে বলেন, ‘আগামী কয়েকদিনে উদ্ধার অভিযান শুরু হলে কী ঘটবে তা ভাবলে আমি শিউরে উঠি।’    

মান্দালয়ের স্থানীয় সময় ১২টা ৫০ মিনিটে ভূমিকম্পটি ঘটে। রাজতন্ত্রকালে মান্দালয় ছিল রাজধানী। এখানে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন লোক বাস করে এবং বহু ঐতিহাসিক মন্দির, প্রাসাদ ও ভবন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা জিওলজিক্যাল সার্ভের মতে, ভূমিকম্পের পরপরই কয়েকটি ধাক্কা অনুভূত হয়, যার মধ্যে একটি ছিল ৬ দশমিক ৪ মাত্রার। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের মধ্য সেগাইং অঞ্চল, যা গৃহযুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত। জান্তা বাহিনীর সঙ্গে মিলিশিয়া ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে এবং সবাই চেকপয়েন্টে নজরদারি রেখেছে। এর ফলে কঠিন হয়ে পড়েছে সড়ক কিংবা নদীপথের ভ্রমণ। সেগাইং প্রধানত গ্রামীণ এলাকা, যেখানে বেশির ভাগ বসতভিটা কাঠ ও তালপাতার। জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে মাঝে মাঝে সংঘাতের কারণে এ অঞ্চলে যোগাযোগ দুরূহ হয়ে পড়ে।  
মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে উদ্ধার অভিযান ভিন্ন হতে পারে। এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি হলো মিয়ানমার। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করা ও জনগণের দুর্ভোগ উপেক্ষা করার বহু রেকর্ড রয়েছে। সেই তুলনায় থাইল্যান্ড অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র, যাদের বেশ দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্ধারকর্মী রয়েছে।  

রস অ্যাডকিন, অ্যালক্স স্ট্যামবগ ও কোচ ওলার্ন: সিএনএন থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ভ ম কম প র গ রস ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিবের তীব্র নিন্দা

সুদানে জাতিসংঘের এক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় ছয় শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। তাঁরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমি সুদানের কাদুগলিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর লজিস্টিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে নৃশংস ড্রোন হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।’

সুদানের কোরদোফান অঞ্চলের কাদুগলি শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের ভবনটিতে গতকাল শনিবার এ হামলা হয়।

গুতেরেসের বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় আরও আট শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। হতাহত ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁরা ইউএন ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেইয়ের (ইউএনআইএসএফএ) হয়ে দায়িত্বরত ছিলেন।

গুতেরেস বলেন, ‘দক্ষিণ কোরদোফানে আজ (শনিবার) শান্তিরক্ষীদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’

হামলায় নিহত শান্তিরক্ষীদের সবাই বাংলাদেশি। তাঁরা ইউএন ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেইয়ের (ইউএনআইএসএফএ) হয়ে দায়িত্বরত ছিলেন। হামলায় আরও আট শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন।

সুদানের সেনাবাহিনী ওই হামলার দায় র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে দেশটির আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চাপিয়েছে।

সুদানে দুই বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে এ লড়াই চলছে।

আরএসএফ তাৎক্ষণিকভাবে হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সুদানের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, এ হামলা বিদ্রোহী মিলিশিয়া এবং এর পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের ধ্বংসাত্মক কৌশলের স্পষ্ট প্রকাশ।

সুদান সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। ভিডিওতে একটি স্থান থেকে ঘন কালো ধোঁয়া আকাশে উঠতে দেখা যাচ্ছে। তারা বলেছে, এটি জাতিসংঘের স্থাপনা।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হতাহত হওয়ার এ ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

দক্ষিণ কোরদোফানে আজ (শনিবার) শান্তিরক্ষীদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।.আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘ মহাসচিব

যেখানে হামলা হয়েছে, সেই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল আবেই নিয়ে সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ২০১১ সালে সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পর থেকে সেখানে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন মোতায়েন রয়েছে।

দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত আবেই বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার অঞ্চল।

সুদানের আবেই অঞ্চলে একটি সড়কে দায়িত্ব পালন করছেন জাতিসংঘের একজন শান্তিরক্ষী

সম্পর্কিত নিবন্ধ