সুপরিচিত একটি স্মার্টফোনের ব্র্যান্ডের একটি মডেলের দাম বাংলাদেশে ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। ভারতে একই ফোনের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ফোনটির দাম ৭৩ হাজার টাকা বেশি।

পাকিস্তানে ফোনটির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৬৪ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে ফোনটি কিনতে ৭৯ হাজার টাকা বেশি দাম দিতে হয়। যদিও বাংলাদেশে অবৈধভাবে আনা একই ফোনের দাম এক লাখ টাকার আশপাশে।

শুধু এই একটি মডেল বা একটি ব্র্যান্ড নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে স্মার্টফোনের দাম মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই বেশি। দামের এত পার্থক্যের কারণে একদিকে বিপুলসংখ্যক স্মার্টফোন শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে, অন্যদিকে চড়া দামের কারণে স্মার্টফোন ব্যবহারে পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশে।

দেশীয় উৎপাদনকারীরা বলছেন, স্মার্টফোনের দাম বেশি হওয়ার কারণ যন্ত্রাংশ আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহ ও খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে উচ্চহারে শুল্ক–কর। অন্যদিকে আমদানিকারকেরা বলছেন, বিদেশ থেকে একটি স্মার্টফোন আমদানি করতে প্রায় ৫৯ শতাংশ শুল্ক–কর দিতে হয়। উচ্চহারে শুল্ক–করের সুরক্ষা পেয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো চড়া দাম রাখার সুযোগ পাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়াতে পারলে অর্থনীতি ও সুশাসনের ক্ষেত্রে তা নানাভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই সরকারের উচিত আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে স্মার্টফোন সাশ্রয়ী করার দিকে নজর দেওয়া। দেশীয় উৎপাদনকারীরা কতটুকু সুরক্ষা পাবে, দেশে উৎপাদিত স্মার্টফোনে কতটা কর থাকবে, এসব নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া উচিত। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দামের পার্থক্য কমে এলে অবৈধভাবে মুঠোফোন আনার হার কমবে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে।

# স্মার্টফোন আমদানিতে ১০০ টাকায় ৫৯ টাকা কর। # অবৈধ ফোনের বাজার রমরমা। # স্মার্টফোন ব্যবহারে ভারত, পাকিস্তান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও সেনেগালের পেছনে বাংলাদেশ

রাজস্ব খাতসংশ্লিষ্ট একটি সরকারি সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেশে উৎপাদন উৎসাহিত করার জন্য স্মার্টফোন আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক–কর আরোপ করে রাখা হয়েছে। ফলে বৈধ পথে কেউ আমদানি করতে চায় না। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে। তবে সেটা কতকাল, কতটা হারে দেওয়া হবে, তা পর্যালোচনা করা দরকার।

‘অফিশিয়াল’ বনাম ‘আন-অফিশিয়াল’

রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোয় সুপরিচিত স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে যে দামে ফোন বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেকটা কম দামে একই ফোন পাওয়া যায় ওই বিক্রয়কেন্দ্রের আশপাশের দোকানেই। ব্র্যান্ডের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে যেসব ফোন পাওয়া যায়, সেগুলো ‘অফিশিয়াল’নামে পরিচিত। অন্যদিকে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে বিক্রি হওয়া একই স্মার্টফোন ‘আন-অফিশিয়াল’ নামে পরিচিত।

যেমন জনপ্রিয় একটি স্মার্টফোনের একটি মাঝারি দামের মডেলের ‘অফিশিয়াল’ ফোনের দাম ৫৭ হাজার টাকা। একই ফোন একই বিপণিবিতানে ‘আন-অফিশিয়াল’ হিসেবে বিক্রি হয় ৩২ হাজার টাকা দামে। ব্যবসায়ীরা জানান, ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোন মূলত কর ফাঁকি দিয়ে আনা। এগুলো ‘লাগেজ পার্টি’র ফোন নামেও পরিচিত।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স থেকে সম্প্রতি একটি মাঝারি দামের স্মার্টফোন কিনেছেন ওয়াহিদুজ্জামান নামের এক গ্রাহক। তিনি জানান, ব্র্যান্ডের নিজস্ব দোকানে গিয়ে ফোনটি কেমন, তা তিনি দেখেছেন। পরে কিনেছেন ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোন। তিনি বলেন, বিপণিবিতানের একই তলায় একই ফোনের দামের এত পার্থক্য হলে কেন মানুষ ‘অফিশিয়াল’ ফোন কিনবে! ‘অফিশিয়াল’ফোনে যে ‘গ্যারান্টি’ (নিশ্চয়তা), ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোনেও সেই একই নিশ্চয়তা দেন বিক্রেতা।

ব্র্যান্ডের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে যেসব ফোন পাওয়া যায়, সেগুলো ‘অফিশিয়াল’নামে পরিচিত। অন্যদিকে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে বিক্রি হওয়া একই স্মার্টফোন ‘আন-অফিশিয়াল’ নামে পরিচিত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে একটি স্মার্টফোন আমদানিতে করভার প্রায় ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট (মূলসংযোজন কর বা মূসক), ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) রয়েছে।

দেশে এখন ১৭টির মতো প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোন উৎপাদন ও সংযোজন করে। তাদের সুরক্ষা দিতেই উচ্চহারে শুল্ক–কর আরোপ করে রাখা হয়েছে। তবে অবৈধ আমদানি কমছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে অবৈধ পথে আমদানি করা স্মার্টফোন, অর্থাৎ ‘গ্রে মার্কেটের’ আকার মোট বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, গত জানুয়ারিতে বৈধভাবে আমদানি হয়েছে মাত্র ৮৫০টি স্মার্টফোন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্মার্টফোনের যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বিক্রির ক্ষেত্রে কর কমাতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিতে কর কমিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দামের পার্থক্য কমাতে হবে। নইলে অবৈধ আমদানি কমবে না।

মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইওবি) সহসভাপতি রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাজারে একটি স্মার্টফোনের জন্য সরকারকে ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হয়। উৎপাদিত হয়ে পরিবেশক পর্যন্ত ১৮ থেকে ২০ শতাংশ কর দিতে হয়। পরবর্তীকালে খুচরা বিক্রেতা থেকে গ্রাহকের হাতে যাওয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ভ্যাট যুক্ত হয়ে দাম আরও বেড়ে যায়। ভারতে এটা ১৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২৫ শতাংশের বেশি।

রেজওয়ানুল হক বলেন, কর কমালে ফোনের দাম কমবে। সরকারকে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে একটি স্মার্টফোন আমদানিতে করভার প্রায় ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট (মূলসংযোজন কর বা মূসক), ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) রয়েছে।ব্যবহারে পিছিয়ে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে স্মার্টফোন ব্যবহার করে ৭০ শতাংশ পরিবার। যদিও ব্যক্তিপর্যায়ে স্মার্টফোনের ব্যবহার এখনো অনেক কম।

মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) গত বছরের অক্টোবরে ‘দ্য স্টেট অব মোবাইল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে শহরের ৪১ শতাংশ এবং গ্রামের ২৬ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। যেখানে ভারতের শহরে ৫২ শতাংশ ও গ্রামের ৪০ শতাংশ এবং পাকিস্তানের শহরের ৪৬ শতাংশ ও গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষের স্মার্টফোনের মালিকানা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বিশ্বের ৪টি অঞ্চলের ১২টি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তথ্য নেওয়া হয়। দেখা যায়, এর মধ্যে স্মার্টফোনের মালিকানায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ৯টি দেশ—মিসর, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, গুয়াতেমালা ও মেক্সিকো। ইথিওপিয়া ও উগান্ডা শুধু বাংলাদেশের পেছনে আছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার কম হওয়ার বড় কারণ, এর দাম। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিপর্যায়ে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়াতে এ ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটররা যেন কিস্তিতে ফোন দিতে পারে, সে সুবিধাও চালু করা প্রয়োজন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক কর শ আমদ ন একই ফ ন পর চ ত উৎপ দ সরক র বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তারে অনুমতির সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে রিটের শুনানি বুধবার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়কার ঘটনায় করা মামলায় আসামি গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে—ঢাকা মহানগর পুলিশের এমন সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে রিট শুনানির জন্য আগামী বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট।

শুনানির জন্য বিষয়টি উত্থাপন করা হলে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এই দিন ধার্য করেন।

৯ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংক্রান্ত মামলায় আসামি গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। আদেশে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংক্রান্ত মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা অধিক। এসব মামলার এজাহারভুক্ত কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণসহ অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনার মামলার এজাহারভুক্ত কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

এই আদেশের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জসিম উদ্দিন গতকাল রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করেন। আজ সকালে আদালতে রিটের বিষয়টি উত্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রিট আবেদনকারী মো. জসিম উদ্দিন।

আরও পড়ুনবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে রিট২২ ঘণ্টা আগে

পরে আইনজীবী মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিটের বিষয়টি উত্থাপন করা হলে আদালত ২৩ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন।’

রিটের প্রার্থনায় দেখা যায়, ৯ এপ্রিলের অফিস আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়। রুল হলে বিচারাধীন অবস্থায় অফিস আদেশের কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া হয়েছে রিটে। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, ডিবি প্রধান, সিআইডি প্রধান, এসবি প্রধানসহ সাতজনকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।

আরও পড়ুনবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে১২ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ