ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বেশি, তৎপরতা সীমিত
Published: 29th, March 2025 GMT
বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের মনি আক্তার চলতি বছর দুবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে তিনি ঢাকাতেও যাননি একবারও। তাই ধরা যায়, স্থানীয়ভাবেই তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন।
মনি আক্তারের স্বামী গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘মশা এই শহরে লাগামছাড়া। ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না।’
ডেঙ্গু একসময় রাজধানী ঢাকার রোগ ছিল আর তা বর্ষা মৌসুমেই সাধারণত ছড়াত। কিন্তু এখন এ রোগ সারা দেশে ছড়িয়েছে এবং সারা বছরই লেগে আছে। দেশে ডেঙ্গুর বড় আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০০ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি রোগী থাকত রাজধানীতে। কিন্তু ২০২৩ সালে এর ব্যত্যয় হয়। এর পর থেকে রাজধানীর চেয়ে বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে চলতি বছর যত রোগী ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে, অতীতে তা হয়নি। এ বছর মোট আক্রান্তের প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকার বাইরে। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা থাকার পরও স্থানীয় সরকারের কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ে। কিন্তু ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ অনেক কম। এর মধ্যে আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধি না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
ঢাকার বাইরে আক্রান্ত বাড়ছেডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ঢাকার বাইরে।
চলতি বছর (২৮ মার্চ পর্যন্ত) ১ হাজার ৮৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯ ভাগই ঢাকার বাইরের রোগী। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। মোট রোগীর ৬২ ভাগ ছিল ঢাকা নগরীর বাইরের। ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়। ওই সময় মোট আক্রান্তের ৬৫ শতাংশই ছিল ঢাকার বাইরের। ওই বছরই আসলে ডেঙ্গু এভাবে দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীতে ছাড়িয়ে যায় আক্রান্তের দিক থেকে। এর আগের বছর ২০২২ সালে মোট আক্রান্তের ৩৭ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ বলছিলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর এই বিস্তারের বড় কারণ মশার নিয়ন্ত্রণে প্রায় কোনো উদ্যোগ নেই। মশা আপন মনে বেড়ে যাচ্ছে। আগে তো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা ছিলেন, কিছু কাজ ছিল। এখন তা–ও নেই। আর নতুন নতুন শহর গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। সেখানে নতুন নতুন প্রজননক্ষেত্র বাড়ছে।
ঢাকার বাইরে প্রস্তুতি কমখুলনা বিভাগের ১০ জেলায় চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১১১ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে খুলনায়, ৩৪ জন। এই রোগীদের মধ্যে ১৭ জন খুলনা মেডিকেলের, বাকিরা শহরের বাইরের বিভিন্ন ছোট শহর বা গ্রামের হাসপাতালের রোগী।
খুলনা বিভাগের ছোট জেলা নড়াইলে এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩। নড়াইল পৌর শহরে মশার উপদ্রব অনেক। মশা নিধনে অবশ্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যান্য বছর পৌরসভায় ফগার মেশিন দিয়ে মশকনিধন ওষুধ ছিটানো হলেও এ বছর তা চোখে পড়েনি পৌরবাসীর।
নড়াইলে শীতের শেষে হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশার অত্যাচারও বেড়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকাকেই মশার উপদ্রবের মূল কারণ বলে মনে করেন শহরবাসীর কেউ কেউ।
রাজধানীর বাইরে সিটি করপোরেশনগুলোতে মশা নিধনে তৎপরতা কম। রাজধানীর উত্তর সিটিতে একজন কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দক্ষিণে বাইরের কীটতত্ত্ববিদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া হয়। এর বাইরের সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদের কোনো বালাই নেই। ডেঙ্গুকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ও তৎপরতা—দুইয়েরই ঘাটতি যথেষ্ট।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে ৫ জন করে একটি দল রয়েছে। এ ছাড়া ৬০ জনের একটি বিশেষ দল রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নগরের নির্ধারিত এলাকাগুলোতে ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। সিটি করপোরেশনের সূত্র জানায়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আলাদা করে বাজেট নেই। তবে মশক ওষুধ ক্রয় খাতে চলতি অর্থবছরে চার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সিটিতে কোনো কীটতত্ত্ববিদও নেই।
দেশের নবীন সিটি করপোরেশন ময়মনসিংহ। এ সিটির খাদ্য ও স্যানিটেশন কর্মকর্তা দীপক মজুমদার বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের লোকবলই মশা নিধনের কাজ করে। কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই, তবে সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে সহায়তা দেওয়া হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্যগত দিক নয়; বরং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, নগরকেন্দ্রিক পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ—এসব বিষয় জড়িত। এসবের জন্য জনসম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মশা নিধন, বিশেষভাবে ডেঙ্গুর এডিস মশা নির্মূলের উদ্যোগ মোটেও কার্যকর নয় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি মশা নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
অধ্যাপক বাশার বলছিলেন, ‘স্থানীয় সরকারের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দুর্বল। কিন্তু এডিস মশার বিস্তার ঢাকার বাইরে অনেকটাই আছে। ডেঙ্গু এত বছর ধরে আমাদের ভোগাচ্ছে কিন্তু রাজধানীর বাইরে উন্নত মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ দেখছি না।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নির্বাচন হতেই হবে
বাংলাদেশে নির্বাচনপূর্ব সময়ে সব সময় কিছু বিশৃঙ্খলা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের চেয়ে বেশি নাজুক। এর কারণ বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে পর্যায়ে নেমেছে, সেখান থেকে বর্তমান সরকার দেড় বছর সময় পেলেও খুব দৃশ্যমান কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এবং এর আগে থেকে পরিস্থিতির ওপর যে ধরনের পর্যালোচনা বা অনুধাবনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল। কাজেই প্রস্তুতিও সেভাবে নেওয়া হয়নি। বিপুলসংখ্যক অস্ত্র এর আগে খোয়া গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো উদ্ধার করার জন্য জোর তৎপরতা চালানোর মতো দৃশ্যমান কিছু দেখা যায়নি। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত ছিল, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি আমরা দেখতে পেয়েছি।
আমরা এটাও জানি যে আওয়ামী লীগ (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ), বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেত্রী এবং অন্য যে নেতারা ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাঁরা সেখান থেকে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে উসকানি দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর আগাম প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন ছিল। সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি যদি তারা নিয়ে থাকে, তাহলে অবস্থার অবনতি হতো না বা হওয়ার কথা নয়।
যেসব বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেই বাহিনীগুলোর কর্মদক্ষতায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত হয়নি। এই বাহিনীকে সরকার সম্পূর্ণভাবে আগের জায়গাতে ফিরিয়ে নিতে পারেনি বা তৈরি করতে পারেনি।
বিশেষ করে অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাইনি। একই সঙ্গে যে ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা বা আগাম তথ্য থাকা উচিত, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তারা আগাম তথ্য পাচ্ছে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগাম তথ্য ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখাটা দুরূহ হয়ে পড়ে।
তবে আমরা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। নির্বাচন যেকোনো মূল্যে হতে হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনোভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। নির্বাচনই একমাত্র পন্থা, যার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের স্বপ্ন, যার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব। কাজেই নির্বাচন হতে হবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যাতে পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যতটুকু অবনতি হয়েছে, সেটিকে প্রারম্ভিক পর্যায় বলা যায়। তবে এটা একটা অশনিসংকেত। উচিত হবে এখনই এটাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। পুরো পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার লক্ষণকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়া।
আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি আছেন, বিশেষ করে যাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, যাঁরা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের সঠিক ভূমিকাটা রাখবেন। কোনোভাবেই যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে এবং দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থীদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের জন্য এখন থেকেই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ