ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস পেয়েছিলেন ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫। মোট প্রদত্ত ভোটের ৬০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছিলেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২। প্রদত্ত ভোটের হার ৩৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই নির্বাচনে মেয়র পদে আরও চারজন প্রার্থী ছিলেন, যাঁদের সবাই জামানত হারিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশন বলেছে, ওই নির্বাচনে ২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু সেই সময়ে যাঁরা ভোটকেন্দ্রগুলো সরেজমিন ঘুরেছেন, তাঁরা দেখেছেন, ১৫ শতাংশ ভোটারও কেন্দ্রে যাননি। তঁাদের মতে, বিজয়ী কিংবা পরাজিত প্রার্থীর যে ভোট দেখানো হয়েছে, দুটিতেই গোলমাল আছে। 

গত বছর আগস্টে দেশত্যাগের আগপর্যন্ত ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং অনেক অঘটনও ঘটিয়েছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া সব স্থানীয় সরকার সংস্থা ভেঙে দেয়। অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতো ঢাকার দুই সিটিও চলছে প্রশাসক দিয়ে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণার রায় জনমনে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। 

ইশরাক হোসেনের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রার্থী ইশরাক হোসেনের গাড়িবহরে হামলা করা হয়, ইভিএমে ভোট জালিয়াতি করা হয়, নির্বাচনে ভোটারদের ভোট গ্রহণে বাধা দেওয়া হয়, নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করা হয়। এত সব জালিয়াতির পরও নির্বাচন কমিশন শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশনের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালের ৩ মার্চ ইশরাক হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। আদালত পূর্ণাঙ্গ শুনানি নিয়ে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করেছেন।

আদালতের রায়ের মাধ্যমে নিকটতম প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা এটাই প্রথম নয়। গত বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদত হোসেনকে জয়ী ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের গেজেট অনুযায়ী সেখানেও বিজয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাথী এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বিএনপির প্রার্থী শাহাদত হোসেন।

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের নির্বাচন হয়েছিল একই দিনে ১ ফেব্রুয়ারি। উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আতিকুল ইসলাম ও বিএনপির তাবিথ আউয়াল। সেখানেও আতিকুল ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেছিলেন বিএনপির উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। সেই মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়াদ ২০২৬ সালের ২৭ জানুয়ারি শেষ হবে। 

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন অনুযায়ী নির্বাচন হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ করতে হয় এবং সেই ৩০ দিনের মধ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল। পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আইনি বিধান থাকলেও সেটা হয়নি। সাবেক মেয়র তাপস উচ্চ আদালতে আবেদন করে মামলার শুনানি বন্ধ করে রেখেছিলেন। আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, ইশরাক প্রথমে নির্বাচনী রায় বাতিলের আবেদন জানিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মাস তিনেক আগে সংশোধনী আরজিতে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার আবেদন জানান। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা করতে পারেন। 

একাদশ জাতীয় সংসদের একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বগুড়ার হিরো আলমখ্যাত আশরাফুল হোসেন আলম ফেসবুকে জানিয়েছেন, নিকটতম প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করলে তিনি ঢাকা–১৭ ও বগুড়ার দুটি আসনে জয়ী হওয়ার দাবিদার। কিন্তু মামলা না করলে কারও বিষয় আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁকেও আদালতে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত ওই সংসদের মেয়াদ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। ফলে সেই আবেদন আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। 

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হলেও করোনার কারণে সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেন ওই বছরের ১৬ মে। সে ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের ১৫ মে মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে শুক্রবার ইশরাক হোসেন বলেন, ভোটে তিনি হারেননি, তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আইন মেনে তিনি মামলা করেছিলেন। সেই মামলা তখন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর আইনি লড়াইয়ের পর তিনি এখন ন্যায়বিচার পেয়েছেন।

ন্যায়বিচার পেয়েছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে নির্বাচনে আদালতের রায়ে ইশরাক মেয়র হলেন, সেটি কতটা ‘নির্বাচন’ হয়েছিল, সেই প্রশ্নও না উঠে পারে না। নির্বাচন কমিশন ২৯ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখালেও প্রকৃত ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। 

নির্বাচনের পরদিন ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ।’ সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন (বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা) লিখেছিলেন, ‘ভোটারের উপস্থিতি নৈরাশ্যজনক’। বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক আবদুস সালাম বলেছিলেন, ‘ভোট হলো কই। তারা (নির্বাচন কমিশন) মনমতো কিছু ভোট বসিয়ে দিয়েছে।’ 

যে নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ইচ্ছেমতো ভোট বসিয়ে দিয়েছে, সেই নির্বাচনে জয় পুনরুদ্ধার কতটা গৌরবজনক?

আদালতের রায়ের মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হলো যে নির্বাচনে অনিয়ম করে শেষ বিচারে পার পাওয়া যায় না। এর আগেও দু–একটি ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তির নির্বাচনী রায় বাতিল হয়েছে। এর আগে জাতীয় সংসদের একাধিক নির্বাচনেও পরাজিত প্রার্থী আদালতে মামলা করে পক্ষে রায় পেয়েছেন। অনেক বিলম্বে। কখনো সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, কখনো আবেদনকারী মারা যাওয়ার পর।

শাহাদত হোসেন মেয়াদের আগে রায় পাওয়ায় তিনি শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন। কিন্তু ইশরাকের বেলায় দলের সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। যদি দল শপথ নেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি সময় পাবেন ১৫ মে পর্যন্ত। 

একাদশ জাতীয় সংসদের একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বগুড়ার হিরো আলমখ্যাত আশরাফুল হোসেন আলম ফেসবুকে জানিয়েছেন, নিকটতম প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করলে তিনি ঢাকা–১৭ ও বগুড়ার দুটি আসনে জয়ী হওয়ার দাবিদার। কিন্তু মামলা না করলে কারও বিষয় আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁকেও আদালতে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত ওই সংসদের মেয়াদ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। ফলে সেই আবেদন আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। 

এ ঘটনায় আরেকটি কঠিন সত্য বেরিয়ে এল। নির্বাচনী অনিয়ম ও কারচুপির বিরুদ্ধে আদালতে যেসব মামলা হয়, সেগুলো ১৮০ দিন বা ছয় মাসের মধ্যেই রায় হওয়া উচিত। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে থাকলে আদালতের ন্যায়বিচারও বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে লাগে না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি আদালতকে প্রভাবিত করে থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। 

আদালতের এই রায় ক্ষমতাসীনদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে আশা করি। আদালত যখন কোনো প্রার্থীর পক্ষে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের দেওয়া রায় অবৈধ ঘোষণা করলেন, তখন সেই পদের বিপরীতে তিনি যে বেতন–ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা নিয়েছেন, সেটাও ফেরত দেওয়া উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ এই পথে যেতে সাহস পাবেন না। নির্বাচন সংস্কার কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। যেসব সুপারিশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো অবিলম্বে কার্যকর করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইশর ক হ স ন ২০২০ স ল র ব এনপ র এক ধ ক হয় ছ ল য় র পর আওয় ম হওয় র সরক র প রথম র আইন

এছাড়াও পড়ুন:

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকার এখন অস্তিত্বই নেই

‘মুজিব বর্ষ ১০০’ নামে একটি বিশেষ পঞ্জিকা যৌথভাবে তৈরি করেছিল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় তহবিল। এতে ব্যয় করা হয়েছিল প্রায় তিন লাখ টাকা। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বানানো এই পঞ্জিকার প্রথম মাসের নাম ছিল ‘স্বাধীনতা’। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন (১৭ মার্চ) ছিল এই মাসের প্রথম দিন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো এটিরও গণনা করার কথা ছিল ৩৬৫ দিন ধরে। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ পঞ্জিকাটির উদ্বোধন করেছিলেন তখনকার সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে পঞ্জিকাটি শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।

এই পঞ্জিকায় ১২টি মাস আছে। তবে কোনো অধিবর্ষ (ইংরেজি লিপইয়ার) নেই। ১২ মাসের নাম দেওয়া হয়েছিল—স্বাধীনতা, শপথ, বেতারযুদ্ধ, যুদ্ধ, শোক, কৌশলযুদ্ধ, আকাশযুদ্ধ, জেলহত্যা, বিজয়, ফিরে আসা, নবযাত্রা ও ভাষা। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শ্রমসচিব কে এম আলী আজম পঞ্জিকাটির মোড়ক উন্মোচন করে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, পঞ্জিকায় বেশ কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সব অংশীজনের মতামত নিয়ে ক্যালেন্ডারটি চূড়ান্ত করে এরপর সরকারি সব দপ্তরে রাখার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বানানো পঞ্জিকা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকার এখন অস্তিত্বই নেই
  • রমজান জুড়ে ৫ জেলায় এস্পায়ার বাংলাদেশের সহায়তা
  • জীবনের ‘লু হাওয়া’ সরিয়ে লক্ষ্যে লুনা