শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোম্পানির মৌল ভিত্তির পাশাপাশি দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক অবস্থা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ধারণা সূচকের বাইরে চলতি রাজনৈতিক অবস্থা, বিশেষত বিনিয়োগ পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, ওই পরিবর্তন অর্থনীতিতে কোনো পরিবর্তনের সূচনা করবে কিনা–সে বিষয়ে ধারণা নেওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক হালচাল ও অর্থনীতি
গত আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এসেছে। অর্থনীতির যে ভঙ্গুর দশা সৃষ্টি হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষণও স্পষ্ট।
অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারা সৃষ্টির নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি। প্রথমত, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ বা সীমিত হওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকার প্রায় পুরোটা দেশে আসছে। অন্যদিকে রপ্তানির আড়ালে পাচার কিছুটা বন্ধ হওয়ায় রপ্তানি আয়ও কিছুটা বেড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থেমেছে। আবার মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করেছিল, যা এরই মধ্যে কমার পথে।
গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির বাইরে এ মুহূর্তে রাজনীতির মাঠে বিরোধী পক্ষ সক্রিয় নেই। তারপরও রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের এমন অস্থিরতা দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করছে। পরবর্তী সরকার ব্যবস্থা বা ধরন কেমন হবে– তার স্পষ্ট ধারণা না নিয়ে কোনো ব্যবসায়ী নতুন করে ব্যবসা পরিকল্পনা করছেন না। ফলে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
বিনিয়োগ কমার প্রভাব শেয়ারবাজারে
ব্যবসায় বিনিয়োগ না হলে স্বভাবতই অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য কমে, শ্লথ হয় প্রবৃদ্ধি চাকা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি না হলে বিনিয়োগ থেকে বেশি মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে। ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা আগাম সতর্ক হয়ে বিনিয়োগ কমিয়ে দেন। এর প্রভাব পড়ে শেয়ারদরে। গত কয়েক মাসের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক ধারা সে অবস্থারই প্রতিফলন বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে দেওয়ার প্রভাবও আছে শেয়ারবাজারে। নিরাপদ বিনিয়োগে অপেক্ষাকৃত ভালো মুনাফা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছেন বা নতুন করে শেয়ারে লগ্নি করেননি। এর প্রভাবও আছে শেয়ারবাজারে।
শেয়ারবাজারের অতীত প্রবণতা
দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতের রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সরকার বদল হলে শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। অবশ্য ওই দুই উত্থানের পর দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধসও নেমেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের সময় বিবেচনায় নিলে এবারের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে ২০০৭ সালের এক-এগারো রাজনৈতিক পালাবদলে কিছুটা মিল রয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগের অভিজ্ঞতা কিছুটা সহায়তা করতে পারে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করে শেয়ারবাজারে উত্থান শুরু হয়। তবে অচিরেই তার ওপর লাগাম পড়ে। এর পর ক্রমে শেয়ারদর বেড়েছিল, অর্থাৎ শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়েছিল।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল ১৫৮২ পয়েন্ট। এর পর হঠাৎ শেয়ারদরে উত্থানে মাত্র তিন সপ্তাহে ৫ ফেব্রুয়ারি সূচকটি ১৮৮৩ পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল। পরের দেড় মাসে শেয়ারের দরপতনে সূচক ১৭০০ পয়েন্টের নিচে নামে। ওই বছরের এপ্রিলের শেষ থেকে উত্থান শুরু হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ সময় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ে।
২০০৭ ও ২০০৮ সালের শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, সে সময়কার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় যেখানে শেয়ারবাজার সূচক ১৬০০ পয়েন্টের নিচে ছিল, এর দেড় বছর পর তা ৩১০০ পয়েন্ট পার করে। তবে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার পর তা কমে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সময় সূচক নেমে আসে ২৫০০ পয়েন্টে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ কৌশল
বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে শেয়ারবাজারে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে বিনিয়োগ করতে পছন্দ করেন। সরকার তার অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে দেখে বিনিয়োগকারীরা ধীরে হলেও সাড়া দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। কয়েক মাস আগেও যেখানে একদিনে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হতো, কত কয়েক সপ্তাহে তা বেড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ওঠানামা করতে দেখা যাচ্ছে।
শেয়ারবাজারে ভালো মুনাফা করার অন্যতম প্রধান উপায় হলো, অতীতের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করা। কৌশলী বিনিয়োগকারীরা বিশেষ প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারের পরিবর্তন দেখে নিজের বিনিয়োগ কৌশল ঠিক করেন।
মৌলিক বিশ্লেষণে গুরুত্ব
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা বের করার জন্য কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি মৌলিক বিনিয়োগ জ্ঞান থাকাও জরুরি। শেয়ার কেনার আগে যে কোম্পানির শেয়ার কিনতে যাচ্ছেন, তার ধারাবাহিক মুনাফা, কম ঋণবিশিষ্ট কোম্পানি, সুশাসন এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার সক্ষমতা কত, তা যাচাই করা প্রয়োজন। অতীতে দেখা গেছে, জল্পনা-কল্পনার ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাই গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ না করে, দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ নিয়ে বিনিয়োগ করা উচিত। শুধু একটি নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ না করে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে। পোর্টফোলিওতে নিম্নলিখিত উপাদানগুলোর ভারসাম্য রাখা উচিত।
সরকারের নীতিমালার দিকে নজর রাখুন
সরকারের নেওয়া নীতিমালা এ খাতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যেমন– ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, বাণিজ্য ও রপ্তানিনীতির পরিবর্তন, করনীতি ও বিনিয়োগবান্ধব আইন, শেয়ারবাজারের জন্য নতুন বিধিনিষেধ ইত্যাদি। এই নীতিগুলোর পরিবর্তন বাজারের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য ধরে সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। গুজবে কান না দিয়ে,
দীর্ঘমেয়াদি লাভজনক বিনিয়োগ কৌশল গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র র শ য় রব জ র শ য় রব জ র র র জন ত ক প ব ন য় গ কর সরক র র ন র পর র পর ব র র জন র সময় অবস থ গ রহণ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে স্ট্রবেরির নতুন জাত ফ্রিডম–২৪
জাপানি ‘নিওহো’ জাতের স্ট্রবেরির সঙ্গে আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল জাতের স্ট্রবেরির সংকরায়ণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী এই জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাপানি জাতটি খুবই ছোট কিন্তু সুগন্ধি ও মিষ্টি। আমেরিকান জাতটি আকারে বড় কিন্তু জাপানি জাতের মতো অতটা মিষ্টি নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন ১০ বছরের চেষ্টায় এই নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। চারা উৎপাদন, নির্বাচন, ট্রায়াল চাষ, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যাচাই করতে করতে তিনি ২০২৪ সালে এসে সফল হয়েছেন। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে জাতটির নাম রেখেছেন ফ্রিডম-২৪।
শীতপ্রধান দেশের আকর্ষণীয় ফল স্ট্রবেরির বাণিজ্যিক চাষ বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৭ সালে। নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এ দেশে স্ট্রবেরি চাষ একটি নির্দিষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষ চাষিরা সফলভাবে স্ট্রবেরি চাষ করছেন, যা উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে লাভজনক কৃষিতে জায়গা করে নিয়েছে। মানসম্মত চারা ও আধুনিক জাতের স্ট্রবেরির স্বল্পতার কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে এর চাষ সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না।
রাজশাহীতে অবস্থিত আকাফুজি অ্যাগ্রো টেকনোলজিস গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে স্ট্রবেরির এই আধুনিক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই জাত আগাম এবং উচ্চফলনশীল, আকারে বড়, দেখতে অনিন্দ্যসুন্দর, সুগন্ধযুক্ত, সুমিষ্ট ব্রিক্স-১২ (মিষ্টতা পরিমাপের একক)। মধ্য ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মার্চের শেষ পর্যন্ত এই ফল উৎপাদন করা যায়। এই ফল যথেষ্ট শক্ত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন ও বিপণন করা সম্ভব। সংকরায়িত অতি ক্ষুদ্র হাইব্রিড বীজ থেকে চারা উৎপাদন, নির্বাচন, ট্রায়াল চাষ, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যাচাইকরণ এবং সবশেষে বাণিজ্যিকভাবে চাষ উপযোগিতা পরীক্ষায় লেগেছে ১০ বছর।
গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, এই জাতের চারা রোপণের সময় অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর। ফল উৎপাদন শুরু হয় ডিসেম্বর ১৫ থেকে ২০ থেকে। ফল উৎপাদনকাল ১৫ ডিসেম্বর থেকে মার্চ ৩১। ফলের রং ও আকার উজ্জ্বল লাল, গড় ওজন ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম। প্রতি বিঘার ফলন হিসাব করা হয়েছে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ দশমিক ৫ টন। সংরক্ষণ সময় ৩ দিন (বিশেষ ব্যবস্থায় ৭ দিন), মিষ্টতার পরিমাণ ১২-১৪ ব্রিক্স। গাছের আকৃতি পাতা, বৃতি এবং ফুল—সবই বড়।
এম মনজুর হোসেন জানান, এই স্ট্রবেরি একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হবে। ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে এই স্ট্রবেরি আমদানির ব্যাপারে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার মাসকাটাদিঘি এলাকার স্ট্রবেরিচাষি ও ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল জাত চলে। নতুন এই জাতটি আকারে ফেস্টিভ্যালের চেয়ে অনেক বড়।’ আগামীবার তিনি এই জাত চাষ করবেন।
বাংলাদেশে মাত্র পাঁচটি ফসলের বীজ প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এই ফসলগুলো হচ্ছে ধান, পাট, গম, ভুট্টা ও আলু। অন্য ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করলে তা স্বীকৃতি নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। আর স্ট্রবেরি দেশীয় ফসল নয়। ২০০৭ সালে অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন বাংলাদেশে প্রথম চাষের উপযোগী স্ট্রবেরি জাত উদ্ভাবন করেন। এবার রাজশাহী নগরের চকপাড়া মহল্লায় ১২ কাঠা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেছেন। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। নগদে বিক্রি করেছেন ৬ লাখ টাকার বেশি। এখনো তাঁর মাঠে স্ট্রবেরি রয়েছে।