নিমাই দাঁড়ারে, তীর ভাঙা টেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, কালা আমায় পাগল করলি রে, কাওয়ায় কমলা খাইতে জানে না, মেরা জুতা হে জাপানি, ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে– কালের সাক্ষী হয়ে থাকা জনপ্রিয় এসব গান সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অহরহ শুনতে পেতাম অথবা দূরের কোনো গ্রাম থেকে গানের আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসত কানে। সেসব দিন কেবল আমাদের জীবন থেকেই হারিয়ে যায়নি; বরং হারিয়ে যেতে বসেছে এ গল্পগুলো। ইন্টারনেটের সাহায্যে ইউটিউব কিংবা গুগলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারণে গান শোনা অতি সহজ হয়েছে। অথচ কয়েক দশক আগেও গান শোনার প্রধান মাধ্যম ছিল মাইক। ছিল কলের গান নামক আরও একটি যন্ত্র; যা রেকর্ডের মাধ্যমে গান শোনা যেত। কলের গান এ দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। তবে কেউ কেউ সেই স্মৃতি ধারণ করে আছেন এখনও। এমন একজন ব্যক্তি যার নাম আব্দুল আলী। তিনি ঢাকা জেলার দোহারের ঘাটা গ্রামের কুটি ব্যাপারীর ছেলে। পেশায় একজন মাইক ব্যবসায়ী। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নিজেই আটকে গেছেন এক অন্ধপ্রেমে। অসংখ্য কলের গানের সংগ্রাহক তিনি। অন্তত ৭০টি রেকর্ডে ৫ শতাধিক গান রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। কলের গানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলেও ৬০ দশকের অনেক গান তিনি যত্নে রেখেছেন তাঁর শখের তালিকায়। এটি এখন তাঁর সুখস্মৃতি। মন চাইলেই তিনি এখনও কলের গান শোনেন। অন্যকে শোনান। কেউ কেউ কলের গান দেখতে আসেন তাঁর বাড়িতে। আব্দুল আলীর বয়স এখন ৭৮ বছর। অনেক স্মৃতি মনে করতে পারেন না; আবার যেগুলো মনে আছে, সে কথা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারেন না। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় যে পেশায় কাটিয়েছেন সে কথা বলতে তিনি উদগ্রীব! জীবন সায়াহ্নে এসে ফেলে আসা দিনগুলো মনে পড়তেই মুহূর্তেই জীবন রঙিন হয়ে ওঠে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম আব্দুল আলীর। যখন বাবা মারা যান তখন তাঁর বয়স ১৫। মা, দুই ভাই, দুই বোনের সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে।
ওই বয়সে উপার্জনের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। উপজেলার মধুরচর এলাকার পূর্ব পরিচিত আলেপ সরদারের সঙ্গে ধান কাটার আগের দিন বিকেলে তাদের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, ওই বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের জন্য মাইক ভাড়া করে আনা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও মাইক বাজাতে পারছেন না মাইকম্যান। তখন তিনি মাইক বাজানোর চেষ্টা করেন এবং হাতের স্পর্শে বেজে ওঠে! তখন আনন্দে ভরে যায় পুরো বাড়ি। ওইদিন খুশি হয়ে দুই পয়সা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয় তাঁকে। পরেরদিন ভোরে আলেপ সরদারের সঙ্গে ধান কাটার জন্য চলে যান ফরিদপুরে। দুই মাস ধান কাটার পর ফের বাড়িতে চলে আসেন। কিছুদিন অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজও করেন। নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় উপজেলার জয়পাড়া বাজারে বাদলের মাইকের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। একটা সময় নিজ বাড়িতে মাইকের দোকান দেন। একটি মাইক দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। নাম দেন বুলেট মাইক সার্ভিস। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্যবসা। আব্দুল আলীর শাশুড়ি জমি বিক্রি করে কিছু টাকা দিলে ১৬০ টাকা দিয়ে কলের গান কেনেন। মাইক এবং কলের গান ভাড়ায় দিয়ে আয় থেকে ভালোই চলছিল। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে এর ব্যবহার। একদিকে সংসারে ব্যয় বাড়তে থাকে এবং অন্যদিকে আয় কমতে থাকে। দুই মেয়েকে বিয়েও দেন। এক সময় মাইক ভাড়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েন তিনি। হারানো বিজ্ঞপ্তি ও ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো কাজে মাইকের ব্যবহার উঠে যাওয়ায় সীমিত আয় দিয়েই চলে আব্দুল আলীর সংসার।
আব্দুল আলী বলেন, ‘দোহার উপজেলায় সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেছি। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে আমার বাড়িতে আসত মাইক ভাড়ার জন্য। এখন তা কেবলই স্মৃতি। মাইকের দিন শেষ হওয়ায় ঘরেই পড়ে রয়েছে এসব। শখের কলের গানের সেটটি আছে। অনেকে কিনতে চেয়েছেন। বিক্রি করিনি। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। জীবিত থাকাকালে বিক্রি করব না। আমার মৃত্যুর পর কেউ যদি বিক্রি করে দেয় তখন আফসোস থাকবে না।’ v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কল র গ ন র জন য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
বিএমডিএর আরো ২ প্রকৌশলী সাময়িক বরখাস্ত, ব্যাখ্যা তলব
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক (ইডি) শফিকুল ইসলামকে জোরপূর্বক দপ্তর ছাড়তে বাধ্য করার ঘটনায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর আরো দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া, বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আছাদুজ্জামানের কাছে ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান স্বাক্ষরিত পৃথক অফিস আদেশে তাদের বরখাস্ত করা হয়।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রকৌশলীরা হলেন- নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ।
গত ২৩ মার্চের ওই ঘটনার দুইদিন পর অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় মামলা করেন। মামলায় এই দুই প্রকৌশলীসহ আরো কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মেহেদী, সহকারী মেকানিক মো. আপেল ও মেহেদী হাসান, গুদামরক্ষক মো. নুরুজ্জামান, মজিবুর রহমান, আব্দুল কাইয়ুম খান, ক্যাশিয়ার শফিকুল ইসলাম, গাড়িচালক মো. শাহাবুল, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শমসের আলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী তারিকুল ইসলাম। মামলায় ৫০-৬০ জনকে নাম না জানা আসামি করা হয়েছে।
রাজপাড়া থানার ওসি আশরাফুল ইসলাম জানান, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তারা আত্মগোপনে আছেন।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমাম। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আছেন উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান। বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম হীরক ও মো. জাফরুল্লাহ, জেলা প্রশাসনের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার জন্য গত বৃহস্পতিবার বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আছাদুজ্জামানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে তাকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জ রিজিয়নের দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু তিনি অনুমতি ছাড়া রাজশাহীতে চলে আসেন এবং অতিরিক্ত সচিবকে হেনস্তার ঘটনায় তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ইডি শফিকুল ইসলামকে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। তবে, রিলিজ অর্ডার না পাওয়ায় তিনি দপ্তর ছাড়তে পারেননি। ২৩ মার্চ দুপুরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে তার দপ্তরে প্রবেশ করে তাকে জোরপূর্বক বের করে দেন। তখন একটি চিঠি প্রস্তুত করা হয়, যাতে লেখা ছিল- শফিকুল ইসলাম দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এবং জাহাঙ্গীর আলম খান দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
শফিকুল ইসলাম মামলায় উল্লেখ করেছেন, তাকে এই চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।
এই ঘটনার পরপরই অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম কৃষি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন এবং ২৫ মার্চ রাজপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। তার অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের রিলিজ স্লিপ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি বিএমডিএতে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার নির্দেশনা পেয়েছিলেন। প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানের নেতৃত্বে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে দপ্তর ছাড়তে বাধ্য করেন।
বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম হীরক বলেন, “বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালকের পদটি প্রশাসন ক্যাডারের একজন অতিরিক্ত সচিবের জন্য সংরক্ষিত। শফিকুল ইসলাম বদলি হওয়ার পরও যদি তিনি দায়িত্বে থাকেন, সেটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তবে, একজন কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক দপ্তর ছাড়তে বাধ্য করা এবং চেয়ার দখল করা গুরুতর অপরাধ।”
তিনি আরো বলেন, “মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তদন্তের মাধ্যমে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করছি।”
ঢাকা/কেয়া/মাসুদ