বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বয়সকালের প্রতি দু’জন মেয়ের মধ্যে একজনকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক প্রতিবেদনে। সে প্রতিবেদনের উপাত্ত বলে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে বাল্যবিয়ের আপাতন ছিল ৫১ শতাংশ; প্রতি ২ জনে ১ জন। আসলে ১৮ বছরের আগে যে কোনো বালিকাই অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুও বটে। সুতরাং এ উপাত্ত সত্যিকার অর্থে শিশুবিয়ের তথ্যবাহীও বটে। 

কিন্তু উপর্যুক্ত সামগ্রিক তথ্যের পরতে পরতে আরও তথ্য আছে। যেমন মেয়েদের বাল্যবিয়েতে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম। বাল্যবিয়ের সঙ্গে বাল্যগর্ভধারণের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ১৮ বছরে পৌঁছুবার আগে ২৪ শতাংশ মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। গত বছর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সকালের মধ্যকার কিশোরীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ মেয়ে সঙ্গীসম্পৃক্ত শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার।

প্রায় ৫৩ শতাংশ কিশোরীরই তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের কিশোরদের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক কিশোরী শিক্ষা বলয় থেকে ঝরে পড়ে। বাংলাদেশে ২ শতাংশেরও কম কিশোরীর তথ্যপ্রযুক্তি-সাক্ষরতা আছে। 
বাল্যবিয়ের কুফল সর্বজনবিদিত। প্রথমত, বিয়ে এবং সন্তান ধারণের জন্য যে শারীরিক পরিপক্বতা প্রয়োজন, একজন কিশোরীর তা থাকে না। ফলে অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে একজন কিশোরী বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। ভগ্নস্বাস্থ্য, হ্রস্ব আয়ু সেই স্বাস্থ্যঝুঁকির অংশ। সেই সঙ্গে কিশোরীটি মা হলে তার সন্তানও যেমন ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে জন্মাতে পারে, তেমনি শিশুকে যথাযথভাবে বড় করার মতো প্রাজ্ঞতা একজন কিশোরী মায়ের থাকে না। 

একইভাবে বাল্যবিয়ের কারণে বহু বালিকার শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়। বহু মেধাবী এবং শিক্ষায় উৎসাহী মেয়েকে বিয়ের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। শিক্ষা একটি সম্ভাবনাময় জীবনের পথ তৈরি করে দেয়। সেই পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে সে সম্ভাবনাও অপসৃত হয়। মায়ের শিক্ষার ঘাটতির একটি আন্তঃপ্রাজন্মিক প্রভাবও আছে। একজন শিক্ষিত মা সন্তানের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। শিক্ষার সুযোগ নষ্ট হওয়া বাল্যবিয়ের একজন মা সে কাজটি করতে পারে না।

অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েরা তাদের স্বাধিকার, কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামত প্রকাশে অনেক সময়েই দ্বিধাগ্রস্ত হয় শুধু বয়সের কারণে। অল্পবয়স্ক বলে ঘরের মধ্যে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বহু সময়ে দেখা গেছে, তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সিদ্ধান্তের ওপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে বড় সীমিত। সবটা মিলিয়ে মেয়েদের জন্য বহু ক্ষেত্রেই বাল্যবিয়ে হচ্ছে সক্ষমতার বিলুপ্তি এবং সম্ভাবনার অপমৃত্যু।

এত নেতিবাচক বিষয়ের অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এবং এটি বন্ধের ব্যাপারে প্রতিরোধক আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কেন হয়?
এর প্রথম কারণটি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের জীবনের বহু বাস্তবতাই নির্ণীত হয় পুরুষের চিন্তা ও কর্মকাণ্ড দিয়ে। বাল্যবিয়েও তেমন এক ঘটনা। বিভিন্ন পারিবারিক আবেষ্টনীতে পুরুষরা যদি মনে করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, কিশোরী সময়টাই হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের যথার্থ সময়, তবে সেটিই মেয়েদের জন্যে একটি সামাজিক মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক দারিদ্র্যও বাল্যবিয়েকে উদ্বুদ্ধ করে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনিক গৃহস্থালির তুলনায় সমাজের নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ। দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বঞ্চনার ভঙ্গুরতার কারণে বহু পরিবার মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। এটিও দেখা গেছে, বাংলাদেশের যে সব জেলায় দারিদ্র্যের আপাতন বেশি, সেখানে মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার বেশি। বহু পরিবার যেখানে মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না কিংবা দারিদ্র্যচক্র থেকে বেরুনোর কোনো সুযোগ তারা দেখতে পায় না, তখন মেয়েদের বিয়ে দেওয়াই একটি বাস্তব পথ বলে তারা মনে করে। ভাবনাটা এমন– মেয়েটির ভার পরিবারের কাঁধ থেকে নেমে গেল।

সমাজে শান্তিশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি, আইনকানুনের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতার কারণেও মেয়েকে দ্রুত পরের ঘরে পাঠানোর একটা তাগিদ থাকে। উদ্দেশ্যটা যেন, যত তাড়াতাড়ি মেয়ের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়।

মনে করা হয়, অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মেয়েদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আগেভাগেই তাদের বিয়ে দেওয়া নিরাপদ। আসলে রাষ্ট্র বহু ক্ষেত্রেই নারীর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সময়ে ঘটে চলা ব্যাপক ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতাই তার 
বড় প্রমাণ। 

এ সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাল্যবিয়ে রোধে কী কী করা যেতে পারে?
এসব ব্যবস্থার কিছু আইনগত মাত্রিকতা, কিছু সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ, কিছু আর্থসামাজিক নীতিমালার। কিন্তু বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে রোধে এর মূল কারণগুলো মোকাবিলায় নানান ব্যবস্থার সমন্বয়ে একটা যৌথ সমন্বিত কৌশল ব্যবহার করতে হবে।
সামাজিক মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি অতি অল্প সময়ে বা তাৎক্ষকণিক বদলানো যাবে না। এ জন্য তৃণমূলে কাজ করতে হবে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারের মাধ্যমে; বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা এবং বিনোদন-মাধ্যমের ব্যক্তিত্বদের। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, সচল চিত্র, চিত্রপ্রদর্শনী, নাটিকা, পুতুলনাচও এ ব্যাপারে বিরাট অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে পারে। 

বাল্যবিয়ে রোধে আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী, আইনের ফাঁক-ফোকর বন্ধ এবং বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের ২০১৭ সালের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইন সর্বজনীনভাবে নিন্দিত হয়েছে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ বাল্যবিয়েকে অনুমোদন করায়। আইনের ত্রুটির সুযোগ নিয়ে নানান জায়গায় বাল্যবিয়ে হয়েছে। এর আইনগত কাঠামো পরিমার্জন জরুরি। 
মেয়েদের শিক্ষা বাল্যবিয়ে রোধে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষিত মেয়েরাই তাদের বিয়েকে বিলম্বিত করতে পারে। তারা অল্পসংখ্যক শিশুধারণের সিদ্ধান্ত নিতে এবং ইতিবাচক স্বাস্থ্য ফলাফলের অধিকারী হতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি অত্যন্ত জোরালো পন্থা। নারীর শিক্ষা, বিশেষত কারিগরি শিক্ষা তাদের কর্মনিয়োজন মেয়েদের সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সহায়ক হতে পারে। 
অনেক ক্ষেত্রেই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনে পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এটা গুরুতর ভুল। এ আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে পুরুষকেও সহযাত্রী হিসেবে পেতে হবে। যেহেতু নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা পুরুষের কর্মকাণ্ড দিয়ে নির্ণীত হয়, তাই বাংলাদেশে মেয়েদের বাল্যবিয়ে রোধের সংগ্রামে পুরুষের সম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষি পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন, হয়েছেন দেশসেরা কৃষক

চৈত্রের দুপুরে খর রোদে যেন আরও শীর্ণ হয়েছে ফরিদপুর শহরের কুমার নদ। তাপ উঠে আসছে মাটি থেকেও। শহরের অম্বিকাপুরের আলো–হাওয়ায় পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের কলমে উঠে এসেছিল ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’–এর মতো সাহিত্যগাথা। ২ এপ্রিল দুপুরে প্রখর রোদের ভেতর গিয়ে দেখা গেল, পল্লিকবির বাড়ির কাছে অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে যেন আরেক ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ বানিয়েছেন কৃষক সাহিদা বেগম।

সাহিদা মাঠজুড়ে ফলিয়েছেন ‘কালো সোনা’ বলে পরিচিত পেঁয়াজের দানা। কদমের মতো সাদা কেশরের ফুল ফুটে আছে সেখানে। মৌমাছি কমেছে বলে আশপাশে রয়েছে হলদে রঙের ‘হরপা’ নামের একধরনের ফুল গাছ। ওই দিন দুপুরে চড়া রোদে মাঠে ফসলের তদারক করছিলেন সাহিদা। তিনি ফরিদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় উন্নত জাতের পেঁয়াজবীজ উৎপাদন করে পরিচিতি পেয়েছেন।

সাহিদা বললেন, ‘পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে গেলে ঝরে পড়ে কালো দানা কিংবা বা বীজ। এ বীজের দাম অনেক। ফুলগুলো বড় করতে হয় অনেক ধৈর্য নিয়ে।’ তিনি জানান, মাঠ থেকে তুলে নিয়ে শুকিয়ে মলন দিয়ে বের করতে হয় সেই কালো সোনা। এ কাজে ঝুঁকি অনেক। কারণ, কয়েক মাস ধরে মাঠে বড় করতে হয়। বৃষ্টিপাত, গরম—সবকিছু প্রভাব ফেলে উৎপাদনে। যদিও এখানে যত ঝুঁকি, তত লাভ।

পরিশ্রমী সাহিদা দেশসেরা নারী কৃষকদের একজন। ২০০৪ সালে মাত্র ২০ শতাংশ জায়গায় তিনি চাষাবাদ শুরু করেছিলেন। এ বছর তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ১০ হাজার শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছেন।

প্রতিদিন সাহিদার কাজকর্ম শুরু হয় ভোরে। পরিবারের সদস্যসহ কৃষিশ্রমিকদের জন্য নিজে রান্না করেন। সকালের খাবার খেয়ে চলে যান খেতে। জমিতে কাজের তদারক করেন। সেখানেই বিকেল গড়ায়। কোনো এক ফাঁকে হয়তো বাসায় ফেরেন। কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে বসে যান থালা হাতে, দুপুরের খাবার নিয়ে।কাজ শুরু করেন ভোরে

প্রতিদিন সাহিদার কাজকর্ম শুরু হয় ভোরে। পরিবারের সদস্যসহ কৃষিশ্রমিকদের জন্য নিজে রান্না করেন। সকালের খাবার খেয়ে চলে যান খেতে। জমিতে কাজের তদারক করেন। সেখানেই বিকেল গড়ায়। কোনো এক ফাঁকে হয়তো বাসায় ফেরেন। কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে বসে যান থালা হাতে, দুপুরের খাবার নিয়ে।

অথচ শুরুটা ছিল অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতার প্রত্যাশায়। এখন পেঁয়াজ তোলার সময় সাহিদার ফসলের মাঠে কাজ করে তিন শর বেশি শ্রমিক। মৌসুম ছাড়াও রোজ থাকেন ৫০ থেকে ৬০ জন করে। তাই সাহিদাকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও চেনে মানুষ।

নিজের ফসলের খেতে নারী কৃষক সাহিদা বেগম

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ক্ষমতার প্রথম ১০০ দিনে ট্রাম্পের যত আলোচিত উক্তি
  • আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি গোলরক্ষক হুগো গাত্তি আর নেই
  • ‘বিসিবি আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে’
  • শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ কতটা যৌক্তিক
  • প্রাণনাশের ভয় নিয়ে পালাতে হয়েছিল, দাবি হাথুরুসিংহের
  • খাল–নালায় পড়ে মৃত্যুর দায় নেয় না, তদন্তও করে না
  • ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
  • নোয়াখালীতে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টি 
  • নাটোরের শিশুর লাশ উদ্ধারের মামলায় পাঁচ কিশোর আটক
  • কৃষি পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন, হয়েছেন দেশসেরা কৃষক