সম্প্রতি অধিকারকর্মীরা তাদের নৈতিক ও ন্যায্য দাবি জানাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে গেলে পুলিশ বাধা দেয়; এক পর্যায়ে সংঘাতে উভয় পক্ষের লোকজন আহত হয়। এ অবস্থাই চলে আসছে। কিন্তু এর পরিবর্তন কি অসম্ভব? নাগরিকরা রাস্তায় নামার আগে সরকারের সংস্থাগুলো কেন ব্যবস্থা নেয়নি– এ প্রশ্ন তোলা জরুরি।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭-এ বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
এদিকে পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি স্থান পর্যন্ত কোনো সমাবেশ বা লোকসমাগম হলে তা ভেঙে দেওয়া বা বল প্রয়োগের দায়িত্ব হয়তো পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাগরিক কোনো দাবি করলে কোনো কর্মকর্তার সেই দাবি গ্রহণ এবং বিধিবদ্ধ আইন অনুসারে উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাদের সরকারের দায়িত্বে পাঠানো হয়, তারা জনপ্রতিনিধি না হয়ে কর্মকর্তাদের মুখপাত্র হয়ে যান। মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কতিপয় কর্মকর্তা যা তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেন, তারা তা-ই বলেন। নাগরিকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করলে বা কোনো একটি বিষয় সংঘাতের দিকে না গেলে সচরাচর মন্ত্রী/উপদেষ্টা শুনতে পারেন না বা শোনেন না।
নাগরিকদের কেন রাস্তায় নামতে হয়– এ নিয়ে কিছু বাস্তবিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ঢাকার মাঠগুলো ক্লাবের নামে দখল করে নিচ্ছে। গুলশানের শহীদ তাজউদ্দীন পার্ক ও সঙ্গের মাঠটি দীর্ঘদিন একটি ক্লাবের দখলেই আছে এক প্রকার। গত বছর ক্লাবটি মাস্টারপ্ল্যান ও আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে মাঠে ফুটবল টার্ফ বানানো শুরু করে। পরিবেশবাদীরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রেস রিলিজ, চিঠি এবং একটি ক্লাবের মাঠে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে দেখা যায়, আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে উত্তর সিটি করপোরেশন তাদের অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের এ ধরনের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে সরকারের সব মহলে চিঠি দেওয়া ও প্রেস কনফারেন্স করা হয়। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর বা প্রতিকার করা হয়নি।
কয়েক মাস আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে আবার চিঠি দেওয়া হলো; উপদেষ্টা, প্রশাসকদের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ দেওয়া হলো। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। কয়েক মাস আগে উত্তর সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, আগামীকাল আপনার প্রতিষ্ঠানের সামনে একটি মানববন্ধন করা হবে এবং এখান থেকে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে। আপনাদের একজন প্রতিনিধিকে এ স্মারকলিপি গ্রহণ করার অনুরোধ করছি। মানববন্ধন শেষে পরিবেশবাদীরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এক ঘণ্টা বসে থাকলেও কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। তথ্য অধিকার আইন, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার (জিআরএস) এ অভিযোগ দিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি। এ অবস্থায় একজন নাগরিক রাস্তায় নামা ছাড়া আর কী করতে পারে!
পরিবেশ আইন, আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ‘পান্থকুঞ্জ-হাতিরঝিল ধ্বংস করে’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবিতে ৯৪ দিন ধরে পার্কে অবস্থান করছেন পরিবেশবাদীরা। অহিংস ও নৈতিক এ আন্দোলনে আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশা বা অঙ্গীকার করা হয়নি। রাস্তায় নেমে ব্লক, ঘেরাও বা অন্য কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটালে সরকারের দপ্তরগুলো কি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না?
ঢাকার রাস্তায় প্রতিনিয়ত নাগরিক সমাবেশ হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন বা কর্মসূচির ভিড়ে এসব সমাবেশ সংবাদপত্র, গোয়েন্দা সংস্থা কারও কাছেই হয়তো গুরুত্ব পায় না। নাগরিক দাবির এসব সংবাদ হয়তো সরকারের উচ্চ মহলে গুরুত্ব পায় না। এসব উপায় না দেখেই নাগরিকদের রাস্তায় নামতে হয়।
একটি কঠিন সত্য হচ্ছে, আমরা যেসব জনপ্রতিনিধিকে জনগণের কথা বলতে বা শুনতে পাঠাই, তারা চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কিছু আমলার মুখপাত্র হয়ে যান। প্রটোকলের নামে তারা সেটাই বলেন, যা তাদের কর্মকর্তারা শেখান; আর তাই শোনেন, যা তাদের শোনানো হয়। নাগরিকের দাবি, অধিকারকর্মী, সমাজকর্মীদের তারা শক্র বা বিরোধী ভাবতে থাকেন। একদিন যারা নাগরিক আন্দোলনে সহযোদ্ধা ছিলেন; ছিলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতা; চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে তারা কেমন যেন অচেনা হয়ে যান!
নাগরিকদের দাবি আর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার। সরকারের তথ্য অধিকার আইন, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (জিআরএস) রয়েছে। এসব ব্যবস্থাকে কার্যকর করা দরকার। কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটলে সরকারের দপ্তরগুলো যদি নাগরিক আন্দোলন বা দাবিকে গুরুত্ব না দেয়, তবে সহিংস ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এ অবস্থা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সরকারের দপ্তরগুলো এই নিরুত্তর নাগরিকদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। পুলিশের সঙ্গে নাগরিকদের সংঘাত হয়; পুলিশকে সবাই দোষারোপ করে। অথচ সরকারের দপ্তরগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে যে নাগরিকদের রাস্তায় নামতে হয়েছে, এ বিষয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম: আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক
syedmahbubul@gmal.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স ত য় ন মত সরক র র দ কর মকর ত ব যবস থ উপদ ষ ট পর ব শ অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
সাতক্ষীরায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৫ গ্রাম প্লাবিত
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচটি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কয়েক শত মৎস্য ঘের পানিতে ভেসে গেছে।
হঠাৎ করে বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঈদের আনন্দ গ্রামবাসীর নিরানন্দে পরিণত হয়েছে। গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে ভাঙন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়।
সোমবার (৩১ মার্চ) বেলা সাড়ে ৯টার দিকে আশাশুনি উপজেলার বিছট গ্রামের আব্দুর রহিম সরদারের ঘেরের বাসার কাছ থেকে প্রায় দেড়শত ফুট বেড়িবাঁধ হঠাৎ করে খোলপেটুয়া নদীরগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
আরো পড়ুন:
গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন: ভারত যাচ্ছে বাংলাদেশের দল
সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ৪৫ ভাগ শেষ হয়নি
বিছট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, সকালে তারা ঈদের নামাজ আদায়ে ব্যস্ত ছিলেন। নামাজ শেষে জানতে পারেন, প্রায় দেড়শত ফুট বেড়িবাঁধ হঠাৎ করে খোলপেটুয়া নদীরগর্ভে ধসে পড়েছে। বিষয়টি গ্রামের মসজিদের মাইকে প্রচার করে দ্রুত লোকজনকে ভাঙন পয়েন্টে যেতে বলা হয়। গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ভাঙন পয়েন্টে একটি বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করে। দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। সাড়ে ১১টার দিকে প্রবল জোয়ারের তোড়ে বাধের অবশিষ্টাংশ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে।
স্থানীয়রা জানান, ইতোমধ্যে বিছট, বল্লবপুর, নয়াখালী, আনুলিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকেছে। শত শত মৎস্য খামার ভেসে গেছে। দ্রুততম সময়ে বাঁধ বাধতে না পারলে পার্শ্ববর্তী খাজরা ও বড়দল ইউনিয়নও প্লাবিত হতে পারে।
স্থানীয় আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিছট গ্রামে বেড়িবাঁধ ভাঙনের খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। বেড়িবাঁধের প্রায় দেড়শত ফুট নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিষয়টি আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীকে হয়েছে। পাউবোর লোকজন ঈদের ছুটিতে। তারা ফেরার চেষ্টা করছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবে) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, বেড়িবাঁধে ভাঙনের খবর পেয়ে কর্মকর্তাদের সেখানে পাঠানো হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।
ঢাকা/শাহীন/বকুল