‘অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ল্যাঙ্গুয়েজেস ইন ডেনজার অব ডিজঅ্যাপিয়ারিং’ নামে ভাষাবিষয়ক বিশ্বকোষ থেকে জানা যায়, বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ৬ হাজার ৮০৯টি ভাষার অস্তিত্ব আছে, যেসব ভাষায় কিছু না কিছু মানুষ কথা বলে। কিন্তু আগামী ৫০ বছরে সেসব ভাষা কমপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক হয়ে যাবে, নয়তো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। ইউনেস্কোর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৯৯ সালের মধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে প্রায় তিন হাজার ভাষা। অর্থাৎ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এসব সংস্কৃতি। বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী মাইকেল ক্রাউসের মতে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ ভাষাই মরে যাবে। এখন যেসব ভাষাকে কার্যকর বলে ধারণা করা হয়, তার মধ্যে ২০ থেকে ৮০ শতাংশই আসলে মৃত। এসব ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। অচিরেই তাতে কথা বলে, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। ৩৫৭টি ভাষা রয়েছে, যাতে কথা বলে এমন লোকের সংখ্যা মাত্র ৫০। ৪৬টি ভাষা আছে, যাতে কথা বলে মোটে একজন মানুষ। তারা মরে গেলে ভাষাও মরে যাবে। বর্তমানে প্রচলিত
এই ভাষাগুলোর প্রতিটিই কোনো না কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর কাছে তার মাতৃভাষা প্রবল ভাবাবেগ আর ভালোবাসার সমার্থক ধ্বনি। কবির ভাষায়, ‘যারে যেই ভাষায় করিলে সৃজন, সেই ভাষা তার অমূল্য ধন’। সেই অমূল্য ধন হারাতে বসেছে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ।
এত কিছুর পরও পৃথিবীকে উদ্দীপ্ত করার ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশেই। মাতৃভাষা ঘিরে আমাদের যে আবেগ ও ভালোবাসা, তার তীব্রতার কারণেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে।
একুশের চেতনার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ইউনেস্কো এদিন অমর একুশকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাঙালি জাতি এর মধ্য দিয়ে মাতৃভাষায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াকু মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বুকে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে। ইউনেস্কো সারাবিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বেছে নিয়েছে এমন একটি দিন। এই দিনটি নিজ নিজ মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানানো; ভালোবাসা আর সবকিছু উজাড় করে মাতৃভাষা রক্ষা করার এক অফুরন্ত প্রেরণার নাম। ভাষার প্রশ্নে এই স্বীকৃতির সত্যিকার মানে হলো, পৃথিবীর সব মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অতীব জরুরি। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ভাষা-স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই উপলক্ষ তৈরি করেছি আমরাই। এত কিছুর পরও কি আমাদের গৌরবগাথাকে ম্লান করে দিচ্ছি না? সংখ্যালঘুর ভাষার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা থেকে কি আমরা সরে আসতে পেরেছি?
এ দেশের পাহাড় থেকে সমতলে ৪৫টি জাতিগোষ্ঠীর বাস। সংখ্যায় এরা প্রায় ২৫ লাখ। নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ধারক এসব জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, ভাওয়াল মধুপুর গড়, গারো পাহাড় ও বরেন্দ্রভূমিতে তাদের নিজস্ব জীবনধারা নিয়ে বসবাস করছে। প্রকৃতিপ্রেমী এসব মানুষের জীবনের সঙ্গে তাই মিশে আছে বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত। অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অবন্ধুসুলভ আচরণ শুধু নয়, আগ্রাসী মনোভাবে আজ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার পথে। এতদিন তারা জল, জমি ও জঙ্গলের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছে, এখন তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিশেষ করে তারা এই স্বাধীন দেশে পরাধীন জাতির মতো মাতৃভাষায় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে। একসময় ভাষার অধিকারবঞ্চিত বাঙালিরাই যদি আজ অন্য ভাষার প্রতি আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে!
বিশ্বের প্রত্যেক শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার জন্মগত। জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দশকের কার্যক্রমের বিশেষ বিষয় হলো শিক্ষা। আইএলও কনভেনশন ১০৭-এ আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং এই কনভেনশন বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিতে পাহাড়ি শিশুদের জন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় পড়াশোনার কথা বলা হয়েছিল। আবার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, শুধু প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে এসব শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করলে চলবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীভুক্ত ভাষাগুলোকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারও গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিচর্যা কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে হলেও এই ভাষাকে কার্যকরী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাহলেই কেবল আদিবাসী ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটবে। তাদের মধ্যে সমনাগরিকত্ববোধ গড়ে উঠবে; রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে উৎসাহিত হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালির সংস্কৃতি আত্মকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। বহুজাতি, বহুভাষী ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় গৌরবগাথা। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতাধারীরা সবসময় বাংলাদেশের ভিন্নভাষী নাগরিকদের উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। তার দায়ভার আমরাও এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা সবাই মিলে আমাদের জাতি-বৈচিত্র্যকে সুন্দর আলোকিত এক সকালের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারি। এর মাধ্যমে শুধু মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং জাতি হিসেবেও আমরা সম্মানিত হতে পারি। গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমান্বিত করে তুলতে পারি বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। একুশ শতকে এসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
মনজুর রশীদ: লেখক ও গবেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ সব ভ ষ আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
দীর্ঘদিন আত্মগোপনে, চাঁদরাতে বাড়িতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ছিলেন আত্মগোপনে। কিন্তু পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করার জন্য গ্রামের বাড়িতে আসেন। গ্রামের বাড়িতে এসেই স্থানীয়দের হাতে গণপিটুনির শিকার হলেন এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা।
রোববার রাতে ওই স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
গণপিটুনির শিকার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার নাম মো. জসিম উদ্দিন জিসান (৩৬)। তিনি সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কান্তার পাড়ার আহমদ নবীর ছেলে। এ ছাড়াও তিনি উত্তর সাতকানিয়া সাংগঠনিক উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মো. জসিম উদ্দিন জিসান আত্মগোপনে থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিপক্ষে পোস্ট দিতেন। ফলে স্থানীয়রা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। সর্বশেষ রোববার ঈদ উদযাপনের জন্য তিনি গ্রামের বাড়িতে আসেন। তার আসার খবর পেয়ে স্থানীয়রা তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয়।
বর্তমানে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন।
আরও জানা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে উপজেলার কেরানিহাট চত্বরে মিছিল করেছিল ছাত্র-জনতা। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কেঁওচিয়া ইউনিয়নের জনার কেঁওচিয়া গ্রামের গুরা মিয়া বাড়ির মৃত ছিদ্দিকুর রহমানের ছেলে মো. তসলিম বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় জিসান ৫৮ নম্বর এজহারভুক্ত আসামি।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম জানান, ৫ আগষ্টের পর থেকে জিসান ঘরে ছিল না। চাঁদ রাতে পরিবারের সদস্যদের জামা-কাপড় দিতে গেলে এলাকার লোকজন তাকে ধরে পিটুনি দেয়। খবর পেয়ে আমিসহ পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে গেলে তার স্বজনরা চিকিৎসার জন্য তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যায় বলে জেনেছি। এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ বা মামলা করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।