প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনে দেশে এসেছে ২৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে কোনো একক মাসে দেশে এত প্রবাসী আয় আসেনি। প্রবাসী আয়ের রেকর্ডের এই হিসাব গত বুধবার পর্যন্ত। এরপরের কয়েক দিনের প্রবাসী আয়ের হিসাব যুক্ত হলে মার্চ শেষে প্রবাসী আয় ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মার্চের শুরু থেকে প্রবাসী আয়ের যে ধারা, সেটিকে বিবেচনায় নিলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় মাস শেষে চূড়ান্ত হিসাবে তা ৩০০ কোটি বা ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। সেটি হলে দেশের ইতিহাসে প্রবাসী আয় ৩০০ কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছাবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৫২ কোটি ডলার। মার্চে প্রতিদিন গড়ে ১১ কোটি ৩২ লাখ ডলার করে প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রবাসী আয়ের এই প্রবাহ ধরে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। এ জন্য বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসার বাধাগুলো দূর করতে হবে। সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম ঈদ সমাগত। এই ঈদ সামনে রেখে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা বৈধ পথে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রবাসী আয় দেশে পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকাররা বলছেন, মূলত অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় প্রবাসীরা তাঁদের আয় পাঠাতে বৈধ পথকে বেছে নিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ, ডলারের বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেন ভারসাম্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক চলতি ও আর্থিক হিসাবেরও উন্নতি হয়েছে।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান। তাঁরা বলছেন, ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা কমেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাসী আয় কিনছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী আয়ের গতিধারা অত্যন্ত ইতিবাচক। প্রবাসী আয় বেশি আসায় রিজার্ভের পতনের ধারা ঠেকানো গেছে। তবে রিজার্ভ এখনো স্বস্তির জায়গায় নেই। প্রবাসী আয়ের এই প্রবাহ ধরে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। ঈদের পরও যেন বর্তমান ধারা ঠিক থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসার বাধাগুলো দূর করতে হবে।

মার্চ মাসের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৬ কোটি ডলার। চার দিন পর অর্থাৎ ১৯ মার্চ ব্যাংকিং চ্যানেল তথা বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় দাঁড়ায় ২২৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে শুধু ১৯ মার্চ এক দিনেই এসেছে ১৩ কোটি ডলার। আবার ১ থেকে ২২ মার্চ তথা মাসের প্রথম ২২ দিনে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪৩ কোটি ডলার, যা ২৪ মার্চ বেড়ে ২৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। আর ২৬ দিনে আয় বেড়ে হয় ২৯৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ১১ কোটি ও দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়ে ১২ কোটি ডলার করে প্রবাসী আয় দেশে এসেছে।

সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসী আয় বছরের অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি আসে। গত বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে পাঁচ দিনেই ৪৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৯ কোটি ডলার করে এসেছিল। পরের চার দিনে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো আরও বাড়িয়ে দেন।

চলতি মার্চের প্রথম ২৬ দিনে যে প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩৩ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে ৮২ শতাংশ বেশি। গত বছরের মার্চের প্রথম ২৬ দিনে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৬১ কোটি ডলার।

আগস্টের পর প্রবাসী আয় বেড়েছে

দেশে গত বছরের আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সাত মাস ধরে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আয় পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন প্রায় ২৫৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। এ বছরের জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাসী আয় ৩ শতাংশ বেশি আসে।

সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রবাসীরা দেশে ১ হাজার ৮৪৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার।

গত ৬৯ মাসের চিত্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যভান্ডার ঘেঁটে গত ৫ বছর ৯ মাসের মাসওয়ারি প্রবাসী আয়ের চিত্র পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা গেছে, চলতি মার্চ মাসেই সর্বোচ্চ ২৯৪ কোটি ডলার এসেছে। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ২৬৩ কোটি ডলার এসেছিল। ২০১৯-২০ সালের পর মোট ২৪ মাস ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা করে প্রবাসী আয়ের ডলার কেনা এখন অনেকটা কমেছে। এর ফলে ডলারের দাম ১২৩ টাকার মধ্যেই রয়েছে। এতে পণ্য আমদানিতেও ডলারের দাম কম পড়ছে। ফলে আমদানি খাদ্যপণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। আগে একসময় প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

প্রবাসে কর্মী যাওয়া বেড়েছে কি

সরকারি সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ২০ বছরে বিদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ২০২৩ সালে। ওই বছর দেশ থেকে ১৩ লাখের বেশি কর্মী কাজের সন্ধানে বিদেশে গেছেন। এই ২০ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী বিদেশে গেছেন ২০২২ সালে। ওই বছর ১১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কর্মসংস্থানের আশায়। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০ লাখের বেশি কর্মী গেছেন গত বছর। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বিদেশে কর্মী গেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিদেশে যেসব কর্মী গেছেন, তাঁদের বড় অংশই এখন দেশে আয় পাঠাতে শুরু করেছে। এ কারণে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

হুন্ডি ও অর্থ পাচার বন্ধের প্রভাব কী

গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থ পাচার ও হুন্ডি কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এ কারণে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের বাজারের অস্থিতিশীলতাও কমে গেছে। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রবাসী আয়ের উৎস দেশের ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পারছি। মধ্যপ্রাচ্যের বদলে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। উৎস দেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এই পরিবর্তনের বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। তবে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ক্ষেত্রে আমরা কয়েক মাস ধরে স্থিতিশীলতা দেখতে পাচ্ছি, এটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। সাধারণত ঈদের আগে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়। তার সঙ্গে এখন অর্থ পাচার ও হুন্ডির চাহিদা কিছুটা কম থাকায় বৈধ পথে আয় আসা বেড়ে থাকতে পারে।’

রিজার্ভ ও লেনদেন ভারসাম্যে প্রভাব

এদিকে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ পরিস্থিতির মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। যদিও এ সময়ে আমদানি বেড়েছে। বাড়তি এই আমদানির জন্য ডলার জোগান দেওয়ার পরও গত মঙ্গলবার দিন শেষে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের ওপরে রয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেন ভারসাম্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক চলতি ও আর্থিক হিসাবের উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক হিসাব ইতিবাচক ধারায় আছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫৬ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারি শেষে সেটি ১৪২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে চলতি হিসাবে ৪০৭ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সেই ঘাটতি কমে ১২৭ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বছর র একই সময় র আর থ ক হ স ব ম স র প রথম গত বছর র আয় ব দ ধ র প রব স প রব স র ব ধ পথ ২৬ দ ন আমদ ন বলছ ন আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

বাড়ছে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যের উৎপাদন

আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল বেশি। চাহিদার বাড়তি আলু রপ্তানি হতো বিশ্বের ১৬টি দেশে। তিন বছর আগে দুই লাখ টন আলু রপ্তানির রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। আলু রপ্তানির এসব গল্প ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে যায়। কারণ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাহিদা মেটাতে প্রথমবারের মতো ৯৮ হাজার ৭৩১ টন আলু আমদানি হয়। শুধু আলু নয়, কাঁচামরিচ, টমেটো, গাজর, পেঁয়াজ, সবজিসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য গত দেড় দশকে ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর হয়ে যায়। কমে রপ্তানি। তবে এবার আলুর এত বাম্পার ফলন হয়েছে যে, হিমাগারে রাখার জায়গা নেই। এতে কৃষক দুর্ভোগে পড়লেও ভোক্তা আছেন স্বস্তিতে। বাজারে আলুর দাম কমার কারণে বাড়ছে রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ২৪ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এটি গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গত ফেব্রুয়ারিতে  প্রায় ১২ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের মোট রপ্তানির সমান।

অন্যদিকে পেঁয়াজে দীর্ঘদিনের ভারতনির্ভরতা কমতে শুরু করেছে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এবার যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে, তাতে কৃষক ন্যায্য মূল্য পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশে বছরে শস্যটির চাহিদা ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ টন। এবার চাহিদার চেয়ে এটি বেশি উৎপাদনের আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
শুধু আলু, পেঁয়াজ নয় সবজি উৎপাদনে এবার রেকর্ড ফলনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এবারের রোজা স্বস্তিতে কাটিয়েছেন ভোক্তা। এ বাস্তবতার বিপরীতে রপ্তানিতে আশা জাগাচ্ছে কৃষিপণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ বেশি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। কৃষি মন্ত্রণালয় এখন আমদানিনির্ভর ফসল উৎপাদন বাড়াতে জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে তেল, দানা ও মসলাজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা।

মসলাজাতীয় ফসল
দেশে হলুদ, মরিচ, মৌরি, মেথি, কালিজিরা, তেজপাতা, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, সরিষা, ধনিয়াসহ অধিকাংশ গরম মসলার বাজার আমদানিনির্ভর। ফলে আমদানি স্বাভাবিক না থাকলে দেশের বাজারে পণ্যগুলোর দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিশ্বের ১০৯ ধরনের মসলার মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে ৪৪টি। দেশে চাষ হচ্ছে মাত্র ৩৪টি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মসলা ফসলের উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি ব্যয় কমাতে ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ এলাকা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তির ওপর মানসম্মত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমের ফলে আমদানির পরিমাণ বেশ কমছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৭ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয় ছয় লাখ টনের সামান্য বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সম্প্রসারণ উন্নত জাত ও নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বস্তায় আদা চাষ করা হয়। এতে ৯ হাজার টন আদা উৎপাদন হয়েছে। শতভাগ আমদানিনির্ভর জিরা মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। বীজ সংরক্ষণেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর জিরাতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আমদানি ব্যয় হয়। এ ছাড়া রসুনে আগের তুলনায় বার্ষিক আমদানি কমেছে প্রায় দুই হাজার টন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার আছে। তবে এ মসলার চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হচ্ছে বিদেশ থেকে আনার মাধ্যমে। 
মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমরা মসলার আমদানি নির্ভরতা কমাতে কাজ করছি। উন্নত জাতের মসলা ফসলের বছরব্যাপী উৎপাদন বাড়ানো হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে এবং মসলাজাতীয় ফসল চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা আনতে মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধান, গম বা অন্য শাকসবজির চেয়ে মসলার দাম বেশি। এটা দীর্ঘসময় রেখে দেওয়া যায়। ফলে কৃষকরা যখন দেখবে, এটা লাভজনক এবং অল্প জায়গায় চাষ করতে পারছেন, তখন অবশ্যই এটার উৎপাদন বাড়বে।’ 
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ২২টি মসলাজাতীয় ফসলের ওপর মোট ৪৭টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। তা ছাড়া উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে উৎপাদন প্রযুক্তি, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ আরও ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে। এসব জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ হলে একদিকে বাড়বে উৎপাদন, অন্যদিকে কমবে সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতির পরিমাণ। আয়ুর্বেদিক, খাদ্য এবং শিল্পে মসলার ব্যবহার বাড়বে বহুগুণ।

তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে বিপ্লব
দেশে প্রায় সময় ভোজ্যতেলের দাম ও সরবরাহের ঘাটতি নিয়ে হইচই পড়ে। প্রতিবছর রমজানে এ শোরগোল আরও বাড়ে। চাহিদার তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন কম হওয়ার বিপরীতে অতিমাত্রার আমদানির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চাহিদার ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন তথ্য বলছে, এ খাতে বছরে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এমন অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দেশেই উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ভোজ্যতেলের স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে ডলার সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশেই সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ সব ধরনের তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি চাহিদার অন্তত ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় সরকার, যার কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালে। লক্ষ্য অর্জনের এ দৌড়ে মাঠপর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাত্র দুই বছরেই পৌঁছে গেছে ২৫ শতাংশের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে আমদানি হিসাব বলছে, এতে দেশের ২৭ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি কমেছে। 
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে ২০২২ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন অধিদপ্তরগুলো। এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে দেশে দুই লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বাড়ানো হয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে আগের তুলনায় ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। তেলের হিসাবে বিবেচনা করলে ১ লাখ ২১ হাজার টন তেল বেশি উৎপাদন হয়েছে। আর প্রতি লিটার তেলের মূল্য ২৫০ টাকা হিসাব করলে এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার, যা কমিয়েছে আমদানি ব্যয়ের চাপ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, তিন বছর আগেও দেশে সরিষা উৎপাদিত হতো প্রায় ছয় লাখ টন। কিন্তু এখন দেশে গড়ে প্রতিবছর ১৭ লাখ টন সরিষা উৎপাদন হচ্ছে, যা থেকে প্রায় ছয় লাখ টন তেল উৎপাদিত হয়। এটি দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার ২৫ শতাংশ। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উৎপাদন মৌসুম শেষে সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ তেলজাতীয় ফসলের আবাদ তিন গুণ বেড়ে ৮ লাখ ৬০ হেক্টর জমি থেকে ২৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে উন্নীত করা হবে। এতে তেলের উৎপাদনও একই হারে বাড়বে।

দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড
দেশে গত বছর দানাদার খাদ্যের উৎপাদনে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে মোট উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৪৩ হাজার টন। বন্যা-ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগ সত্ত্বেও এ বছর বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়তে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে যে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে, এর মধ্যে ধানই ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন; ভুট্টা ৪৭ লাখ টন। আর গম ১১ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশে মোট দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড।
এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে ৬ কোটি ৯ লাখ ২১ হাজার টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৬ কোটি ৩১ লাখ ৩০ হাজার টন। গত এপ্রিলে গম ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। এবার ১১ লাখ টন গম উৎপাদন হয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমরা তো শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকি না। শস্যজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ভালো হলেও অন্য সব পণ্যই আমদানি করতে হয়। তবে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হলে দীর্ঘ পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখানে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি কমছে। বিপরীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই বিপুল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যেসব কৃষিপণ্য আমরা সহজে উৎপাদন করতে পারি, সেসবের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য চালিয়ে যেতে হবে গবেষণা। যেসব পণ্য সহজে উৎপাদন হবে না, তার জন্য আমদানির পথও খোলা রাখতে হবে। আলুর মতো যেসব পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়, সেসব পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থা করা যায়।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতের অর্থনীতিতে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আরেকটি পূর্বাভাস
  • মদ বিক্রিতে আয় ৫ হাজার কোটি, দুধ বিক্রিতে মাত্র ২১০ কোটি রুপি আয়
  • শুল্কমুক্ত সুবিধার সুফল কম, চীনে রপ্তানি হয় আমদানির ৩১ ভাগের ১ ভাগ
  • বাড়ছে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যের উৎপাদন