‘ঈদের আনন্দ বলতে আমাদের জীবনে এখন কিছুই নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। বাবারা সবার জন্য কেনাকাটা করেন, কিন্তু নিজের জন্য কেনেন না। ছোট্ট ভাইয়ের জন্য জামা কিনতে গিয়ে বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরেছি। তখন আমার চোখে পানি এসে যায়। বাবা যে মাথার ওপর কত বড় বটগাছ, তা যার নেই সেই কেবল বোঝে।’ 
কথাগুলো বলছিলেন জুলাই আন্দোলনে শহীদ দুলাল সরদারের বড় ছেলে সাইদুল সরদার (২৩)। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় মা ও তিন ভাইয়ের দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে। ডিগ্রি পাস করা সাইদুল বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণন বিভাগে কর্মরত। তাঁর বাবা দুলাল সরদার (৫০) ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সকালে ঢাকার মেরুল বাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার হকতুল্লাহ গ্রামের এই বাসিন্দা পেশায় মাইক্রোবাস চালক ছিলেন। স্ত্রী তাসলিমা বেগম এবং সাইদুলসহ চার ছেলে সজিব সরদার (২০), রাজিব সরদার (১৭) ও আবদুল্লাহ সরদারকে (৩) নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু একটি বুলেট তছনছ করে দিয়েছে পুরো পরিবারের স্বপ্ন, সুখ ও আনন্দ। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে পরিবারটি। মা ও ভাইদের নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়েছেন সাইদুল। 

শুধু দুলাল সরদারের নয়, পটুয়াখালীর সব শহীদ পরিবারে একই চিত্র। কেউ স্বামী, কেউ বাবা ও কেউ সন্তান হারিয়ে শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারগুলোয় এখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জোগাড়। সেখানে ঈদ সামনে তাদের হারানোর ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে। সপরিবারে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার কথা মনে হলেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন স্বজনরা। 
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার দক্ষিণ পাঙ্গাশিয়া গ্রামের জসিম হাওলাদার (৩৭)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। স্বামীকে হারিয়ে এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী রুমা বেগম। সেই শোক কাটিয়ে না উঠতেই ১৮ মার্চ তাঁর কিশোরী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হন। 
শহীদ জসিম হাওলাদারের স্ত্রী রুমা বেগম বলেন, ‘আমার তো একটার পর একটা বিপদ লাইগ্যাই আছে। ঈদের আনন্দ করি কহোন। স্বামী হারাইয়ে  কোনো রহমে বাঁইচা ছিলাম। হের মধ্যে আরেক বিপদ আইয়্যা মাথার উপর পড়লো। আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়া গেলেন, আর হেই দেশের মানুষের কাজ থেইকা প্রতিদান এইডাই পাওয়ার ছিল?’ 
গত ২১ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মিলন হাওলাদার (৩৫)। দুমকী উপজেলার আঙ্গারিয়ার পূর্ব ঝাটড়া গ্রামের এই বাসিন্দা সিদ্ধিরগঞ্জে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। 

শহীদ মিলন হাওলাদারের স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, ‘উনি (স্বামী) যখন ছিলেন তখন প্রতি বছর কেনাকাটা ও ঈদের আনন্দ করতাম। এ বছর তো উনিই নাই। উনার অনুপস্থিতিতে ঈদ করব, এটা ভাবতেই পারছি না।’ ঈদের আগে এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো সহায়তা পাননি বলেও জানান তিনি। 
‘আজ যদি আমি মারা যাই, বিজয়ের পর আমার কবরে পতাকা দিও। হয়তো লাশ হব, নয়তো ইতিহাস হব’। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার আগের দিন ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাগর গাজী (২০)। তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপার পূর্ব পাড় ডাকুয়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। তিনি বলেন, ‘ছোট ছেলেটাকে ছাড়া কীভাবে ঈদের আনন্দ করব? সরকার থেকে তিনিও কোনো সহায়তা পাননি। 
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, জেলার সব শহীদ পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রীসহ ঈদ উপহারসামগ্রী  সংশ্লিষ্ট উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। ইউএনওদের মাধ্যমে শহীদ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। 
প্রসঙ্গত, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পটুয়াখালী জেলার ২২ জন শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে গলাচিপা উপজেলার আমখোলার বাউরিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর খান, ডাকুয়ার পূর্ব পাড় ডাকুয়া গ্রামের সাগর গাজী, পানপট্টির গ্রামদ্দন গ্রামের আতিকুল ইসলাম, চিকনিকান্দির পানখালী গ্রামের মামুন হাওলাদার, চরকাজলের চরশিবা গ্রামের রাসেল মাহমুদ ও বকুলবাড়িয়ার বাঁশবাড়িয়ার গোলাম রাব্বী। বাউফল উপজেলার ধুলিয়া এলাকার আক্তারুজ্জামান নাঈম, সাংবাদিক মেহেদী হাসান, সূর্যমনির ইন্দ্রকূল গ্রামের নবীন তালুকদার, মদনপুর বিপাশা গ্রামের জাহাঙ্গীর মৃধা, কেশবপুরের পশ্চিম ভরিপাশা গ্রামের আল-আমিন ও নাজিরপুরের বড় ডালিমা গ্রামের হাফেজ ইমরান জোমাদ্দার। সদর উপজেলার বদরপুরের হকতুল্লাহ গ্রামে দুলাল সরদার, কালিকাপুরের পশ্চিম শারিকখালী গ্রামের বাচ্চু হাওলাদার, মাদারবুনিয়ার চালিতাবুনিয়া গ্রামের মোহাম্মদ রায়হান ও শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকার হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। দশমিনা উপজেলা সদরের জিয়াদ হোসেন, আলীপুরের উত্তর লক্ষ্মীপুর গ্রামের জাকির হোসেন ও আলীপুরার মীরমদন গ্রামের আরিফুর রহমান। দুমকী উপজেলার আঙ্গারিয়ার পূর্ব ঝাটড়া গ্রামের মিলন হাওলাদার ও পাঙ্গাশিয়ার দক্ষিণ পাঙ্গাশিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিন হাওলাদার এবং রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবীর খাসমহল গ্রামের মোহাম্মদ শাহজামাল অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অভ য ত থ ন দ ল ল সরদ র ঈদ র আনন দ পর ব র র ম হ ম মদ উপজ ল র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত সকাল ১০টায়, শুরু হবে ৩ দফা গুলিতে

কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগায় জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। ঐতিহ্য অনুসারে তিন দফা গুলি ফুটিয়ে শুরু হবে জামাত। এটি বিশ্বের বুকে এক বিরল দৃষ্টান্ত ও ঐহিত্য। জামাতে ইমামতি করবেন শহরের বড় বাজার জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবুল খায়ের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্ব প্রান্তে রেললাইন পেরিয়ে নরসুন্দা নদীর উত্তর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যাবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ। এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৭৫০ সালে। তবে ১৮২৮ সালে প্রথম সর্ববৃহৎ সোয়া লাখ মুসল্লি এক সঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেই থেকেই ‘সোয়ালাকিয়া’ শব্দ থেকে উচ্চারণ বিবর্তনের মাধ্যমে এর নামকরণ হয়েছে ‘শোলাকিয়া’। আর ১৮২৮ সালের জামাত থেকেই ক্রমিক নম্বর ধরে এবারের জামাতকে বলা হচ্ছে ১৯৮তম জামাত।

জেলা প্রশাসক ও ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেন, বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি সেনা সদস্য এবং ৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৬৪টি সিসি ক্যামেরা। মাঠে থাকবে পুলিশের চারটি ও র‌্যাবের দুটি ওয়াচ টাওয়ার। ঈদের দিন দূরের মুসল্লিদের আসার জন্য সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে এবং সকাল ৬টায় ভৈরব থেকে দুটি ঈদ স্পেশাল ট্রেন কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে আসবে। নামাজ শেষে দুপুর ১২টায় দুটি ট্রেন আবার গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। এছাড়া ঈদের আগের দিনই দূরবর্তী যেসব মুসল্লি চলে আসছেন, আশপাশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মসজিদের তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে যে বিপুল পরিমাণ মুসল্লির আগম ঘটে, তাতে মূল ঈদগায় স্থান সঙ্কুলান হয় না। জামাতের পরিসর আশপাশের খালি জায়গা, পার্শ্ববর্তী সকল রাস্তা, নরসুন্দা নদীর বিশাল সেতু, পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ির আঙিনায়ও বিস্তার লাভ করে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি ১১০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। থাকবে ক্যামেরাবাহী ড্রোন ও বাইনোকুলার। চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি পেরিয়ে মুসল্লিদের ঈদগায় প্রবেশ করতে হবে। কেবল মাত্র জায়নামাজ ও মোবাইল ফোন ছাড়া অন্য কোনো ডিভাইস, ব্যাগ এবং ছাতা নিয়ে প্রবেশ না করতে মুসল্লিদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এবারের জামাতে প্রায় ৬ লাখ মুসল্লির সমাগম হবে বলে তিনি মনে করছেন। র‌্যাব-১৪ ময়মনসিংহ অঞ্চলের কমান্ডিং অফিসার অতিরিক্ত ডিআইজি নায়মুল হাসান বলেছেন, পর্যাপ্ত র‌্যাব সদস্য মোতায়েন ও টহল অবস্থায় থাকবেন। সাদা পোশাকেও অনেকে দায়িত্ব পালন করবেন। ২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার কারণে একই বছরের ঈদুল আযজহার সময় থেকেই  নেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শহরকে বেশ কিছু তোরণ ও উৎসব পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। ঈদগায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকবে। ফায়ার সার্ভিস ও মেডিক্যাল টিম মোতায়েন থাকবে। মুসল্লিদের অজুর সুব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত শৌচাগারও করা হয়েছে।

শোলাকিয়ার একটি বিরল ঐতিহ্য হচ্ছে গুলি ফুটিয়ে জামাত শুরু। জামাত শুরুর ১৫ মিনিটি আগে তিনটি, ১০ মিনিট আগে দুটি এবং ৫ মিনিট আগে একটি শর্টগানের গুলি ফুটিয়ে নামাজের সংকেত দেয়া হয়। এক সময় সুতলির মধ্যে তিনবার সারিবদ্ধ পটকা ঝুলিয়ে সুতলির নিচের মাথায় আগুন দিয়ে পটকা ফাটানো হতো। সুতলি বেয়ে আগুন ওপরের দিকে যেত, আর একের পর এক পটকাগুলো ফুটতো। মাঝে মাঝে পটকা নষ্ট থাকতো বলে আওয়াজের তালের ব্যত্যয় ঘটতো। যে কারণে এখন শর্টগানের গুলি ফুটিয়ে জামাত শুরুর সংকেত দেওয়া হয়। এই ঐতিহ্য দেশে অদ্বিতীয় ও নজিরবিহীন বলে কমিটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ