কাজ, ব্যস্ততা, জীবনের ভীষণ নিয়ম–মনে হয় দেয়ালে হাতুড়ির ঘায়ে বেঁকে আটকে যাওয়া একটা পেরেক। সেই পেরেক থেকে ফাঁসির আসামির মতো ঝুলছে এক ক্যালেন্ডার। সে সকালবেলা মনে করিয়ে দিচ্ছে, এখনই ছুটতে হবে। জ্যামুক্ত তীরের মতো এখনই ছিটকে গিয়ে পড়তে হবে বাইরে ভাসমান মানুষের ভিড়ে। ক্যাব কল করা, ট্রেন ধরা, বাসে গুড়ের গায়ে মাছি বসা ভিড়; সেখানে নিজেকে গুঁজে দেয়া কোনোমতে। তারপর মানুষের জীবনে কোনো স্পার্টাকাস নেই জেনে অনেক স্ট্রিটফাইট শেষে কর্মস্থলে পৌঁছানো। প্রতিদিন প্রলয় ঘটানো এই তীব্র জীবনের মাঝেও কখনো ছুটি আসে। পুরোনো ক্যালেন্ডার চোখ রাঙায়, কিন্তু তারপরেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার মতো ছুটি আসে। জীবনের ব্যস্ত প্রবাহে ছেদ পড়ে। দীর্ঘ সিঁথির মতো জনশূন্য পড়ে থাকা দিনরাত্রি, ঘরের কোণে আলসেমি অথবা ঘর ছেড়ে চেনা সমুদ্রের অচেনা স্বাদ নিতে বের হয়ে পড়া, অরণ্যের অন্তরালে বসে অবিশ্রান্ত পাতার পতন দেখতে যাওয়া।
কাজ আছে বলেই এমন করে আমাদের মনের মধ্যে ছুটির প্রার্থনা জেগে ওঠে। সেই প্রার্থনা কি রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটির নিমন্ত্রণের’ মতো? ছুটির নিমন্ত্রণ কে কাকে জানায়? কোথায় কোন অবসর পড়ে থাকে অরণ্যের প্রান্তে, কোনো নির্জন পাহাড়ের আলস্যের রাজ্যে? তবুও ছুটি মিললে আমরা বের হয়ে পড়ি। আমরা ছুটি চাই, ছুটি চাই প্রভু। জীবন নানা অন্বেষণে ঘুরিয়ে মারে আমাদের। ভিড়ভর্তি জীবন আকাশভর্তি পাখিদল দেখার সুযোগ দেয় না। প্রতিদিনকার মাপা জীবন জোয়ার আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার ফিরিয়েও দেয় সংসার সীমান্তে। এই জ্যামিতিক মাপের কবল থেকে আমরা তাই অব্যাহতি চাই। যানবাহনের হর্ন, মানুষের কোলাহল, ভিড়ে রুদ্ধশ্বাস পথ, বিপণিবিতান, আলো ঝলমল শহুরে জীবন থেকে ছুটি পেলে তাই আমরা ফেরারি হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠি।
কোথায় ফেরারি হই আমরা? কোথায় পালাই? ছুটি কি তাহলে এক ধরনের পলায়ন? পত্রিকার পাতায় দীর্ঘ অবসরকে ‘ছুটির ফাঁদ’ বলে লেখা হয় আজকাল। আমাদের কর্মময় জীবনপ্রবাহ কতদিনের জন্য অচল হয়ে যাবে তার চুলচেরা হিসাব কষেন সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনে। কবে কোন ছুটির সঙ্গে একটা দিন মিলিয়ে দিলে দীর্ঘ ছুটির ধাঁধার সমাধান মিলবে তারই আগাম সংকেত দিতে থাকেন তারা। সেই যে এক সিনেমা ‘ছুটির ফাঁদে’। নায়ক-নায়িকা ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে নানাভাবে নাকাল হয়েছিল। সেই সিনেমার গল্প হয়তো জীবনের আরেক প্রান্তের গল্পই বলতে চেয়েছিল আমাদের। কিন্তু পেশাজীবীদের স্পার্টাকাসের মতো মুক্তির দূতহীন জীবনে ছুটি তো ফাঁদ নয়, মুক্তি।
আমাদের দেশ কোথায়? অবশ্যই বাংলাদেশ। রাজধানীবাসীর অবস্থানও তো রাজধানীতেই। তবুও ছুটির ক্যালেন্ডার সামনে এলেই শুনতে হয়, ‘দেশে’ যাচ্ছি ছুটিতে। প্রতি বছরই বহু মানুষ উৎসবের ছুটিতে এই শহরকে ফাঁকা করে দিয়ে পাড়ি জমায় সেই ‘দেশের বাড়ির’ উদ্দেশে। তাহলে এই নগর কি দেশ নয়? এখানেই তো আমরা কাজের সন্ধানে এসে ভিড় জমাই। তাহলে আর ‘দেশের সন্ধান’ কেনো? দূর-দূরান্ত থেকে পাখিদের মতো মানুষ কাজের জায়গায় ভিড় জমায়। তারপর ছুটি মিললেই ‘দেশের’ উদ্দেশে ডানা মেলে দেয়। সেই দেশ কোথায়? কোথায়ই বা ভৌগোলিক সীমানা? সেই দেশ আসলে তার পেছনে ফেলে আসা গ্রাম। বিষণ্ন কোনো মফস্বল হয়তো।
সেখানে তার স্মৃতি বিস্তারিত। শিকড় ছিন্ন হয় না নগরবাসের ইতিকথার তলায় চাপা পড়েও। ফেলে আসা জীবনের স্নিগ্ধ ছবি মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় উৎসে। তাই তার ছুটি চাই। ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশিরে, ফুলের সৌরভে মুক্তি চাই। কর্মমুখর জীবনে দিনরাত কেবল জীবিকার ধান্দা, নানা ফন্দিফিকির, কূটতর্ক, ঝগড়া-ঝাটি। হয়তো তাই অবসরের জমিনে ক্ষণকাল সমাধিস্থ হওয়ার স্বপ্নটা-ই ছুটির ডাক নামে ক্যালেন্ডারে লাল রঙ দেয়া তারিখ হয়ে অপেক্ষা করে।
কিন্তু শুধুই কি শিকড়ের টানে ঘরে ফেরার নামই ছুটি? ব্যাগপত্তর বেঁধে, অফিসে ক্যাজুয়াল লিভের কঠিন হিসাব-নিকাশের শরীরে স্যালাইনের সুঁইয়ের মতো অবসরের স্বপ্ন গেঁথে দিয়ে, ঘরবাড়ির দুয়ারে তালা লটকে বের হয়ে পড়াই কি ছুটির অন্য নাম? ছুটির সংজ্ঞাই তো বদলে গেছে আজকাল। ছুটির ফাঁকে কত কেউ ক্ষণিকের উদ্বাস্তু হয়ে উড়ে যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। অন্য কোনো দেশের পাহাড়, জঙ্গল অথবা সমুদ্রতট তাদের অলসবেলার চিহ্ন সাজাতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। মার্কোপোলো তার পর্যটনের কাহিনি লিখেছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ তার অবসর বিনোদন নিয়ে লিখে চলেছে নিজস্ব ভ্রমণের গল্প। সমাজের ভিতরে দিনে দিনে তৈরি হয়েছে অসীম বিত্তের পরিসর। সে বিত্তের বড় অংশ অনুপার্জিত। ফলে আমাদের দেশে পাল্টে গেছে সমাজ কাঠামো। পাল্টে যাচ্ছে ছুটির দিনের চেনা গল্পগুলোও। ফেসবুকে স্ট্যাটাস, কোনো নীল সমুদ্রের ছবি, পাথুরে দ্বীপ, গভীর বনাঞ্চল অথবা ঠমকে চমকে দেয়ার মতো কোনো তারকা খচিত হোটেলের রোদমাখা অলস ব্যালকনি ছুটির দিনের গল্পের শিরোনাম হয়ে থাকে।
তবুও আমরা ছুটি চাই। পকেটে ট্রেনের টিকেট তাড়া দেয়। বাসের আগাম সময়সূচি ঠিক করে দেয় বেড়াতে যাওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বছর চল্লিশ আগেও বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে বেড়ানো, হলিডে, লং ভ্যাকেশন শব্দগুলো অনেকটাই অচেনা ছিল। তখন ছুটির দিনে ঘরে বসে রান্নার সূচিপত্র ঠিক করা, পার্কে বেড়াতে যাওয়া অথবা অবসরে সিনেমা হলের আলো আঁধারের নিভৃতি ছিল নির্দিষ্ট বিনোদনের উৎস। শিকড়ের টানে তখনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে সাময়িক আবাস ছাড়তো মানুষ। কিন্তু ছুটির নিমন্ত্রণ এখনকার মতো ট্রেন্ড বা প্রবণতা হয়ে ওঠেনি। এই প্রবণতা বোধ করি ছোঁয়াচে রোগের মতো, শুধু আক্রান্ত করে। এখন ছুটি মানেই সামাজিক জ্বরের মতো এক অনুভূতি। নগরের কোলাহল থেকে, শব্দের বিপুল আগ্রাসন থেকে, অনুশাসন থেকে মুক্তি চেয়ে মানুষ কোথাও যেতে চায়। সে নিজেও হয়তো জানে না সে কোথায় যেতে চায়! তবুও তার চাওয়া অফুরান। শুরুতে তাই লিখেছিলাম, ছুটি আসলে কি এক ধরনের পালিয়ে যাওয়া? নিজের থেকেও দূরে কোথাও চলে যাওয়া? অদ্ভুত আর বিকলাঙ্গ সমাজ বিকাশের ধারায় মধ্যবিত্তের ধারণাটাই পাল্টে গেছে। এখন অবকাশ যাপনের জন্য যাবার জায়গা তৈরি হয়েছে অনেক। বহু মানুষ ছুটির ফাঁকে চলে যায় পর্যটনে। অলসতা, সীমাহীন রোদ অথবা মেঘাচ্ছন্ন দিন তাকে মুক্তি দেয়। তবু কিছু মানুষ পড়ে থাকে পেছনে। যারা ছিন্নমূল, যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। লম্বা ছুটির টাইম টেবিল সামনে রেখেও তারা কোথাও যায় না; নগরীর দুঃখ যন্ত্রণার সঙ্গে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকে। ছুটির অবকাশে তাদের কোথাও যাবার থাকে না। যখন বহু মানুষ ছুটির নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঘর ছাড়ে তখন কেউ কেউ পেছনে পড়ে থাকে। নগরের শান-বাঁধানো পথ, বিমুখ বিপণিকেন্দ্র, মুখ থুবড়ে পড়া গলি, সন্তানের অসুস্থতা তাদের টেনে ধরে রাখে। দুর্দিনের ইতিহাস তাদের লিখতে দেয় না
‘‘আজ আমাদের ছুটি’’। ‘‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/ বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’’। রবীন্দ্রনাথের ছুটির এই ধারণার সঙ্গে সময়ের ছুটির গল্পের মেরুদূর প্রভেদ আছে। আমরা এখন সবকিছুর স্বাদ নিতে চাই কিন্তু আস্বাদ গ্রহণে আগ্রহী নই। তাই ছুটি মানে যে ব্যস্ত জীবনের ওপর নেমে আসা বিরতি তা-ও ভুলে যাই। ছুটির দিনের নিভৃতি তাই মিশে যায় নানা হট্টগোলে।
দীর্ঘ ছুটির রুটিন সাজাচ্ছে এখন মানুষ। ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে ছুটি মিলেছে। কী বলা যায় একে, ব্যস্ততার পুনরাবৃত্তির মাঝে হঠাৎ বিরতির উৎসব? ছন্দপতন তো নিশ্চয়ই নয়। নতুন ছন্দে জেগে ওঠার অবকাশ হয়তো। বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরবে স্বজন। এই শহুরে প্রবাস থেকে ঘরে ফিরবে মানুষ। প্রতিদিন ব্যস্ত দিন যাপনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি মিলবে কোথাও অবসর কাটানোর ফাঁকে। সুতরাং তৈরি হয়ে যাবে ভ্যাকেশন প্ল্যান। পেছনে পড়ে থাকবে বিষণ্ন নগরী। কাজ নেই, ছোটা নেই, ক্লান্তি নেই, বিশ্রামের আনন্দ নেই। নদীর চড়ায় রোদে পিঠ-পড়ে থাকা কুমিরের মতো অবসন্ন ছুটির দিন।
আমরা সবাই অবসর চাই। বিশ্রাম চাই, ভিড় থেকে দূরে যেতে চাই। কাজ আছে বলেই এমন করে ছুটির প্রার্থনা হয়তো আমাদের। বেকারের কাছে ছুটির দিনের কোনো অর্থ নেই, নেই ক্যালেন্ডারের তারিখে দৃষ্টি ফেরানোর গরজ। দেয়ালে বাঁকা হয়ে আটকে থাকা পেরেকের মতো আমাদের নিয়তি আসলে ব্যস্ত দিনে সমাহিত। ছুটির দিনগুলো লাল রঙ হয়ে তাকিয়ে থাকে গোটা বছর আমাদের দিকে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ বন র র জ বন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বাধ্যতামূলক অবসর এনবিআরের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন আয়কর বিভাগের কমিশনার গোলাম কবির এবং বোর্ডের সদস্য আবু সাইদ মোহাম্মদ মোশতাক। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
আয়কর অঞ্চল-৫-এ থাকার সময় বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কর ফাঁকি দিয়ে আলোচিত ৭২১ কোটি টাকা চীন থেকে দেশে এনে রেমিট্যান্স হিসেবে প্রদর্শনের ঘটনায়ও তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে জানা যায়। ওই সময়েও তারা একই কর্মস্থলে ছিলেন। কবির এবং মোশতাকের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।