যারা আপসে বিরোধী রাজনীতি করেছে, তাদের কাছে এটা স্বাধীনতা মনে হয় না: নাহিদ ইসলাম
Published: 27th, March 2025 GMT
আওয়ামী লীগের বিগত ১৫-১৬ বছরের শাসনামলে যাঁরা নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁরা গত বছরের ৫ আগস্ট অবশ্যই নতুন করে স্বাধীন হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির এই নেতা বলেন, আর যাদের ব্যাংক-ব্যালেন্স অক্ষুণ্ন ছিল, যারা আপসমূলে বিরোধী রাজনীতি করেছে, তাদের কাছে হয়তো এটা স্বাধীনতা মনে হয় না। কারণ, তারা হয়তো সব সময় স্বাধীন ছিল। আগের আমলে ছিল, এখনো ছিল///। তাদের কাছে প্রথম স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না, দ্বিতীয় স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না; তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লুটপাটের স্বাধীনতা।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ টাওয়ারে জাতীয় নাগরিক পার্টির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেন। ২০২১ সালের ‘আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে’ শহীদদের তালিকা প্রকাশ, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও বিচারের দাবিতে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে এনসিপি।
আলোচনায় নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘গতকাল দেখলাম যে প্রথম স্বাধীনতা, দ্বিতীয় স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক। আমরা যারা গত ১৬ বছরে এই ঘটনাগুলোর ভিকটিম ছিলাম, আমাদের কাছে এটা অবশ্যই স্বাধীনতা। ৫ আগস্ট আমরা আসলে নতুন করে স্বাধীন হয়েছি। যারা এই গত ১৫-১৬ বছর নির্যাতিত হয়েছি, নিপীড়িত হয়েছি।’ এ প্রসঙ্গে আলোচনায় যাঁদের কাছে ৫ আগস্ট স্বাধীনতা মনে হয় না, তাঁদের নিয়ে ওই সব কথা বলেন তিনি।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্যে দেশে হিন্দু নির্যাতনের গল্প প্রচার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম। এ ধরনের ‘অপপ্রচার’ বন্ধ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা এখনো ভারতে অবস্থান করছেন উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ভারত গণহত্যাকারীদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে কোনো ভালো উদাহরণ তৈরি করছে না। বাংলাদেশে বিচার কার্যক্রম এগোচ্ছে এবং বিচার কার্যক্রম এগোলে কূটনৈতিকভাবে যাঁরা দোষী, যাঁরা অপরাধী, মামলার আসামি যাঁরা রয়েছেন, শেখ হাসিনাসহ তাঁদের ফেরত চাওয়া হলে ভারত সরকার সহযোগিতা করবে, এটা প্রত্যাশা থাকবে। আর এটার মাধ্যমেই বোঝা যাবে যে ভারত বাংলাদেশের প্রতি কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী।
২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে সেই হত্যার বিচার এবং যথাযথ মর্যাদা প্রত্যাশা করেন। সেই শহীদদের তালিকা ও সংখ্যা প্রকাশ করা এবং দোষীদের বিচার ও যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি যেন সরকার আমলে নেয়, সেই দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম স ব ধ নত
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদের ছুটিতে ঘুরে অসতে পারেন প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর রাজশাহী
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে পুঠিয়া উপজেলা অবস্থিত। এখানে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের অফুরন্ত ভাণ্ডার। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এসব পুরাকীর্তির সৌন্দর্য হৃদয় কাড়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। রাজশাহী শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে পুঠিয়া উপজেলা। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাসে করে রাজশাহীর প্রবেশমুখ পুঠিয়ায় আসা যায়। বিমান বা ট্রেনে রাজশাহীতে নেমে সহজেই আসা যায় পুঠিয়ায়। নারিকেল সুপারি আর জলদীঘি ঘেরা পুঠিয়ায় রয়েছে ১৮টি পুরাকীর্তি। মোগল ও বৃটিশ আমলের ঐতিহ্যবাহী এসব পুরাকীর্তি মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে কালের সাক্ষী হয়ে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতানী আমলে পুঠিয়ার নাম ছিল লস্করপুর পরগনা। তখন এখানে আফগান জায়গীরদার লস্করখাঁর জমিদারি ছিল। ১৫৭৬ সালে মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে পুঠিয়া রাজবংশের উদ্ভব। কথিত আছে, বৎসাচার্য নামের এক তান্ত্রিক সাধক এখানে বাস করতেন। তার কাছে পরামর্শ নিয়ে বিনা রক্তপাতে লস্করখাঁকে পরাজিত করেন মানসিংহ। এরপর তিনি জমিদারি বৎসাচার্যকে দিতে চাইলে তিনি নিজে না নিয়ে তার ছেলে পীতাম্বরের নামে বন্দোবস্ত নেন। এই রাজবংশের নীলাম্বরকে সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজা এবং রানী শরৎ সুন্দরী ও তার পুত্রবধূ হেমন্ত কুমারীকে মহারানী উপাধি দেন বৃটিশ সরকার। ময়মনসিংহ, মুক্তাগাছা, মালদা, মুর্শিদাবাদ, লালগোলা, খুলনা, রুপসা, চিলাহাটি, নাটোরের বেশকিছু এলাকা পুঠিয়া রাজার অধীনে ছিলো বলে জানা যায়। পুঠিয়া নামকরণে রয়েছে নানা মত। কথিত আছে, পুঠি বিবি নামের এক রাজ নর্তকীর নামে এই নামকরণ। তবে ভিন্নমতও রয়েছে।
পুঠিয়ার রাজা-মহারানীদের সময়ে নির্মিত পাঁচআনি রাজবাড়ী, টেরাকোটা কারুকাজ সমৃদ্ধ বড় গোবিন্দ মন্দির, হাজার দুয়ারি বা দোল মন্দির, বড় শিব মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, ছোট শিব মন্দির, রথ মন্দির, চারআনি রাজবাড়ি, বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, গোপাল মন্দির, রানীঘাট, হাওয়াখানার সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। এসব পুরাকীর্তির নান্দনিক শিল্পকর্ম মানুষকে নিয়ে যায় অতীতে। পুঠিয়ার বড় গোবিন্দ মন্দিরের টেরাকোটার নকশায় হাজার বছর আগের কৃষ্ণের রাসলীলা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, রাম-রাবণের যুদ্ধে স্থির চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়।
নারিকেল সুপারি গাছ আর জলদীঘি ঘেরা পুরার্কীতির সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক পুঠিয়ায় বেড়াতে আসেন। একসঙ্গে রাজবাড়ি, মন্দির আর দীঘির জল মন ভালো করে দেয় মূহূর্তেই।
স্থানীয়রা জানান, দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর পুঠিয়ার রাজবাড়ি ও মন্দিরগুলো অধিগ্রহণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। বিগত সরকারের আমলে রাজবাড়ি ও মন্দিরের হালকা সংস্কার কাজ করা হয়। এসময় রাজবাড়ীর মূল ভবনে জাদুঘর স্থাপন করা হয়। তবে উচ্ছেদ করা যায়নি রাজবাড়ীর সীমানার ভেতরের দখল হয়ে যাওয়া জমি। সেখানে অসংখ্য মানুষ জমিজমা দখল করে বাড়িঘর তৈরি করেছেন। এদের অনেকেই জাল দলিল করে সম্পত্তি ভোগ করছেন। এলাকাবাসীর দাবি, সবগুলো মন্দির সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পুঠিয়াকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন নগরী ঘোষণা করার।
পুঠিয়া থিয়েটারের সদস্য সাংস্কৃতিক কর্মী নাসির উদ্দীন বলেন, পুঠিয়া রাজবাড়ি কমপ্লেক্সের ভেতরের জায়গাগুলো অবৈধ দখলদারদের দখলে। এগুলো উচ্ছেদ করে আকর্ষণীভাবে সাজানো প্রয়োজন। তাহলে আরও বেশি পর্যটক পুঠিয়ায় আসবেন। তিনি বলেন, রাজাদের আমলে রাজবাড়ীর সুরক্ষার জন্য চারিদিকে পরিখা (পুকুর) খনন করে মাঝে রাজবাড়ী, মন্দির ও গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা তৈরি হয়েছিল। পরিখার ভেতরের জমি কোনো ব্যক্তির হতে পারে না।
পুঠিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি দেবাশীষ বসাক বলেন, রাজবাড়ীর সীমানার মাঝে অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে। আদালতে কিছু মামলা চলমান। নিষ্পত্তি হতে হবে। রেকর্ড সংশোধনের কিছু মামলা চলমান আছে। এছাড়া অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পুঠিয়ার রাজা-জমিদাররা শুরুর দিকে প্রজাদরদি ছিলেন। মাঝে অত্যাচারী হিসেবে প্রজা বিরোধী কাজ করেছেন। তবে শেষ দিকে এসে শিক্ষার প্রসারসহ সমাজ উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছেন। ইউরোপীয় কায়দায় রাজশাহী শহরে ঢোপকল বসিয়ে প্রথম পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন পুঠিয়ার মহারানী হেমন্ত কুমারী। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দুর করাসহ রাজশাহীর উন্নয়নে অসংখ্য জনহিতকর কাজ করেন। দেশভাগের আগে বহুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় পুঠিয়া জমিদারি। এসময় জমিদারদের অনেকেই কর্মচারীদের উপর দায়িত্ব দিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হলে অবসান হয় পুঠিয়া রাজবংশের শাসন। তবে তাদের নির্মিত রাজবাড়ি ও মন্দিরগুলোর সৌন্দর্যের দিকে তাকালে এখনো পাওয়া যায় তাদের শিল্প ও রুচিবোধের পরিচয়।
বাঘা মসজিদ:
পুঠিয়া থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে, আর রাজশাহী শহর থেকে ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বদিকে ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ অবস্থিত। সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। ৫০ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি রয়েছে। মসজিদ কমপ্লেক্সটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। ইট দিয়ে তৈরি প্রাচীন এই মসজিদটির চারপাশে ৪টি এবং মাঝখানে দুই সারিতে মোট ১০টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের পূর্ব পাশের ৫টি দরজা রয়েছে। এছাড়া উত্তর-দক্ষিণের দেয়ালের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাঘা মসজিদের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর পোড়া মাটিরফলক দেখতে পাওয়া যায়।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর:
এবছর ১১৫ বছরে পা রেখেছে দেশের প্রথম ও প্রাচীন এই জাদুঘরটি। বর্তমানে এই জাদুঘরে রয়েছে প্রায় ১১ হাজার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। ১৯১০ সালে কুমার শরৎকুমার রায়ের প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি এখন বঙ্গীয় শিল্পকলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রাহশালা।
প্রাচীন গৌড়ীয় স্থাপত্যশৈলীর ধারায় নির্মিত এই জাদুঘর অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গীয় শিল্পকলার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের মধ্যে এখানে রয়েছে ভাস্কর্য শিল্প (প্রস্তর, ধাতব, দারু), বিভিন্ন মুদ্রা (স্বর্ণ, রোপ্য, তাম্র ও মিশ্র ধাতুতে নির্মিত ছাপযুক্ত মৌর্য, ব্যাকট্রিয়, সাসানিয়ান, গুপ্ত, শশাঙ্ক, সুলতানী, সুরী ও মোগল মুদ্রা), শিলালেখ, তাম্রশাসন, পোড়ামাটির ফলক ও অন্যান্য মৃৎ শিল্প, পাণ্ডুলিপি, চিত্র শিল্প প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মৌর্য, গুপ্ত ও পাল আমলের বৌদ্ধ, জৈন, শাক্ত, ব্রক্ষ, বৈষ্ণব, সৌর, শৈব, গাণপত্যসহ নানা দেব-দেবীর মূর্তি, নকশি পাথর, পোড়ামাটির ফলক, মৃৎভানু ছাড়াও রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা, মহাস্থান, নালন্দা (বিহার), পাহাড়পুরে প্রাপ্ত নিদর্শন, প্রাক মুসলিম ও মুসলিম আমলের শিলালেখ, তাম্রশাসন, ফরমান, দলিল ও রঙ্গিন চিত্রযুক্ত অষ্টসহস্রিকা ও প্রজ্ঞাপারমিতার মত দুর্লভ পুঁথি। এগুলো জনসাধারণ্যে প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন গ্যালারিতে সুবিন্যস্ত রয়েছে। এই জাদুঘরে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রীর সিংহভাগই প্রস্তর নির্মিত ভাস্কর্য। বাংলা মুসলিম শাসনে আসার পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংখ্যা প্রচুর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাঁকরাইল (মালদহ) ও নরহট্টের (বগুড়া) বিষ্ণু মূর্তি। এদের বসন-ভুষণ ও গঠনশৈলী দেখে তা কুষাণ যুগের মূর্তির অনুরূপ বলে মনে করা হয়। এছাড়া রাজশাহীর বিহারৈলে প্রাপ্ত সারনাথ রীতির বুদ্ধ মূর্তি গুপ্ত যুগের বলে প্রতীয়মান হয়। বগুড়ার দেওপাড়ার সূর্য মূর্তি ও বালাইধাপে প্রাপ্ত স্বর্ণমণ্ডিত মঞ্জুশ্রী মূর্তিতেও গুপ্ত যুগের শিল্প বিদ্যমান। এই মূর্তির কামনীয় অথচ শান্ত সমাহিত অতীন্দ্রিভাবে পরিপূর্ণ মুখশ্রী। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লাবণ্য ও সুষমা, করাঙ্গুলি ও অধরযুগলের ব্যঞ্জনা এবং সমগ্র দেহের ভাব প্রবণতা দেখলে একে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নির্দশন বলে গ্রহণ করা যায়। এ থেকে অনুমান করা হয়, পালপূর্ব সময়কালে- মোর্য, কুষাণ ও গুপ্ত আমলে এখানে ধ্রুপদী শিল্পকলার চর্চা ছিল। এরই অব্যাহত ধারায় পাল আমলেও এসে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল।
বরেন্দ্র জাদুঘরের একটি পুঁথি সংগ্রহশালাও রয়েছে। যেখানে অষ্টসহস্রিকা, প্রজ্ঞাপারমিতাসহ হস্তলিখিত বাংলা ও সংস্কৃত সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো। এছাড়া এই জাদুঘরে প্রায় ১৪ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রিকা সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি শিক্ষক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পান। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জাদুঘরটি জ্ঞানান্বেষীদের আকৃষ্ট করে আসছে। এই জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছিলেন ভারতীয় রাজনীতির প্রবাদপুরুষ মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, বাংলার গভর্ণর লর্ড কারমাইকেল, লর্ড রোনান্ডস, লর্ড লিটন, ইতিহাসবেত্তা পার্সি ব্রাউন, স্টেলা ক্র্যামরিশ, শিক্ষাবিদ স্যার স্টেইনলি জ্যাকসন, স্যার আশুতোষ মুখার্জী প্রমুখ।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এই জাদুঘরটি আর্থিক অসচ্ছলতা, ক্রটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য হুমকির মুখে পড়ে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গৃহীত হয়। বর্তমানে জাদুঘরটি পরিচালনার জন্য ১৪ সদস্যর একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতি উপাচার্য।
পদ্মাপাড়ের প্রাচীন শহর রাজশাহী:
বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর রাজশাহী। এটি উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় এবং বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম জনবহুল শহর। রাজশাহী শহর পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে এশিয়ার অনেক শহরের চেয়ে সুনাম রয়েছে রাজশাহীর। রাতের রাজশাহী শহরে জ্বলে রঙ বেরঙয়ের আলোকবাতি। প্রাচীন বিভাগীয় এই শহরটি শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া রাজশাহী রেশম, আম, লিচু ও জন্য প্রসিদ্ধ। রেশম কাপড়ের জন্য রাজশাহী রেশম নগরী নামেও পরিচিত। শিক্ষার প্রসারে রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী কলেজ বিখ্যাত। দুই বাংলার অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, পন্ডিতরা এখানে পড়াশোনা করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের সৌন্দর্য খুবই চমৎকার। ৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের প্রথম শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশন ভবনের সামনে রয়েছে তার সমাধিস্থল। রাজশাহী শহরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। নদীর পাড়ে টি-বাধ, আই বাধে বসে নদীর রুপ প্রতিদিন উপভোগ করেন হাজারো মানুষ।
রাজশাহীর আশেপাশেই আরো যা দেখবেন:
রাজশাহী শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার এবং পুঠিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বদিকে নাটোর রাজবাড়ী। ১৭০৬ সালে নাটোর রাজবংশের উদ্ভব হয়। এই বংশের প্রথম রাজা রামজীবন চৌধুরী। তার পুত্রবধূ ছিলেন বিখ্যাত রানী ভবানী। স্বামীর মৃত্যুর পর বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ রানী ভবানীকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দেন।
এর প্রায় চার কিলোমিটার দুরে দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ী বা উত্তরা গণভবন। আঠারো শতকে এখানে ছিলো দিঘাপাতিয়া মহারাজার বাস। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান এটিকে গভর্নর ভবন হিসেবে উদ্বোধন করেন। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানে মন্ত্রীসভার বৈঠক আহবান করেন। তখন থেকে রাজবাড়ী উত্তরা গণভবন নামকরণ করা হয়।
মহাস্থানগড়:
রাজশাহী শহর থেকে ১৩০ কিলোমিটার পূর্বদিকে প্রাচীন বাংলার রাজধানী মহাস্থান গড় অবস্থিত। যিশু খ্রিস্ট্রের জন্মের আগে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল। এখানে প্রাচীন বাংলার লোকগাঁথা বেহুলা-লক্ষীন্দরের বাসরঘর ছিল। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার:
রাজশাহী শহর থেকে ১০২ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। প্রাচীন আমলে এখানে ছিল বৌদ্ধদের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
সোনামসজিদ:
রাজশাহী শহর থেকে ৮৩ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে শিবগঞ্জে দেশের অন্যতম প্রাচীন সোনা মসজিদ অবস্থিত। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের শাসনামলে ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে ওয়ালী মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। সুলতানী স্থাপত্যের রত্ন বলা হয় এই মসজিদকে।
রাজশাহীতে থাকা খাওয়া:
রাজশাহী শহরে রয়েছে বেশ কিছু নামি আবাসিক হোটেল। এর মধ্যে রাজশাহীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে রয়েছে চারতারকা হোটেল গ্র্যান্ড রিভারভিউ। এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া রয়েল রাজ, হোটেল এক্স, হোটেল নাইস, হোটেল মুন, হোটেল মুক্তাসহ বেশ কিছু হোটেলে রাত্রী যাপন করতে পারবেন। রাজশাহী সিটিহাট কিংবা নওহাটায় গিয়ে গরুর মাংসের কালাভুনা খেতে পারেন। মড়মড়িয়ায় গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত হাঁসের মাংসের কালাভুনার স্বাদও নিতে পারেন একদিন। এছাড়া শহরের বিভিন্ন রেঁস্তোরা ঘুরে খেতে পারেন পদ্মানদীর টাটকা মাছ।