২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এরদোয়ান দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৮ সালে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে জানা যায় যে এরদোয়ান আগামীতেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকতে চান। সেটি থাকতে হলে তাঁর এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় থাকার কৌশলের কথা ভাবছেন।
এমন এক পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) তার দলের সদস্যদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য ভোট আহ্বান করে, সেখানে তাদের দলের ১৬ লাখ সদস্যসহ প্রায় দেড় কোটি নাগরিক ইমামোগলুকে ভোট দেন। এর মাধ্যমে সিএইচপি তাদের দল থেকে তাঁর প্রার্থিতা নিশ্চিত করে। তার মানে আগামী নির্বাচনে সিএইচপির নেতৃত্বে এরদোয়ানবিরোধী যে মোর্চা গঠিত হবে তিনিই হবেন তাঁর প্রার্থী। রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শে বিশ্বাসী আধুনিক তুরস্কের জনক ও অবিসংবাদিত নেতা কামাল আতাতুর্কের রাজনৈতিক দল।
ইমামোগলু হচ্ছেন তুরস্কের দ্বিতীয় প্রধান শহর ইস্তাম্বুলের তৃতীয় বারের নির্বাচিত মেয়র এবং একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা। তিনি যদি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে এরদোয়ানের জন্য পুনর্নির্বাচিত হওয়ার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সে কারণে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরদোয়ান তাঁর পথে থাকা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাঠ থেকে সরিয়ে ফেলতে চান।
রিপাবলিকান পার্টি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন চূড়ান্ত করার পরপরই এরদোয়ান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তার করার আগের দিন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার সনদও বাতিল করা হয়। সেটির কারণ হচ্ছে তুরস্কের নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হলে তাঁকে উচ্চশিক্ষিত হতে হয়। অতএব তিনি যেন নির্বাচন না করতে পারেন সে জন্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও কেড়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাঁকে মেয়রের পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু ইমামোগলুকে নয়, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আরও ১০৫ জন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে রেখে, জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও কুর্দি সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আদালত খারিজ করে দিয়েছে। যদিও ইমামোগলু তাঁর বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন। এবং তিনি বলেন, একনায়ক এরদোয়ানের কাছে কোনোভাবেই নতিস্বীকার করবেন না। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তাঁর মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে বলেন। তিনি কারাগার থেকে এক্সে বলেন, ‘আমি একটি শুভ্র বস্ত্র পরে আছি, সেখানে আমি কোনো দাগ লাগাতে দেব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তুরস্ক আজ একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হয়েছে।’
তাঁর মুক্তির দাবিতে রাজধানী আঙ্কারাসহ ৫০টি শহরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। ১৯ মার্চ থেকে উত্তাল হওয়া এ আন্দোলনে এক সপ্তাহেই প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে– ২০১৩ সালের গেজি পার্ক বিক্ষোভের পর এটিই ছিল বর্তমান সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন।
ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদের আন্দোলনে শুধু তাঁর দলের নেতা-কর্মী-সদস্যরাই আন্দোলন করছেন না, সাধারণ মানুষও সেই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছে। বিবিসি’র এক সংবাদ প্রতিবেদনে তেমনটিই দাবি করা হয়েছে। এই প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী জনৈক নাগরিক বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক কারণে বিরোধী দলকে সমর্থন করছি না, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য প্রতিবাদে নেমেছি। আমি এখানে স্বাধীনতার জন্য, ন্যায়বিচারের জন্য এসেছি। তুরস্কের জনগণ স্বাধীন, তারা এসব মেনে নেবে না। এটি আমাদের স্বভাব ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।’
সিএইচপি নেতা অজগুর ওজেল অবিলম্বে ইমামোগলুর মুক্তির দাবি জানান এবং তাঁর বিচার কার্যক্রমকে সরাসরি সম্প্রচারের আবেদন জানান। তিনি এক টেলিভিশন বিতর্কে এরদোয়ানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা জনশৃঙ্খলা বিরোধী কোনো কাজ করছে না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছে; কিন্তু পুলিশ বিক্ষোভ দমনে বেপরোয়া হয়েছে, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে। তিনি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন। তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।
২০২৪ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সিএইচপি সারাদেশে অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো ফলাফল করে। এমন কী এরদোয়ানের একে পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোতেও তারা বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ ঘটনার পরই এরদোয়ানের টনক নড়ে এবং তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে কণ্টকমুক্ত করতে বিরোধী নেতাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও দমন করতে চেষ্টা করছেন।
হঠাৎ ফুঁসে ওঠা তুরস্কের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদন বলছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র ইমামোগলুকে প্রতিহিংসাবশত পরিকল্পিতভাবে কারাবন্দি করেছেন এবং বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন।
ফ্রান্স ইমামোগলুসহ বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার গণতন্ত্রের ওপর গুরুতর আক্রমণ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের মুখপাত্রও ইমামোগলুর গ্রেপ্তারকে অগ্রহণযোগ্য বলে নিন্দা জানিয়েছেন। এমন কি এ ঘটনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে বলে ইউরোপের নেতারা সে কথাও বলছেন।
দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকরা গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে নানা ষড়যন্ত্র, কূটকৌশল ও নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয়। জনআকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের করুণ পতনকেই ত্বরান্বিত করে। কর্তৃত্ববাদী ও একনায়ক হয়ে ওঠা এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তুরস্কের চলমান বিক্ষোভ কি সেই দিকেই যাচ্ছে? শিগগিরই হয়তো সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
ড.
মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত রস ক গ র প ত র কর এরদ য় ন র গণতন ত র র জন ত ক ত রস ক র স এইচপ ন র জন ন ত কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমাদের রাজনীতিতে ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। দুঃসময়েও তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় সমাজকল্যাণ ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এভাবেই স্মৃতিচারণা করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবার ভেতর আলো জ্বেলেছেন—এমন মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। তাঁদের সুস্থ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খালি হাতে খালি পায়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। দেশটাও গত ৫০ বছরে গড়েই উঠল না। গণতন্ত্র, সাম্য, সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার—সবই আড়ালে থেকে গেল। আমাদের রাজনীতি নিশ্চয় ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেই রাজনীতি ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে।’
শারমীন এস মুরশিদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংস্কৃতি বিরাজমান, সেটির পরিবর্তন ঘটেনি। তরুণদের এই শিক্ষাটা মাথায় রাখতে হবে। পেছনের পচে যাওয়া প্রথাগুলো গ্রহণ করে রাজনৈতিক দল গড়তে চাইলে ভুল হবে। আদর্শের জায়গায় দাঁড়াতে হবে। এ জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পথ অনুসরণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে ওই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এই সভার মাধ্যমে গতকাল সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের হৃদয়ে বিচিত্র রেখা এঁকে গেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই বিষয়টি তরুণ প্রজন্মের কাছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে অক্ষয় অমর করে রাখবে।’
স্মরণসভায় বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম