প্রস্তাবিত নাগরিক নিবন্ধন কমিশন কি বিতর্ক তৈরি করবে?
Published: 27th, March 2025 GMT
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদ ইত্যাদি নিবন্ধন এবং ইউনিক আইডিসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি স্থায়ী নাগরিক নিবন্ধন কমিশন (সিআরসি) গঠন করতে যাচ্ছে। এ খবর থেকে এটিও জানা যায় যে, উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতোমধ্যে ওই কমিশনের সম্ভাব্য কাঠামো, কার্যক্রম ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সংবলিত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেছে, যা নিয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৎপরতার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, উল্লিখিত কমিশন গঠনের বিষয়টিকে সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়ে খুবই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
এখন কথা হচ্ছে, যেসব কাজ সম্পাদনের কথা বলে ওই কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে কাজগুলো সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ও হয়রানিমুক্ত ব্যবস্থার অধীনে সম্পন্ন করার জন্য এরূপ একটি কমিশন গঠন সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত কিনা, তা কি যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে? নাকি এনআইডি সেবা আগের মতো নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে যাবে নাকি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অধ্যাদেশ ২০২৩-এর বিধান অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হবে মর্মে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সে বিতর্ককে প্রশমনের জন্যই এটি করা হয়েছে? প্রশ্নটি কেন উঠল সেটি এবং উল্লিখিত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য সিআরসি গঠন কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা হওয়াটা জরুরি বলে মনে করি। কারণ, নানা অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের ভারে বাংলাদেশের রাষ্ট্র খাতের এমনিতেই ন্যুব্জদশা। তার ওপর যদি আগে থেকে চলে আসা একটি পুরোনো কাজের জন্য নতুন করে এনআরসি’র মতো আরেকটি মাথাভারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয়ই শুধু বাড়বে না, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যাও নিশ্চিতভাবেই বাড়বে এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুনতর জটিলতার সৃষ্টি হবে।
এনআইডি-সংক্রান্ত কার্যক্রম গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন কমিশনের আওতাতেই চলে আসছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে অনেকটা হঠাৎ করে এ দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্তকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কাজটি দীর্ঘদিন থেকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় চলে আসার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে আইডি কার্ডের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন এটি তাদের নিজেদের আওতাতেই রাখতে চায়, যে দাবি তাদের প্রতিনিধি গত ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও উত্থাপন করেছেন। তদুপরি এ দাবি পুনর্ব্যক্ত করে গত ৯ মার্চ তারা মন্ত্রিপরিষদের কাছে পুনরায় একটি চিঠিও পাঠিয়েছে। অন্যদিকে, এনআইডি কার্ড প্রদানের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্ত করার কারণটি মোটেও বোধগম্য নয়। কারণ, নাগরিক মাত্রেরই, এমনকি তিনি যদি চিহ্নিত বা দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও হন, এনআইডি কার্ড পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় এনআইডি কার্যক্রম কার আওতায় সম্পন্ন হবে– এ নিয়ে উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে নতুন করে নাগরিক নিবন্ধন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এনআইডি প্রদানের কাজটি উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের কেউই করে না, করে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো, যেটি বাংলাদেশেও হওয়া উচিত। ফলে এ কাজের জন্য নতুন করে কমিশন (সিআরসি) গঠন না করে কাজটি কীভাবে ক্রমান্বয়ে পুরোপুরিভাবে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা যায়, তা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করি।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবেই স্থানীয় সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও সে ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখানে এটি চালু হয়েছে পাসপোর্ট ও এনআইডি প্রদান-সংক্রান্ত কাজের শর্তের অংশ হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে নয়। আসলে একে নিয়মিত বাধ্যতামূলক নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে চালু করা প্রয়োজন। এ কাজের জন্য সিআরসি করা হলে তা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও স্বনির্ভর করে তোলার চিন্তাভাবনাকে আরও পিছিয়ে দেবে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিক ও আমলাদের কেউই নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী হতে দিতে চান না। এ অবস্থায় রাজধানীকেন্দ্রিক সিআরসি গঠন করা হলে রাজনীতিক ও আমলাদের ওই হীনআকাঙ্ক্ষাই আরও প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যাবে বৈকি! মোটকথা, সিআরসি গঠন পরিপূর্ণভাবেই সংবিধান নির্দেশিত স্বনির্ভর-শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলাসংক্রান্ত ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত নিবন্ধন ব্যবস্থাটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি কাজ। জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের মতো এটিও যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সরকারের আওতায় ন্যস্ত করা উচিত বলে মনে করি। এনআরসি’র আওতায় ইউনিক আইডি প্রদান-সংক্রান্ত যে সেবা সহায়তার কথা বলা হচ্ছে, সেটি বস্তুত আইডি কার্ড সেবারই সম্প্রসারিত অংশ। ফলে এটিও যে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকা উচিত, তা বলাই বাহুল্য। তারপরও বলতে হচ্ছে এ কারণে যে, সিআরসি গঠনের যুক্তি হিসেবে ইউনিক আইডি প্রদানকেও একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যা ধারণাগতভাবে একেবারেই সঠিক নয়।
তারপরও যদি উল্লিখিত বাস্তবতা এবং তথ্য ও যুক্তিকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার সিআরসি গঠনে অটল থাকে, তাহলে একেবারে প্রথমেই তাকে যে সমস্যায় পড়তে হবে তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যা। কারণ, মাঠ পর্যায়ে সিআরসির কোনো বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে উল্লিখিত তথ্যের জন্য তাদের শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এতে করে সমন্বয়ের সমস্যাই শুধু বাড়বে না– পুরো প্রক্রিয়াটিই এক বিদঘুটে জটিল আকার ধারণ করবে। যদি বলা হয় যে, সিআরসি সারাদেশে তার বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, তাহলে সেটি হবে মাথাভারী প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাস্তব চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের আওতায় যেকোনো নতুন কমিশন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মানেই রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, যা ইতোমধ্যে সামন্ত যুগের রাজসিক কায়কারবারকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাজেটের আওতায় বাংলাদেশের ‘রাজ কর্মচারীদে’র পেছনে ব্যয়িত অর্থের হিস্যা এখন প্রায় ৪৩ শতাংশ। সিআরসি গঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয় এটিকে আর বাড়াতে চাইবেন না। সরকারের সংস্কার কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য তো রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা জনসেবাকে জটিলতামুক্ত করা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় জোরদারকরণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আনা। কিন্তু সিআরসি গঠনের মধ্য দিয়ে এসবের মধ্যকার সবক’টিই লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আবু তাহের খান: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন গর ক স থ ন য় সরক র র উল ল খ ত র আওত য় ব যবস থ র জন য মন ত র সমস য স আরস গঠন র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রাণহানি বেড়ে ১৭০০, উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতি
মিয়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাণহানি বেড়ে অন্তত ১ হাজার ৭০০ জনে দাঁড়িয়েছে। ধ্বংসস্তূপে জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তিদের খোঁজে চলছে উদ্ধার অভিযান। তবে বেশির ভাগ এলাকায় স্থানীয় লোকজনই দলবেঁধে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। উদ্ধারকাজেরও গতি কম। বিভিন্ন দেশ উদ্ধারকর্মী পাঠালেও তাঁরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে যেতে বাধার মুখে পড়ছেন। কারণ, ভূমিকম্পে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
শুক্রবার দুপুরে মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আট দেশে একসঙ্গে ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয় মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে। এ কারণে মান্দালয়েই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ৭ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে থাইল্যান্ডে অন্তত ১৭ জন মারা গেছেন। দুই দেশে হাজারো ভবন ধসে পড়েছে। সড়ক ও সেতু ভেঙেছে অনেক। বিদ্যুৎ সরবরাহেও অচলাবস্থা চলছে।
গতকাল রোববার মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং জানান, ভূমিকম্পে অন্তত ১ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু ও সাড়ে ৩ হাজার আহত হয়েছেন। নিখোঁজ ৩০০ জন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মরদেহ বের করে আনছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল মিয়ানমারের মান্দালয়ে