ছবি: ফেসবুক থেকে

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ভাগ্য ফেরাতে বিদেশ গিয়ে ফিরছেন আরও নিঃস্ব হয়ে

প্রতিবছর নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার অনেকে। সম্পদ হারিয়ে সুন্দরবনের পাশের এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ ভাগ্য ফেরাতে ধারদেনা ও জমি বিক্রি করে যান বিদেশে। কাজ না পেয়ে প্রতারিত হন, শ্রম দাসত্বের শিকার হন কেউ কেউ। এরপর দেশে ফিরে আসেন আরও নিঃস্ব হয়ে।

শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের আবদুল্লাহ রুবেল এমনই একজন। একটি চিংড়িঘেরের আয়ে তাঁদের সংসার চলত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এরপর ঘেরটি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ২০১৯ সালে যান ব্রুনেই। সেখানে গিয়ে কোনো কাজ পাননি। এক বাংলাদেশির বাড়িতে গৃহস্থালি সব কাজের বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কোনো বেতন পেতেন না। ৯ মাস পর আবারও ধার করে টিকিট কিনে দেশে ফেরেন।

আবদুল্লাহ রুবেল প্রথম আলোকে বলেন, সব হারিয়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে আরও সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সেই ঋণ শোধ করে এখনো ঘেরটি উদ্ধার করতে পারেননি। এলাকায় কোনো আয়ের ব্যবস্থা নেই। একেক সময় একেক কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন এখন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু সাতক্ষীরা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য এলাকা ছাড়েন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণাতেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। ‘এক্সপোজড অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড: ক্লাইমেট চেঞ্জ, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মডার্ন স্লেভারি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটি যৌথভাবে করেছে তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (আইআইইডি)।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দুই জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ১০টি ও সিলেটের গোয়াইনঘাটের ৯টি ইউনিয়নের মোট ৩৩টি গ্রামে জরিপ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধাপে করা গবেষণায় ৬৪৮টি পরিবারে জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পরিবারে অভিবাসী পাওয়া গেছে।

ঋণগ্রস্ত হয়ে বাধ্য হন দাসত্বে

গবেষণা বলছে, যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের অসহায়ত্ব বেশি। ঋণ করে বিদেশে যাওয়ায় যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হন তারা। এ ছাড়া পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর তাড়নায় মেনে নেন অমানবিক কাজের চাপ। এতে তারা আধুনিক দাসত্বের শিকার হন। গবেষণায় আধুনিক দাসত্বের নানা নমুনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে শ্রমিকদের বেতন কম দেওয়া, বেতন বন্ধ রাখা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, চলাফেরায় বিধিনিষেধ দিয়ে রাখা। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দাসত্বের নমুনার মধ্যে অন্তত একটির মুখোমুখি হয়েছেন ৯৯ শতাংশ শ্রমিক; আর আধুনিক দাসত্বের নমুনার মধ্যে পাঁচটির বেশি আচরণ মোকাবিলা করেছেন ৮১ শতাংশ শ্রমিক।

ওকাপ ও আইআইইডির গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মানুষ গড়ে খরচ করেছেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ টাকা সংগ্রহ করেছে জমি বিক্রি করে; আর ১৮ শতাংশ নিয়েছে চড়া সুদের ঋণ।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০২২ সাল থেকে বিদেশে কর্মসংস্থান ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। টানা দুই বছর প্রতি মাসে এক লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিদেশে। গত বছর এটি কিছুটা কমলেও মাসে গেছেন ৮০ হাজারের বেশি কর্মী। এ বছরও যাচ্ছেন একই হারে। তবে এঁদের অনেকেই গিয়ে কাজ না পেয়ে বা প্রতারিত হয়ে ফিরে আসছেন। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের কোনো তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে যারা আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফিরে আসেন, তাঁদের হিসাব পাওয়া গেছে। নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া এসব প্রবাসী কর্মীর কাছে পাসপোর্ট থাকে না। পুলিশের হাতে আটক হয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন তাঁরা। গত বছর এভাবে দেশে ফিরে এসেছেন প্রায় ৮৯ হাজার কর্মী। আগের বছর একইভাবে ফিরেছেন ৮০ হাজারের বেশি কর্মী।

দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে ফিরছেন

শ্যামনগরের হাসান গাজী ভারত হয়ে কুয়েতে গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন। ভারতে থাকতেই তাঁর বাড়ি বন্যায় ভেসে যায়। পরিবারের অবস্থার উন্নতির আশায় কুয়েতে ৪ বছর বিভিন্ন কাজ করেছেন। এরপর পুলিশের হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা ও ঝড়ে বারবার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে আর্থিক চাপে পড়ে পরিবার। বিদেশে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এখন ঢাকার কেরানীগঞ্জে অটোরিকশা চালান। রিকশার গ্যারেজেই থাকেন। কষ্ট করে সংসার সামলাচ্ছেন।

দেশে ফেরত প্রবাসী কর্মীদের বিভিন্ন সেবা দিতে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি। এ সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ জন প্রবাসীকর্মী খালি হাতে ফিরে আসছেন। এঁদের জামাকাপড় ঠিক নেই, পকেটে টাকা নেই। বাড়ি ফেরার জন্য এক হাজার টাকা করে যাতায়াত খরচ দেওয়া হয় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে।

বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে। তবে ফিরে আসা কর্মীদের নিয়ে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। করোনার পর দেশে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে খুব বেশি কর্মী সুফল পাচ্ছেন না। এ ছাড়া জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে আলাদা কোনো কার্যক্রম নেই কোনো সংস্থার।

ওকাপ চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকে বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। গিয়ে প্রতারিত হয়ে দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে ফিরছেন। তাঁদের দায়িত্ব উন্নত দেশগুলোকে নিতে হবে। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগের দায় তাদের, বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশ সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ