বিশ্ব অর্থনীতি কতটা ‘অস্ত্রায়ণ’ সহ্য করতে পারে
Published: 27th, March 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর আগের প্রশাসন, অর্থাৎ বাইডেন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করতে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছে। তাই তিনি (ট্রাম্প) এই ‘অস্ত্রায়ণ’ বন্ধ করার ঘোষণা দেন। সমালোচকেরা এটিকে ট্রাম্পের নিছক একটি চটকদার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখলেও তাঁর সমর্থকেরা মনে করেন, রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের আড়ালে আরও গভীর একটি বাস্তবতা রয়েছে। সেটি হলো বিশ্বরাজনীতিতে অর্থনীতি, জ্বালানি সরবরাহ, বাণিজ্য পথ এবং আর্থিক লেনদেনও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা অনেক পুরোনো। ১৯৪৫ সালে অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট ও.
একইভাবে ১৯৮০-এর দশকে ডেভিড এ বল্ডউইন তাঁর গবেষণায় দেখান, নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক সহায়তা বা বাণিজ্য–সুবিধা প্রদানও অনেক সময় সরাসরি সামরিক শক্তির মতো রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হতে পারে।
আরও পরে এসে গবেষক এডওয়ার্ড লুটওয়াক যুক্তি দেন, শীতল যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে সামরিক লড়াইয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করতেন, যদি দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়, তবে যুদ্ধ বা সংঘাত কমে যাবে। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে এই ধারণার বিরোধিতা শুরু হয়। সমালোচকেরা বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক আসলে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে এবং এতে নতুন ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। সহজভাবে বললে, দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শুধু সহযোগিতা বাড়ায় না, বরং এটি একটি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
বিশ্বরাজনীতিতে নীতিগুলো সব সময় তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। শীতল যুদ্ধের সময় অ্যালান পি ডবসন লক্ষ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক সংঘাতের বদলে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ চালিয়ে গেছে। তারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক নীতিগুলোকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সুসান স্ট্রেঞ্জের কাঠামোগত ক্ষমতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, উৎপাদন বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তবে সেই রাষ্ট্র অন্যদের জন্য শর্ত ঠিক করে দিতে পারে এবং এর ফলে সরাসরি বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
২০১৩ সালের শেষ দিকে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করতে ছোট ছোট সশস্ত্র দল পাঠায়, তখন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের টমাস রাইট বলেছিলেন, পারস্পরিকভাবে লাভজনক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কগুলো আসলে কৌশলগত দুর্বলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে। এর তিন বছর পর ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদের মার্ক লিওনার্ড ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে অস্ত্রায়ণ করা’ শিরোনামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে তিনি সতর্ক করেছিলেন, একসময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য প্রশংসিত হওয়া বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক (যেমন সীমান্ত পেরিয়ে বিনিয়োগ, বাণিজ্য রুট ও ডিজিটাল অবকাঠামো) সহজেই রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে ব্যবহৃত হতে পারে।
এর পর থেকে তথাকথিত হেলসিঙ্কি স্কুলের গবেষকেরা (মিকা আলতোলা, সোরেন শোলভিন ও মিকায়েল উইগেল) ‘ভূ–অর্থনৈতিক করিডর’ সম্পর্কে আলোচনা করছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, শিপিং রুট ও সমুদ্রের তলদেশে থাকা যোগাযোগ কেব্লগুলো কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি দেশকে প্রতিপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারে।
এদিকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ট্রেজার’স ওয়ার গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জুয়ান জারাতে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে আর্থিক নেটওয়ার্কগুলো সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ কার্যক্রম মোকাবিলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। একইভাবে রবার্ট ডি ব্ল্যাকউইল ও জেনিফার এম হ্যারিস দেখান, ব্যাংকিং বার্তা আদান-প্রদানের স্বীকৃত মাধ্যম সুইফট ব্যবহারের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব।
২০১৯ সালে হেনরি ফারেল ও আব্রাহাম নিউম্যান তাঁদের গবেষণায় দেখান, যারা তথ্য ও আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রীয় নোড নিয়ন্ত্রণ করে, তারা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে বা নজরদারি চালাতে সক্ষম হয়। একই সময়ে অ্যান্থিয়া রবার্টস, হেনরিক চোয়ের মোরাস ও ভিক্টর ফার্গুসন দেখান, অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলগত নীতির সংমিশ্রণে একটি নতুন ভূ–অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে সামরিক কৌশলের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণার এই প্রেক্ষাপট এমন এক সময়ের মধ্যে পড়ছে, যখন বৈশ্বিক সংযোগ দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞার কৌশল আরও উন্নত করেছে। অন্যদিকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ঋণনির্ভর বন্দর, রেলপথ ও শিল্পাঞ্চলের নেটওয়ার্ক তৈরি করে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকায় একটি নির্ভরশীলতার জাল বিস্তার করেছে।
চীন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক লিথিয়াম পরিশোধনের ৭০ শতাংশ চীনের দখলে থাকায় তারা বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্পের জন্য একটি বড় সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে এবং ইতিমধ্যে এই অবস্থানকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু একটি উদাহরণ। আসলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। ইউরোপেও রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পাশাপাশি আমেরিকান পেমেন্ট সিস্টেম ও চীনা টেলিকম পরিষেবার বিকল্প খোঁজার প্রতিযোগিতা চলছে।
সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা নীতিনির্ধারকদের জন্য সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে সহজতর উপায়। তবে এই কৌশলের জন্যও মূল্য চুকাতে হয়। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ বাড়ে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশগুলো বাণিজ্যনীতি কঠোর করবে এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সীমিত করবে।
● কার্লা নরলফ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন টওয় র ক র জন ত ক ক শলগত আর থ ক র জন য র ওপর ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের আমলে এশিয়াকে টিকতে হলে যা করতে হবে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কারণে এশিয়ায় অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের সুবিধাবাদী কূটনীতি, সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতি এবং অনিশ্চিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো দেশ এককভাবে তেমন কিছু করতে পারবে না। তবে এশিয়া যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ থাকবে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো বেশ কঠিন। দীর্ঘদিনের মিত্রদের প্রতি ট্রাম্পের ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং ভয় দেখানোর কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের বহু পুরোনো নিরাপত্তা অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অথচ এই বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক এশীয় দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও বিপজ্জনক হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো, যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন এবং কৌশলগত সহযোগী তাইওয়ান এ কারণে শঙ্কিত যে ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কোনো সমঝোতা করে তাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারেন।
এদিকে ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনের আগ্রাসী প্রচেষ্টা (যার অংশ হিসেবে তিনি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে চাপ দিচ্ছেন) বৈশ্বিক বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এতে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আসিয়ান দেশগুলোর মতো যেসব এশীয় অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রাখে, তাদের প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
মুদ্রার মূল্যহ্রাস হয়তো শুল্কের কিছুটা প্রভাব কমাতে পারে। কিন্তু যদি ট্রাম্প প্রশাসন সত্যিই ডলার দুর্বল করার পদক্ষেপ নেয়, তাহলে উদ্বৃত্ত রাখা দেশগুলোর এই সামান্য স্বস্তিও থাকবে না এবং তাদের বাণিজ্য ভারসাম্য আরও খারাপ হবে। কেউ কেউ হয়তো পাল্টা শুল্ক আরোপের কথা ভাবতে পারে, কিন্তু এতে তাদের রপ্তানিনির্ভর শিল্পগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এশীয় দেশগুলো এককভাবে শুধু বাণিজ্য আলোচনাতেই নয়, বরং বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। তবে আসিয়ান, আসিয়ান+ ৩ (যেখানে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে) এবং পূর্ব এশিয়া সম্মেলনের (ইস্ট এশিয়া সামিট) মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৌশলগত ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
ভূ–অর্থনৈতিক বিভাজনের এ সময়ে এশিয়ার দেশগুলো সহজেই বড় শক্তিগুলোর নীতির শিকার হতে পারে। কিন্তু যদি তারা বাণিজ্য অংশীদারত্ব জোরদার করে, আর্থিক সহযোগিতা শক্তিশালী করে, কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত করে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়, তাহলে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। একই সঙ্গে তারা বিশ্ব অর্থনীতির নতুন কাঠামো তৈরির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।পাশাপাশি বাণিজ্য ও আর্থিক সংহতি বাড়িয়ে এশিয়া যদি নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল ও সহনশীল করে তুলতে পারবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বহুপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য অংশীদারদের বৈচিত্র্য আনা। এর অর্থ হলো, প্রথমেই সামগ্রিক ও প্রাগ্রসর আন্তপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারি চুক্তি (কমপ্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে সিপিটিপিপি) আরও শক্তিশালী করা। এই চুক্তি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামকে অন্তর্ভুক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। এর সদস্যসংখ্যা আরও বাড়ানো যেতে পারে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এ চুক্তিতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদেরও এতে যুক্ত করা যেতে পারে।
আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারি (রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে আরসিইপি) চুক্তিকেও (যেখানে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে) আরও কার্যকর করতে হবে।
এর জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালা আরও শক্তিশালী করা এবং সম্ভব হলে ভারতকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি বিবেচনায় আঞ্চলিক বাণিজ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষাবাদী নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে।
এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে তাদের নিজস্ব মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনায় ফিরতে হবে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মিল থাকায় তারা স্বাভাবিক অংশীদার।
চীনকে অন্তর্ভুক্ত করা কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে তাদের আক্রমণাত্মক সামরিক অবস্থানের কারণে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা একটু কঠিন। তবে চীনের বিশাল বাজার ও উন্নত প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বিবেচনায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা জরুরি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক স্বার্থকে গণতান্ত্রিক নীতির ঊর্ধ্বে রাখছে, তখন এশিয়ার দেশগুলোর উচিত বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকে না থাকা।
বাণিজ্যের বাইরেও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর শুরু হওয়া সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। চিয়াং মাই উদ্যোগ (চিয়াং মাই ইনিশিয়েটিভ মাল্টিল্যাটেরালাইজেশন, সংক্ষেপে সিএমআইএম) সংকটের সময় আসিয়ান+ ৩ (চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ আসিয়ান দেশগুলো) দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়। এই সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ ছাড়া এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়গুলোকে একসঙ্গে কাজ করে আরও কার্যকর আর্থিক স্থিতিশীলতা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এর আওতায় শক্তিশালী সংকট ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, নীতিগত সমন্বয় এবং সুস্পষ্ট যোগাযোগব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। এটি বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ে মুদ্রাবাজার ও আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য ও প্রযুক্তিযুদ্ধ বিশ্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক শিবিরে বিভক্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বড় ধরনের অস্থিরতা আনতে পারে। তবে এ পরিস্থিতি এড়ানোর এখনো সময় আছে। এর জন্য দরকার এমন একটি বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে একাধিক অর্থনৈতিক শিবির থাকবে এবং দেশগুলো একাধিক শিবিরের সদস্য হতে পারবে।
এশিয়ার দেশগুলো যদি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক একীকরণকে উৎসাহিত করে, তাহলেই তারা এ ধরনের একটি কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করতে পারবে।
ভূ–অর্থনৈতিক বিভাজনের এ সময়ে এশিয়ার দেশগুলো সহজেই বড় শক্তিগুলোর নীতির শিকার হতে পারে। কিন্তু যদি তারা বাণিজ্য অংশীদারত্ব জোরদার করে, আর্থিক সহযোগিতা শক্তিশালী করে, কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত করে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়, তাহলে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। একই সঙ্গে তারা বিশ্ব অর্থনীতির নতুন কাঠামো তৈরির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
লি জং ওয়া কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, যিনি এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক–বিষয়ক সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ