বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান একটি অলিগার্কিক শাসনের পতন ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের গভীর কাঠামোগত সংকটগুলোকেও উন্মোচিত করেছে। ছয়টি বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে মতামত জমা দিয়েছে। রাজনৈতিক সংলাপ বা সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দল ও অংশীজনদের মধ্যে একমত এবং ভিন্নমত থাকাটাই স্বাভাবিক। এই ভিন্নমতগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করেই একটি সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করা সম্ভব। 

অলিগার্কিক শাসনব্যবস্থা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো জনগণের ম্যান্ডেট। জনগণই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তাদের আস্থা ও সমর্থন ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।

জনগণের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও অপরিহার্য। নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অর্জন সম্ভব। একটি বৈধ ও জনসমর্থিত নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো দেশই স্থবিরতা, প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় এবং ক্রমবর্ধমান জন-অসন্তোষের ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারে না।

জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার আগে একটি সর্বসম্মত সংস্কার এজেন্ডা প্রণয়নও জরুরি। এর জন্য বিভিন্ন পক্ষের সমঝোতা দরকার। সমঝোতা মানে হলো মতপার্থক্য বা বিরোধ মেটানোর জন্য বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া। এখানেই ‘ছাড়’ ও ‘সমাধান’-এর জন্য মাথা ও মনের সংমিশ্রণ দরকার। রুটিন কাজের বাইরে বর্তমান প্রশাসনের প্রধান কাজ সঠিক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়ার জন্য একটি বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর। এতে নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা রোধ সম্ভব। 

নির্বাচনের আগে মোটাদাগে ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির সমঝোতা লাগবে। প্রথমত, ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা, বায়োমেট্রিক ভোটার যাচাইকরণ এবং ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতি দরকার। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে একটি স্বচ্ছ ও বহুদলীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো গড়ে তুলতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, একটি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো বেশি দরকার। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণও প্রয়োজন। চতুর্থত, সংস্কারের মাধ্যমে বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার অভীষ্ট ফলাফল দিতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন। 

এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের জনগণের বাছবিচারে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকতে পারে, সেগুলো নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক।

কল্যাণরাষ্ট্রের গোড়াপত্তন

কল্যাণরাষ্ট্রের গোড়াপত্তনই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মর্ম ধারণ করতে পারে। একটি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। সর্বজনীন নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নাগরিক রাষ্ট্রের মৌলিক শর্ত।

প্রথমত, শিক্ষা হতে হবে সর্বজনীন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা তথা সব স্তরে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতি সময়ের দাবি। বিশেষ করে মেয়েদের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে বিশেষায়িত চিকিৎসা নিশ্চিতি সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রথম ধাপ।

তৃতীয়ত, বাসস্থান মৌলিক অধিকার। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় সাশ্রয়ী মূল্যে সামাজিক আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চতুর্থত, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির আধুনিকায়ন এবং খাদ্য বিতরণব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজনীয়। পঞ্চমত, জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে মাতৃ, শিশু, যুব বেকার এবং বয়স্ক ভাতা চালু করতে হবে। এই সামাজিক নিরাপত্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই ভাতাসমূহ প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করে বৈষম্য কমাবে।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও বৈচিত্র্যকরণ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। নির্ভরশীলতা কমাতে শিল্প খাতের বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। এ ছাড়া কৃষি খাতকে আধুনিকায়ন করে খাদ্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে যথাযথ শ্রম আইন প্রণয়ন এবং তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি আশু কর্তব্য।

শিল্পায়নের মাধ্যমেই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। যুব বেকারত্ব কমাতে এবং জনমিতিক সুবিধা অর্জনে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এতে অভিবাসী আয় বৃদ্ধির নতুন দরজাও খুলে যাবে। সবারই জানা যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করতে হলে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে সহজ করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো লাগবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বহুগুণে বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়নে বিশেষ প্রণোদনা এবং ঋণসুবিধা প্রদান করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের উত্থান

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি বিনিময় বাড়লে এই অঞ্চল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। সমুদ্র অর্থনীতি, নীল অর্থনীতি এবং জ্বালানি সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করা সম্ভব। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আঞ্চলিক যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে বাণিজ্য ও পর্যটন বাড়বে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশের সনাতন বাণিজ্য-সম্পর্কের দেশ বা জোট তথা চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন রপ্তানির বাজার বাড়াতে হবে। নতুন নতুন মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল চুক্তির দরকার। তবে এই বাণিজ্য চুক্তিগুলো করার সময় দেশের স্বার্থ এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে।

জনগণের হাতেই ভবিষ্যৎ

যুগে যুগে বাংলাদেশের জনগণই ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। প্রতিটি গণ–আন্দোলনই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। জনগণের ওপর আস্থাই আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্বল। তাদের সিদ্ধান্তে ভুল হয়নি। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন দল বা জোটকে নির্বাচিত করবে। একটি ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জনগণের ম্যান্ডেট পথের দিশা। কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাগরিকের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। আর এই বাংলাদেশ হতে পারে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অগ্রণী দেশ।

ড.

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জনগণ র ম য ন ড ট ন শ চ ত কর র জন ত ক ব যবস থ র জন য কল য ণ ত করত সরক র দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের রোডম্যাপ চাই

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা ছিল, বল প্রয়োগভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নাগরিক অধিকারভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন। কিন্তু অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকে রাখার ঘটনা একটা ভয়ানক বার্তা দিচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য সন্দেহভাজন যে কাউকে আটক করতে পারে। এই আইন বাতিলের কথা বিএনপি ’৯১-এর নির্বাচনী ইশতেহারে রাখলেও ক্ষমতায় গিয়ে তা অক্ষত রাখে। বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি সংসদ এই আইন বাতিল না করে তা রক্ষা করে গেছে। 
জুলাই আন্দোলন বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সব জনবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী আইন ও ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের দাবি জানায়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কাঠামোর বিলুপ্তি দাবি করে। অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে হবে বল প্রয়োগের ভিত্তিতে নয়; বরং জনগণের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারকে ভিত্তি করে। জুলাই ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লেমেশনে স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা থাকার কথা ছিল– বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হবে জনগণের সার্বভৌমত্ব, যা ব্যক্তির মর্যাদা, অধিকার ও বিকাশ নিশ্চিত এবং সুরক্ষিত করবে। এই প্রোক্লেমেশন এখনও হাজির না করতে পারা জুলাইকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। 

একবার ভাবুন– বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, র‍্যাব আইন, ৭০ অনুচ্ছেদসহ সব জবরদস্তিমূলক আইন অক্ষত রয়েছে; সব ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি অক্ষত রয়েছে; আপনি শুধু সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই সরকার কীভাবে আপনার নাগরিক অধিকার, আপনার স্বাধীনতা এবং আপনার মর্যাদা নিশ্চিত করবে? আপনার সংবিধান আবার একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন বা সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র আরোপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে। আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ বা বাধা 
দেওয়ার জন্য সব কঠোর জবরদস্তিমূলক আইন প্রয়োগ করা হবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হলে কোনো অবস্থাতেই, কোনো অজুহাতেই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা যাবে না। রাষ্ট্রের সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে জরুরি অবস্থা মানে সরকারের গদি অরক্ষিত হয়ে পড়া। তাই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করে জরুরি অবস্থা দেয় তারা। 
রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, তা-ই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার উৎস। নতুন গণক্ষমতা মানেই নতুন আইন, নতুন সংবিধান। যারা এখন মৌলিক রাষ্ট্র কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই দ্রুত সংসদীয় নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তারা মূলত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে চাইছেন। তারা বর্ষার এই বিপ্লবকে শুধু ভোট বাক্সে সীমাবদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন।

শেখ হাসিনার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জালিয়াতির নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখা আর জুলাই বিপ্লবীদের রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’কে এক করে দেখিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন বানচাল করতে চাইছেন কিছু রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী। অথচ দুটো এক না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংস্কারপন্থিরা নির্বাচন চাইছেন, কিন্তু তা সংস্কারের পর। আর শেখ হাসিনা কথিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেননি। ফলে যারা দুই বিপরীত বিষয়ের তুলনা দিচ্ছেন, তাদের কথায় বড় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগত বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করেছেন– ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’, যা পাকিস্তান আমলের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মডেল। এখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার এবং পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। যে রাষ্ট্র কাঠামোতে ফ্যাসিবাদ স্তরে স্তরে বিদ্যমান, তার বিলোপ সাধন এই অন্তর্বর্তী সরকার না করলে তা নতুন নির্বাচিত সংস্কার করবে বলে আস্থা রাখা কঠিন। তখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা আর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের অজুহাত তোলা হবে। এ দেশের শাসকগোষ্ঠী ’৭২-এ এসব করেনি, ’৯০-এও করেনি। বরং সংসদ হয়ে উঠেছে জনগণকে নির্যাতন করা আর তাদের অধিকার হরণের আইন প্রণয়নের কেন্দ্র। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচিত সংসদ যেমন ২৭টি সংস্কার প্রস্তাব মানেনি, একই রকম এখনও নতুন সংসদ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে বলে আমাদের আস্থা নেই। 

দুনিয়াজুড়েই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর নতুন সংবিধান করে আগে রাষ্ট্র গঠন বা পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা হয়, তারপর সংসদ বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেওয়া হয়। ইউনূস সরকারকেই তাই রাষ্ট্র সংস্কার ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে হবে এবং রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের রোডম্যাপ দিতে হবে। এ জন্য সাংবিধানিক সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন, নাগরিক অধিকার হরণকারী আইনি কাঠামো উচ্ছেদ বা ব্যাপক সংস্কার, গণবিরোধী আমলাতন্ত্র, জবরদস্তিমূলক নিরাপত্তা সংস্থা, বিজনেস অলিগার্ক নিয়ন্ত্রিত লুটেরা অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈপ্লবিক সংস্কারের রোডম্যাপ দিতে হবে। বল প্রয়োগের ভিত্তিতে নয়, বরং জনগণের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে এবং তার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের রোডম্যাপ দিতে হবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পর একটি সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। 

ড. যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে বিএনপিই দেশ সংস্কার করবে: রিজভী
  • জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে যা যা থাকা উচিত
  • খুনিদের বিচার ও সংস্কার ছাড়া জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না: জামায়াতের আমির
  • দেশের জন্য কাজ করছেন নাকি আ’লীগকে পুনর্বাসনের অপেক্ষা
  • জাতীয় পার্টি কোনো সুবিধাবাদী দল নয়, বললেন জিএম কাদের
  • রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের পথ তৈরির আহ্বান এনসিপির
  • অন্তর্বর্তী সরকারের কত দিন ক্ষমতায় থাকা যুক্তিসংগত
  • রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের রোডম্যাপ চাই
  • এনসিপির কাছে প্রত্যাশা
  • সয়াবিন তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি গণসংহতি আন্দোলনের