হাওর, বিল এবং নদীর পারে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা উঁচু ভূমিকে বলা হয় কান্দা। হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কান্দার। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে উদ্বেগজনক হারে কমছে কান্দার অস্তিত্ব। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় গেল দুই দশকে কান্দার বন-বাদালি এবং মাটি কেটে সর্বনাশ করা হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে হাওরের স্থলজ ও জলজ প্রাণী। হাওর বিধ্বংসী ভেকু মেশিনের তাণ্ডবে একের পর এক কান্দা রূপ নিচ্ছে ডোবা-নালায়। হাওরের প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের এই বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে। অপরিকল্পিতভাবে কান্দা কাটার মাটিতে বাঁধ নির্মাণ করে সাময়িক ফসল রক্ষা হলেও গোটা হাওর অঞ্চলকে বিপন্ন করা হচ্ছে।
সরকারের অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বার্থেও তছনছ করা হচ্ছে হাওরের বুক। স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, অবাধে কান্দা কাটার এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে না পারলে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হবে হাওর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ছোটখাটো অনেক হাওর আছে, যেগুলোতে ফসল রক্ষা বাঁধ নেই। তবুও মাটি কাটা থেকে রেহাই পাচ্ছে না কান্দাগুলো। ব্যক্তিস্বার্থ এবং সরকারি প্রকল্প উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে কান্দাগুলোকে।
জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, তাহিরপুর ও ধর্মপাশার একাধিক হাওর ঘুরে দেখা যায়, বাঁধ নির্মাণের দায়সারা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে হাওরের বুকে সৃষ্টি করা হয়েছে ক্ষত। প্রতিবছর কান্দা কাটার কারণে ছনেরবাগ, হিজল-করচ, নলখাগড়া ও ঝোপঝাড়ে ভরা উর্বর কান্দা যেন ডোবা-নালায় রূপ নিয়েছে। অতীতের বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি এখন নির্জীব।
হাওরের অনেক স্থানেই ভেকু মেশিন ব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের ধান মাড়াই, খড় শুকানো ও গরু চরানোর শেষ ভরসা এই কান্দা। নদীবেষ্টিত হাওরের যেসব স্থানে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেইসব জায়গার অধিকাংশই প্রায় কান্দাশূন্য। বিবেকহীন মানুষদের এই তাণ্ডবে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। জামালগঞ্জের হাওরে বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, হিজলা গ্রামের পূর্বদিক থেকে নওয়াপাড়া হয়ে মদনাকান্দি শ্মশানঘাটের বিপরীত পারমহালিয়া হাওরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বন্ধ্যত্ব পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানকার নদীতীরবর্তী বাঁধের হাওর অভ্যন্তরের তিন কিলোমিটার অংশের কান্দা কেটে ফেলা হয়েছে।
প্রতিবছর মাটি কাটার কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে হালি হাওরের বদরপুর থেকে হাওড়িয়া আলীপুর তথা পৈন্ডুব বাজার থেকে মামুদপুর হয়ে দুর্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত পতিত ভূমি। এছাড়া মদনাকান্দি থেকে আছানপুর পর্যন্ত হাওর প্রায় কান্দাশূন্য। আছানপুর থেকে হরিপুর হয়ে সুন্দরপুর বিলের কালীবাড়ি বাঁধ পর্যন্ত কান্দা নেই বললেই চলে। এরপরের কালীবাড়ি স্লুইসগেট থেকে উলুকান্দি-যতীন্দ্রপুরের উভয় পাশে কিছু কান্দা এখনও জেগে আছে।
শনি হাওর অংশের বেহেলী থেকে রাধানগর, নান্টুখালী ও লালুরগোয়ালা বাঁধ হয়ে স্লুইস গেট পর্যন্ত হাওরের অনেক কান্দাই কেটে ফেলা হয়েছে। হাওরের মাঝে মাঝে যেসব কান্দা কোনোভাবে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, তাও ধ্বংসের পথে। ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামতে প্রতি বছর হিজল-করচের গোড়ার অংশ ও ঝোপঝাড় কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে। এতে কান্দা নষ্ট হয়ে হাওরের নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওরপারের উঁচু সমতল ভূমিকে কান্দা বলা হয়। প্রকৃতিগতভাবেই এগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। ধানি জমির পাহারাদার হিসেবে জেগে থাকে শত বছরের পুরোনো ওই কান্দা। কৃষকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে হাওরপারের পতিত এই গো-চারণভূমি।
এসব ভূমিতে অযত্নে বেড়ে ওঠে হিজল, করচ, বরুণ, নলখাগড়া, ঢোলকলমি, চাইল্লাবন, বল্লুয়া, বেত, বনতুলসী, বনগোলাপের ঝোপঝাড়সহ গুল্মজাতীয় হরেক প্রজাতির উদ্ভিদ।
হাওরের ওই গাছ-গাছড়া পরিযায়ী-দেশীয় পাখি, সাপ, গিরগিটি, মেছোবাঘ, শিয়াল, বেজি, বনবিড়ালসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বর্ষা মৌসুমে এসব তলিয়ে গেলে দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় কান্দাসমৃদ্ধ এই হাওর। জীববৈচিত্র্যের আধারখ্যাত কান্দা কেটে গোটা হাওর অঞ্চলকে বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন করা হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন হাওরপারের কৃষকেরা।
তাহিরপুরের সুলেমানপুর গ্রামের কৃষক ও মহালিয়া হাওর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সিরাজুল হক বললেন, প্রতিবছর কান্দা কাটার কারণে সবদিক থেকেই ক্ষতি হচ্ছে। দিন দিন গরু-বাছুরের ঘাস খাওয়ার জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে। ফসল তোলার মৌসুমে ধান-খড় মাড়াই ও শুকানোর জায়গাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। হাওরের এই ক্ষতি কোনো কিছুর বিনিময়ে পোষানো সম্ভব নয়।
তাহিরপুরের পরিবেশকর্মী গোলাম সরোয়ার লিটন বলেন, এক বাঁধ দিতে গিয়ে হাওরের কত রকম সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটি কেউ ভেবে দেখছে না। এই হাওর ও হাওরের কান্দার সঙ্গে জীবন-জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে। কান্দা হচ্ছে হাওর ও কৃষকের নিরাপত্তা বেষ্টনী। জীববৈচিত্র্যের আধার। এই কান্দা কেটে হাওরের ইকো সিস্টেম (বাস্তুতন্ত্র) ধ্বংস করা হচ্ছে। কৃষক ও হাওরের পরিবেশ সুরক্ষায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উচ্চ পর্যায়ের পর্যবেক্ষক দল মাঠ পর্যায়ে পাঠাতে হবে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, বাঁধ রক্ষায় যে কান্দাগুলো কাটা হচ্ছে, সেগুলো হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে থাকে। এভাবে কান্দা কেটে বাঁধ নির্মাণ মানে হাওরের অপমৃত্যু ঘটানোর শামিল। এর মাধ্যমে হাওরে দীর্ঘ ক্ষতের সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাই কান্দা ধ্বংস না করে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
মধ্যনগরের বোয়ালা হাওরপারের কৃষক পরিতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, হাওরে এক সময় অসংখ্য কান্দা ছিল। গত সাত-আট বছর হয় বাঁধের কাজে মাটি নিতে নিতে কান্দা কেটে বিনাশ করা হচ্ছে।
ধর্মপাশার পাইকুরাটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক ইকবাল বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন হয়। প্রশাসনকে অবগত করা হলে, আগেই টের পেয়ে এর সঙ্গে জড়িতরা সটকে পড়ে।’
তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণে বাঁধসংলগ্ন গো-চারণভূমি থেকে মাটি নিতে নিতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গো-চারণভূমির কোনো অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই এখন। এই বাঁধ নির্মাণের কারণে হাওরের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের মাধ্যমে পানির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স সার্ভিসের (সিএনআরএস) সুনামগঞ্জ জেলা সমন্বয়কারী ইয়াহিয়া সাজ্জাদ বলেন, কান্দা থেকে মাটি কেটে বাঁধ নির্মানের কারণে প্রতি বছরই গো-চারণভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এতে করে প্রাকৃতিক উৎসে গো-খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। চাইল্যা, বউল্যা, মটমঠিয়া, নলখাগড়া, বিন্না, বনতুলশী ও গুজাকাটার মতো জলজ বন সংকটাপন্ন। প্রতিবছরই বাঁধ নির্মাণে কান্দার মাটি কেটে ফেলায় বর্ষার ঢেউয়ে মাটি নদীতে পড়ে নাব্য সংকট তীব্র হচ্ছে।
দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের ৭২ বছর বয়সী কৃষক ছত্তার মিয়া বললেন, রাজাপুর থেকে রাঙামাটিয়া পর্যন্ত প্রায় এক মাইল দীর্ঘ কান্দায় একসময় ছনের বাগ ছিল। ছন কেটে নেওয়ায়, ছনের গোড়ায় আবার ডেম দিলেও, তা গরু খেয়ে ফেলে। এতে আর ছন হয় না, ঝোপঝাড়ও নেই।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, সুনামগঞ্জ জেলায় আড়াই থেকে তিন হাজার হেক্টর কান্দা ভূমি আছে, এগুলোতে বন কমেছে। তবে কোনো কোনো কান্দায় হিজল-করচের বাগ আছে এখনও।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হ ওর র প র হ ওরপ র র স ন মগঞ জ চ রণভ ম প রকল প পর ব শ ত বছর
এছাড়াও পড়ুন:
কয়রায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ, বহিষ্কার দাবি
খুলনার কয়রা উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক গোলাম রব্বানীর চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে তাঁকে বহিষ্কারের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রোববার বেলা ১১টায় উপজেলা সদরের তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সাধারণ ছাত্র-জনতার ব্যানারে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বক্তারা সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকায় তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।
মানববন্ধনে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেবব্রত দেবু, খুলনার সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী আবিদ মাহমুদ, খুলনার বিএল কলেজের শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান, জুলাই আন্দোলনে আহত মনিরুল ইসলাম, শিক্ষার্থী একরামুল হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আন্দোলনে অংশ না নিলেও গোলাম রব্বানীকে কয়রা উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। এটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের সঙ্গে বৈষম্যের শামিল। আহ্বায়ক হয়ে গোলাম রব্বানী জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ব্যানারে ইফতার মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যক্তিগতভাবে চাঁদাবাজি করেছেন। তাঁর অনুসারী আবদুর রউফ একটি মাদ্রাসায় চাকরি করলেও ছাত্র সমন্বয়ক বলে দাবি করেন। তাঁর বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারকে ব্যবহার করে তাঁরা দুজন বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে তদবির করেন।
সম্প্রতি এনসিপির ব্যানারে অনুষ্ঠিত ইফতার মাহফিলের দাওয়াতপত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের সঙ্গে আবদুর রউফের মুঠোফোন নম্বর থাকা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ কারণে আহ্বায়কের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ তদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয় মানববন্ধনে।
অভিযোগের বিষয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।