অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে ভারত
Published: 27th, March 2025 GMT
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বার্তা দিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বুধবার ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো পৃথক বার্তায় ভারত একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠিতে দ্রৌপদী মুর্মু বলেছেন, সরকার, জনগণ ও ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বহুমুখী, যেখানে আমাদের সহযোগিতা বাণিজ্য, যোগাযোগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক বিনিময়ের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত। তিনি বলেন, ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি, সাগর ডকট্রিন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ। একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছে ভারত।
প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আজকের দিনটি আমাদের অভিন্ন ইতিহাস ও ত্যাগের স্মারক, যার মাধ্যমে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের ভিত রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথনির্দেশক। সে সম্পর্ক বহুবিধ ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়ে দুই দেশের জনগণের জন্য দৃশ্যমান উপকার বয়ে এনেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এ অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেটি পরিচালিত হবে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির অভিন্ন আকাঙ্ক্ষায় এবং একে অন্যের স্বার্থ ও উদ্বেগের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিনন্দন
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক রুবিও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকার এমন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে, যেখানে জনগণের মতামত প্রকাশের মধ্য দিয়ে আগামীর পথে এগিয়ে যাবে। সেই উজ্জ্বল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে যাত্রায় বাংলাদেশকে সমর্থন করে ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার উন্নয়নে অংশীদারিত্ব অব্যাহত রাখার আগ্রহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। উভয় দেশ নিরাপদ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ জাতি গড়তে যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন মার্ক রুবিও।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই যখন প্রয়োজন
এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিতর্ক আমাদের চিন্তাধারাকে খানিকটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়’ বনাম ‘নির্বাচনে দেরি হলে সংস্কার নয়’– এই বিতর্কে সব রাজনৈতিক দল এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, রাষ্ট্র কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে যেসব জরুরি সংস্কার এখনই প্রয়োজন, সেগুলো থেকে তাদের নজর অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচন– দুটোই প্রয়োজন। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই তা অবশ্যই করা সম্ভব।
বাংলাদেশের জনগণ চায়, সংস্কারের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। তবে দেশের মানুষ বর্তমান জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি।
যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে সংস্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, তারা সংস্কারের অপরিহার্যতাকে খাটো করে দেখছেন। তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে, বাকশাল প্রবর্তন, দু’বারের সামরিক শাসন, ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ এবং দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন কেবল এই দেশের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশসহ সব ক্ষেত্রে নিয়মিত ইতিবাচক সংস্কারের পথই রুদ্ধ করেনি, বরং শাসন ব্যবস্থাকে জনসেবামূলক, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক করার পরিবর্তে শাসকদের অস্ত্রে পরিণত করেছে। কাজেই সংস্কারের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।
অন্যদিকে, যারা সংস্কারকে নির্বাচনের ওপরে স্থান দিচ্ছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব এবং দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে অনুধাবন করছেন না। কেননা, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ও সংসদ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় নির্বাচন জনগণকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেবে, যেখানে তারা সুচিন্তিতভাবে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারবে কে বা কোন দল দেশের নতুন শাসনভার পাবে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে লাগামহীন দুর্নীতি ও অপশাসনের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি জনরোষ সৃষ্টি করেছিল তার কারসাজিমূলক খারাপ নির্বাচনগুলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয়তা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগে কিছুটা বেশি সময় অপেক্ষা করতে রাজি আছে। তবে সেই অপেক্ষারও একটা সীমা আছে।
আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল সরকার গঠন করে না, বরং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করে। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত শব্দ হচ্ছে ‘জবাবদিহি’। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নাগরিকদের করের টাকায় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জনগণকে দমন করার ক্ষমতা রাখে; অথচ এটা জিজ্ঞাসা করার অধিকার জনগণের নেই যে, তারা আদৌ নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও আইন মেনে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা।
এর বাইরেও প্রতিটি পেশায় অল্প কিছু মানুষ সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের সততা ও পেশাদারিত্ব ধরে রেখেছেন এবং প্রতিনিয়ত তারা নানা অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা আমলাতন্ত্র ভেতর থেকে পুরোপুরি পচে গেছে। সমাজে পচন ধরলে রাষ্ট্র কাঠামোতে পচন ধরবেই।
এটি সত্য যে, রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কার্যকর উপায়। অতীতে এটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে দেশের শাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার কমিশন গঠন করায় প্রশংসার দাবি রাখে। সাতটি কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও শুরু করেছে। সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপারিশ ইতোমধ্যে জনগণের সামনে এসেছে। এখন এসব সুপারিশমালা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।
গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখন সরকারের হাতে। আমরা মনে করি, সংস্কার শুরু করা যেতে পারে পুলিশ বিভাগ দিয়ে; এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সবার সম্মতি পাওয়া গেছে। আমরা চাই, পুলিশ শাসক দলের ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ না হয়ে আইন ও ন্যায় বিচারের বাহক হয়ে উঠুক এবং তাদের এই ইতিবাচক পরিবর্তন হতে হবে স্থায়ী। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের উচিত ন্যায় বিচারের প্রতিনিধিত্ব করা, নিপীড়নের নয়। পুলিশ সংস্কারের যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই সময়োপযোগী, যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক। সংস্কার প্রক্রিয়া পুলিশের মধ্য দিয়েই শুরু করা যেতে পারে এবং এই প্রক্রিয়া অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কারও জরুরি। আমাদের প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের সেবায় নিয়োজিত থাকে এবং বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক দলবাজির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। তবে এখানে নীতিবান কর্মকর্তাও রয়েছেন, যদিও তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। অধিকাংশ কর্মকর্তাই দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ ও জবাবদিহির বাইরে। এই খাতে সংস্কার সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়বে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাই সরকারকে জনপ্রশাসন সংস্কারে হতে হবে আরও দৃঢ়সংকল্প।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। অন্য সব বিষয়ের আগে ও দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার শেষ করতে হবে। পুরো সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে হবে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই কেবল সরকার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।
এই সরকারের হাতে প্রায় এক বছর সময় আছে। যদি এই সময়টুকু দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে না জড়িয়ে জরুরি কাজে মনোযোগী হওয়া যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সময়সীমার মধ্যেই ইতিবাচক সংস্কার ও নির্বাচন– দুটোই সম্ভব হবে।
আমরা জানি, দ্রুত নির্বাচন হলে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে, আবার কেউ পাবে না। তবে রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় না রেখে জনগণের স্বার্থকে সবার ওপরে রাখতে হবে। গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
তাই এখন নতুন করে অপ্রয়োজনীয় কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করতে হবে। তারপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে সরকারকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাবে। পারস্পরিক বিভেদ ভুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সব রাজনৈতিক দলের সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে করে তারা নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজনের দুটি লক্ষ্যই সফলভাবে পূরণ করতে পারে।
শেখ নাহিদ নিয়াজী; সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com