সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে জাতি পাকিস্তান হানাদার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তবে বারবার সেই স্বাধীকার আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, স্বাধীনতা হয়েছে হাতছাড়া। কখনও স্বৈরাচার, কখনও ফ্যাসিবাদ চেপে বসেছে জাতির ওপর। 

তবে জাতি বারবার লড়াই করেছে, যার সবশেষ উদাহরণ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। আর প্রতিটি লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে একাত্তর, আর বারবার ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ডাক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর তাই স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৫ তম দিবস পালনকালে আবারও সেই আকাঙ্ক্ষার কথাই উঠে এলো রাজনৈতিক, অরাজনৈতিকসহ আপামর মানুষের কণ্ঠে।

বুধবার (২৬ মার্চ) দিবসের প্রথম প্রহর সকাল ৫টা ৪৩ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো.

সাহাবুদ্দিন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে স্মৃতিসৌধের মূল বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ৬টা ৫ মিনিটে স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি। 

এরপর সকাল ৬টা ৭ মিনিটের দিকে স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে ৬টা ১৫ মিনিটে তিনি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা চলে যাওয়ার পরেই স্মৃতিসৌধ এলাকা সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এরপর ফুলের ডালা নিয়ে জাতির বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষের ঢল নামে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে।

শিশু থেকে প্রবীণ সব বয়সী মানুষের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শ্রদ্ধা জানান সাধারণ মানুষও। তাদের ফুলেল শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে শহীদ বেদি।

স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে যুদ্ধাহত অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের অনেকের হাতে ছিল লাল-সবুজের বিজয় পতাকা।

একে একে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ৭১ ও ২৪ এর উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা সুষ্ঠু করা। এজন্য সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।

যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “৭১ এ দেশকে জন্ম দিয়েছে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা। আমরা মনে করি, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে।”

একই ভাষ্য আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুর। তিনি বলেন, “অনেকে বলেন যে একাত্তর এবং চব্বিশ কি এক? না, অবশ্যই এক না। একাত্তর ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম, আর চব্বিশ হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার অর্জনকে পুনঃস্থাপন করার সংগ্রাম।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান এবং আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম, আমাদের সাতচল্লিশের আজাদির লড়াই—এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে আমরা যে স্বাধীন, সার্বভৌম, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র পেতে চেয়েছিলাম, তার একটি সুযোগ ও সম্ভাবনা আমাদের গণ–অভ্যুত্থানের পর তৈরি হয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা ও চব্বিশের স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী নয়, আমরা সেই ধারাবাহিকতাতেই আছি।’’

আর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বললেন, ‘‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব সংগঠিত হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্বের লড়াই চলমান।’’

দেশে বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে চলমান শঙ্কা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের মন্তব্য, “এমন সময় যদি কখনও আসে জাতীয় বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন পড়বে, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যের প্রয়োজন পড়ব/, তখন কিন্তু আমরা সবাই এক হয়ে যাব। এখানে কোনো ভুল নাই। এখন দলীয় আদর্শিক স্বার্থে হয়তো আলাদা কথা বলছি, হতে পারে। কিন্তু যখন প্রয়োজন হবে, তখন বাংলাদেশের জনগণ এক হয়ে যাবে।”

একই কথা বললেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, “জনগণের কল্যাণে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে ঐকমত্যে না পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই।”

এদিকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের অভিযোগ, “গত সাড়ে ১৫ বছর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একপেশে করা হয়েছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সেইরকম একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”

অন্যদিকে সংস্কারের বিষয়ে উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দ্রুত ভোটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিবি ও গণসংহতি।

নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘‘আমরা বারবার বলছি, সংস্কারের অনেকগুলো জায়গা আছে। কিছু নির্বাচনের আগেই নির্বাহী আদেশে সংস্কার করা সম্ভব। আবার অনেকগুলো সংস্কারের প্রশ্নে যেগুলো মৌলিক কাঠামোগত, এগুলো আসলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের করতে হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন করা আসলে কঠিন।’’

আর দ্রুত নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, “ভালো সংস্কার করে নির্বাচন ডিসেম্বরে কেনো তার আগেই বাংলাদেশে সম্ভব বলে আমরা মনে করি।”

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ বড় ইসলামীক সংগঠনগুলোর কোনো তৎপরতা এদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধে দেখা যায়নি।

স্বাধীনতা দিবস পালনকালে একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনারও সাক্ষী হয়েছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এদিন লাল পতাকা হাতে একদল লোক আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিল করেছেন। এ সময় উপস্থিত জনতা তাদের ধাওয়া দেয় এবং কয়েক জনকে মারধর করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করে।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিনুর কবির জানান, আনুমানিক সকাল ১১টার সময় ৫/৬ জন জাতীয় স্মৃতি সৌধে উস্কানিমূলক স্লোগান দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেন। এমন অভিযোগে তাদের আশুলিয়া থানা পুলিশ আটক করে।

গতবছরের তুলনায় এবছর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সকাল ১০টা পর্যন্ত মানুষের ঢল থাকলেও পরে উপস্থিতি কমতে থাকে। বিকেল ৫টার দিকে স্মৃতিসৌধের ফটক বন্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আনুষ্ঠানিকতা। দিনভর এ আনুষ্ঠানিকতায় নিরাপত্তা দিতে নিয়োজিত ছিল প্রায় ৪ হাজার পুলিশ সদস্য।

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র গণঅভ য ত থ ন স ব ধ নত উপদ ষ ট ব রব র আম দ র র জন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

হাদিকে হত্যার চেষ্টায় নিন্দা ও উদ্বেগ এনসিপির 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর রাজধানীর বিজয়নগরে প্রকাশ্য দিবালোকে চালানো ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। 

শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এনসিপির মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

আরো পড়ুন:

ওসমান হাদিকে গুলির বিষয়ে তদন্ত করবে ইসি 

কুমিল্লায় নিজের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করলেন জামায়াতের প্রার্থী

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ হামলা শুধু একজন প্রার্থীর ওপর নয়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হওয়া গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ওপরও সরাসরি আঘাত। এনসিপি গুরুতর আহত শরিফ ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে এবং দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া প্রার্থনা করছে। 

এই হামলা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নির্বাচনি পরিবেশের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, শরিফ ওসমান হাদি হামলার আগে হুমকির কথা প্রকাশ্যে জানানোর পরও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির কার্যালয়ের সামনে বারংবার ককটেল হামলা এবং একজন প্রার্থী হুমকি পাওয়ার পরেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের চরম ব্যর্থতা দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা ও উদাসীনতার নগ্ন উদাহরণ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

একই সঙ্গে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে, এবং তাদের অবশিষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী এখনো সক্রিয়ভাবে দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সরকার যদি অবিলম্বে আওয়ামী লীগের এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা না করে, তবে তারা আবারও গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং দেশকে সহিংস অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে। 

আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এখন গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর একে অপরকে দোষারোপ করে রাজনৈতিক লাভ তোলার সময় নয়; এখন সময় প্রকৃত অপরাধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি আনার। গণঅভ্যুত্থানের শক্তি যদি বিভক্ত হয়, তাহলে সুযোগ নেবে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও দেশবিরোধী চক্র, যারা অতীতেও হত্যা ও সহিংসতার মাধ্যমে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টি দেশের নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, পরিবর্তনের পথযাত্রায় থাকা সকল গণতান্ত্রিক শক্তি এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনগণকে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই, যেকোনো হুমকি, ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে এনসিপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

অবিলম্বে এই হামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, হুমকির উৎস শনাক্ত করাসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা এবং সকল প্রার্থী ও নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষায় আমরা দৃঢ়ভাবে দেশবাসীর সাথে আছি এবং থাকব।

ঢাকা/রায়হান/রফিক 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘হাদির ওপর হামলাকারীর শেকড় যতই শক্তিশালী হোক উপড়ে ফেলা হবে’
  • হাদিকে হত্যার চেষ্টায় নিন্দা ও উদ্বেগ এনসিপির 
  • অলসতা মোকাবিলার আধ্যাত্মিক কৌশল