দেশে ফের বার্ড ফ্লু শনাক্ত, প্রায় ২ হাজার মুরগির মৃত্যু
Published: 26th, March 2025 GMT
যশোরের একটি মুরগির খামারে শনাক্ত হয়েছে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু। ২০১৮ সালের পর গত ১২ মার্চ বাংলাদেশে এই ফ্লু শনাক্ত হলো। হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে খামারিদের মাঝে। শনাক্তের পর পরই বার্ড ফ্লু প্রতিরোধ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার।
পোলট্রি খামারিদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সীমান্ত এলাকায় নেওয়া হয়েছে সতর্কতা। কোনো মৃত বা সন্দেহজনক হাঁস-মুরগি বা পাখি পাওয়া গেলে নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত নিকটবর্তী ল্যাবে পরীক্ষা করে ফলাফল অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড.
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সীমান্ত এলাকায় আমাদের কার্যালয়গুলোকে সতর্ক করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষায়িত ভ্যাকসিন পর্যাপ্ত আছে। বাংলাদেশে খামারে ২০০৭ সালে প্রথম এবং ২০১৮ সালে সর্বশেষ বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়। এবার আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের মতো না। বার্ড ফ্লু নিয়ে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বোঝাবুঝি বা প্রচারণা না ছড়ায়, সেদিকে যেন আমরা সতর্ক থাকি। খামারি বা ক্রেতার আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ক্রেতাসাধারণকে অনুরোধ করব, আতঙ্কিত হয়ে আপনারা হাঁস-মুরগি বা ডিম খাওয়া বন্ধ করবেন না।
গতকাল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, আমাকে মার্চের শুরুতে বার্ড ফ্লু শনাক্তের বিষয়টি জানানো হয়েছে। ফ্লুর বিস্তার যাতে বাড়তে না পারে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এই ফ্লু বিস্তার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যশোরের খামারটি পরিদর্শন করেছেন এবং ফ্লুটি কীভাবে বাংলাদেশে এসেছে, তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ফ্লুর পরীক্ষাবিষয়ক টেকনিক্যাল বিষয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলতে পারবেন।
বার্ড ফ্লুয়ের প্রাদুর্ভাবে যশোরের খামারে তিন হাজার ৯৭৮টি মুরগির মধ্যে এক হাজার ৯০০টি মারা গেছে। ফ্লু যেন ছড়িয়ে না পরে, সেজন্য বাকি মুরগি মেরে ফেলা হয়। ২০০৭ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম বার্ড ফ্লু দেখা দেয়। সে বছর ১০ লাখেরও বেশি মুরগি এই ফ্লুয়ের কারণে মের ফেলা হয়। ২০০৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশে মানুষের শরীরে বার্ড ফ্লু সংক্রমণ ধরা পড়ে।
দেশে মাংসের মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি জোগান দেয় পোলট্রি খাত। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে ৯৫ হাজার ৫২৩টি খামার আছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলার সংকটে বেড়ে গেছে প্রাণিজ খাদ্যের দাম। করোনার পর থেকে খরচ সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে ৬২ হাজার ৬৫৬টি খামার। এবার বার্ড ফ্লু যেন দেশের খামারিদের আরেকটি মহামারিতে না ফেলে, এ জন্য ফ্লু বিস্তার রোধে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে পোল্ট্রিখাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম রগ পর ক ষ ক ত হয় সরক র সতর ক
এছাড়াও পড়ুন:
শৈশবে নিয়ে গেল যৌবনের দিন
সাবিত্রী মণ্ডলের (২৮) ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মেয়েটি পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে বাড়ি তাদের। প্রতিদিন এক কিলোমিটার দূরের মাগুরখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে তারা। স্বল্প সময়েই পাকা রাস্তা ধরে ছেলেমেয়েরা আসা-যাওয়া করে। বিষয়টি সাবিত্রীর শৈশবে ছিল কল্পনার মতো। তিনি যখন কাছাকাছি দূরত্বের তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন ধুলা-কাদার জন্য প্রতিদিন পথে ভোগান্তি পোহাতে হতো।
সাবিত্রীর স্বামী পরিমল চন্দ্র পেশায় কৃষক। তাদের দু’জনের শৈশবই কেটেছে কাঁঠালিয়া গ্রামে। দুই সন্তানের যাতায়াতে কষ্ট কমায় পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে বলে খুশি তারা। শৈশব-কৈশোরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার স্মৃতি রোববার তুলে ধরেন সাবিত্রী। তিনি বলেন, রাস্তায় অনেক কাদা থাকত, স্কুলে যাওয়া-আসার সময় জামাকাপড়, বইপত্র নষ্ট হয়ে যেত। এতে অনেক সময়ই মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এখন বাড়ির পাশেই পিচঢালা সড়ক।
উপজেলা সদর থেকে মাগুরখালীর দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। ১৭-১৮ বছর আগে এই জনপদ ছিল অবহেলিত। বর্ষাকালে কাদামাটি আর শুকনো মৌসুমে ধুলায় একাকার হয়ে যেত এলাকার রাস্তাঘাট। ২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট দৈনিক সমকালে ইউনিয়নবাসীর দুর্ভোগ নিয়ে একটি ফটোফিচার ছাপা হয়। তখন ডুমুরিয়া সদর থেকে খুলনা শহর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার পথ পেরোতে লাগত আধা ঘণ্টারও কম। একই জায়গা থেকে মাগুরখালী ইউপি পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার পথে লেগে যেত আট ঘণ্টা। এখন মাত্র ২০-২২ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যায়।
২০০৭ সালে ১৬ হাজার লোকের বসবাস ছিল ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামে। সব মিলিয়ে ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ২৮টি সড়কের কোনোটিতেই পিচঢালা ছিল না। মাত্র দেড় কিলোমিটার সড়কে বিছানো ছিল ইট (সোলিং)। বাকি সড়ক ছিল কাঁচা আর খানাখন্দে ভরা। পুরো ইউনিয়নে তখন কোনো সেতু বা কালভার্ট ছিল না। এখন পাঁচটির মতো কালভার্ট ও একটি সেতু আছে। ইউনিয়নে ২০০৭ সালে ২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি বালিকা বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়, একটি পুলিশ ক্যাম্প এবং একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকই আছে। মহাবিদ্যালয়টি সম্প্রতি এমপিওভুক্ত হয়েছে।
মাগুরখালী ইউনিয়নের প্রায় সব জায়গা এখন ঝলমলে। মসৃণ পিচের সড়ক দিয়ে চলছে যান্ত্রিক যানবাহন। পাশেই দেখা যায় আধুনিক বাড়িঘর। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে বদলে গেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মাগুরখালী গ্রামের শ্রমজীবী নিরঞ্জন মণ্ডল (৭৫) বলেন, ‘আর বলবে না বাবা। ১৪-১৫ বছর আগে বর্ষাকালে মনে হতো দ্বীপের মধ্যে বসবাস করছি। গ্রামের বাজারে যেতে পারতাম না, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যেতে কষ্ট হতো। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছিল আরও কঠিন। পাকা রাস্তার জন্য কত যে ধরনা দিয়েছি!’
একই গ্রামের কৃষক অশোক কুমার মণ্ডলের (৫৯) ভাষ্য, এখন তো জীবনটাই পাল্টে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে, ছেলেমেয়েরা সহজে স্কুল-কলেজে যেতে পারছে। দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যায়। এই পাকা রাস্তাঘাট তাদের জন্য আশীর্বাদ। একসময় দেড় কিলোমিটার দূরের মাগুরখালী বাজারে যেতেও ঘাম ছুটে যেত।
এ ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, এখন ইউনিয়নের বাসিন্দা ২০ হাজারের মতো। ২০০৭ সালে যে রাস্তা ছিল, এর বাইরেও নতুন করে ছোট-বড় প্রায় দ্বিগুণ রাস্তা হয়েছে। অধিকাংশ রাস্তাই পিচের ঢালাই ও সোলিং করা।
আড়তগুলোতে মাছ সরবরাহ করেন পার মাদারতলা গ্রামের বিধান রায়। মাগুরখালী বাজারে ভ্রাম্যমাণ সবজির দোকান নিহার মণ্ডলের। এ দু’জন অতীতের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আগে মালপত্র আনা-নেওয়া খুব কষ্টের ছিল। খরচও বেশি পড়ত। এখন যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় এখানে শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য ও নানামুখী নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানান ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনোজ সরকার। তিনি বলেন, এক সময় বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট ছিল। এখন আর নেই। তবুও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে এখনও গ্রামীণ সড়ক বেহাল। বেশ কিছু জায়গায় বাঁশের সাঁকো রয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ সানা সমকালে অবহেলিত ইউনিয়নবাসীর দুর্ভোগ তুলে ধরায় ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই উন্নয়ন দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে রাস্তঘাট পাকা করার উদ্যোগও নেওয়া হয়। সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় মানুষও সহায়তা করেন।
ইউনিয়নটির প্রায় সবখানে পিচ ও সোলিং করা রাস্তা আছে। এ তথ্য জানিয়ে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ৩২৯ কোটি টাকা খরচে ঘ্যাংরাইল নদীর ওপর ৩১৫ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মিত হয়েছে। এর পূর্বপারে সাহস ও পশ্চিমপারে মাগুরখালী। এই সেতুটি মানুষের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে।
ডুমুরিয়ার ইউএনও মুহাম্মদ আল-আমিন বলেন, মাগুরখালীর একটি কলেজও এমপিভুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। ওই এলাকা যেন সরকারি বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
পাশের ফুলতলা উপজেলায় বাড়ি অর্থনীতিবিদ ড. মো. মাহবুব-উল ইসলামের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট ফ্রান্সিস ইউনিভার্সিটির ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এখন বাড়িতেই থাকেন। ড. মাহবুব-উল ইসলাম মনে করেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো এলাকা উন্নত করতে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার বিকল্প নেই। কারণ যোগাযোগের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক নিবিড়। কোনো ব্যবসায়ী যদি পাঁচ ঘণ্টার পথ আধা ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সময় বাঁচবে। বাকি সাড়ে চার ঘণ্টা তিনি অন্যান্য কাজে ব্যয় করতে পারেন।