শ্রমিকের বেতন বোনাসের বেলায় কি পুরোনো বন্দোবস্তই চলবে
Published: 26th, March 2025 GMT
বেশির ভাগ মানুষ যখন ঈদের কেনাকাটা করছেন, বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন; শ্রমিক অঞ্চল, বিশেষত পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে তখন ঈদের আগে বেতন–বোনাস পাওয়ায় অনিশ্চয়তা। ঈদের বোনাস তো পরের কথা, বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক কয়েক মাস ধরে বেতনই পাচ্ছেন না। তাদের অনেকে রাস্তায় নেমে এসেছেন, বিজিএমইএ ভবন ও শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন; কিন্তু মালিকপক্ষ কিংবা শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।
যেমন, ১৮ মার্চ থেকে বকেয়া বেতন ও আইনানুগ পাওনার দাবিতে ঢাকার বিজয়নগরে অবস্থিত শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলন করছেন গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড গার্মেন্টের শ্রমিক-কর্মচারীরা। সরকার ও মালিকপক্ষের কাছ থেকে কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ২৩ মার্চ অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রাম প্রসাদ সিং (৪০) নামের এক কর্মী। তিনি কারখানাটির সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিন মাসের বকেয়া মজুরি ও ঈদ বোনাসের দাবিতে ২৩ মার্চ সকাল থেকে টিএনজেড গ্রুপের আ্যাপারেলস ইকো প্লাস লিমিটেডের প্রায় ৭০০ জন শ্রমিক শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান করেছেন।
এক মাসের বকেয়া বেতন ও লে-অফ ক্ষতিপূরণের দাবিতে ২৩ মার্চ থেকে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন রোর ফ্যাশনের প্রায় ২০০ শ্রমিক।
তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদের বোনাসের দাবিতে ২৫ মার্চ সকালে গাজীপুরের ‘হ্যাগ নিট ওয়্যার’ নামের কারখানার শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন।
সময়মতো বেতন বোনাস না দেওয়ার এই সমস্যা শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি কারখানার মধ্যেই সীমিত নয়। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সূত্র ধরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২৪ মার্চ নাগাদ বিজিএমইএর সদস্য ২ হাজার ১০৭টি সচল তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে বোনাস দিয়েছে ১ হাজার ৭৬৩টি কারখানা অর্থাৎ বোনাস দেয়নি ৩৪৪টি কারখানা। চলতি মাসের ১৫ দিনের বেতন দিয়েছে মাত্র ৮৪টি বা ৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর ৭৫০টি সচল কারখানার ৫০ শতাংশ কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে। (সব শ্রমিক এখনো ঈদ বোনাস পাননি, প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২৫)
অথচ গত ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি) সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০ রমজানের মধ্যেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাসসহ সব পাওনা পরিশোধ করা হবে, সেই সঙ্গে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতন দিতে হবে; কিন্তু সরকারের দিক থেকে তদারকি না থাকায় অনেক কারখানা মালিকই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি যার ফলে ঈদ যত সামনে আসছে, বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন তত বাড়ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও ঈদুল ফিতরের আগে বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ নিয়ে প্রায় ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতার আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছিল, এর মধ্যে ৩৬টি কারখানাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, সরকারের পক্ষ থেকে সেই ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো নিয়ে যথাযথ তদারকি করা হয়েছিল? মালিকপক্ষকে আলাদা করে ডেকে কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল? কোন কোন কারখানায় বেতন–বোনাস কবে দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারের কাছে কি কোনো হিসাব আছে?
ঈদের আগে পোশাক কারখানার বেতন–বোনাস বকেয়া থাকার সমস্যাটি নতুন নয়। বিগত সরকারের আমলে প্রতিবছরই আমরা দেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প খাতটির শ্রমিকদের ঈদের আগে বেতন–বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসতে দেখেছি। সারা বছর পরিশ্রম করে ঈদের আগে বেতন–বোনাসের দাবিতে নিরুপায় হয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আসা খুব “স্বাভাবিক” একটা ঘটনা হয়ে গিয়েছিল।
প্রত্যাশা ছিল বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণে সংগঠিত গণ–অভ্যুত্থানের পরে এই ‘অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতাগুলো’ আর দেখতে হবে না। অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার দায় ও দরদ নিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারটুকু বাস্তবায়িত করবে; কিন্তু আমরা দেখছি, অনেক কিছু আগের মডেলেই চলছে। আগের মতোই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় থাকছে না, বারবার তাদের রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে। আর নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমে আসা শ্রমিকদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনা ঘটছে।
মাজারে হামলা থেকে শুরু করে মব–সন্ত্রাস প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো তৎপরতা না থাকলেও অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা শিক্ষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের ওপর তারা বেশ খড়্গ হস্ত। এরই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো ২৫ মার্চ তিন মাসের বকেয়া মজুরি ও ঈদ বোনাসের দাবিতে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনা।
শ্রম ভবনের সামনে দিনের পর দিন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার পরেও বকেয়া বেতন-বোনাস বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেড, রোর ফ্যাশন, স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস ও ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিক কর্মচারীরা শ্রম-মন্ত্রণালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে যাত্রা করে।
এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হন অন্তত ৩০ জন শ্রমিক। পুলিশের নির্মম লাঠিপেটায় আহতদের মধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি জানাতে আসা বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়ও রয়েছেন। উল্লেখ্য এই দিলীপ রায়কে ২০১৬ সালের আগস্টে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটূক্তি করার অপরাধে গ্রেপ্তার করেছিল।
গণ–অভ্যুত্থানে কত কিছু পাল্টানোর কথা শোনা যাচ্ছে; কিন্তু বকেয়া মজুরি ও বোনাসের জন্য শ্রমিকদের দিনের পর দিন রাস্তায় পরে থাকার বাস্তবতাটা পাল্টাল না, পাল্টাল না অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের পুলিশি নিপীড়নের শিকার হওয়ার বাস্তবতাটা।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম স র বক য় সরক র র অবস থ ন হয় ছ ল ন র পর
এছাড়াও পড়ুন:
পোশাক খাতে করপোরেট করহার অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প খাত ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক খাতে বিদ্যমান করপোরেট কর অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ করেছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। আলোচনা সভায় স্থানীয়ভাবে রিসাইকেল ফাইবার (পুনঃব্যবহারযোগ্য সুতা) উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি চেয়েছে বিজিএমইএ। বিনিয়োগবান্ধব করনীতি প্রণয়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে বিকেএমইএ। বর্তমানে পোশাক খাতে ১২ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। তবে সবুজ কারখানা হলে দিতে হয় ১০ শতাংশ। আইএমএফের শর্তে রাজস্ব আদায় বাড়াতে আগামী বাজেটে এ করহার বাড়াতে চায় এনবিআর। তবে উদ্যোক্তাদের দাবি, বর্তমান ক্রান্তিকালে করপোরেট কর বাড়ানো হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের
মধ্যে আস্থার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য এনামুল হক বলেন, সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। এর মধ্যে পোশাকশিল্পে করপোরেট করহার বাড়লে স্থানীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আস্থা হারাবেন।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সোলার সিস্টেমের ওপর কর মওকুফ প্রয়োজন। সরকার শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই সোলার প্যানেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চান উদ্যোক্তারা। সোলারে কোনো কিছু না রেখে সম্পূর্ণ ফ্রি করা উচিত। তা হলে ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবেন। এতে খরচ কমে আসবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা বিশ্বাস করেন, বর্তমান করনীতি কোনোভাবেই বিনিয়োগ বা ব্যবসার সহায়ক নয়। পোশাক কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি ও বিভিন্ন অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামা পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর কর রেয়াত করার প্রস্তাব করেন তিনি।
সভায় বস্ত্রকল খাতের সংগঠন বিটিএমএ স্থানীয় উৎপাদন খরচ ও বিশ্ব বাজার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে ফেব্রিকের ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ এবং আগের মতো বিটিএমএ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বন্ড ছাড়া পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া রিসাইকেল ফাইবার উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে পোশাকশিল্পের ঝুট স্থানীয়ভাবে সংগ্রহের জন্য উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে এবং উৎপাদিত পণ্য স্থানীয়ভাবে সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি চেয়েছে সংগঠনটি।
এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবে রয়েছে– নতুন এসএমইদের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম করারোপ না করা, উৎপাদনকারীদের শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পে স্থানীয় মুদ্রায় সরাসরি উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ শিল্পে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, এবার ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করা হবে। ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে কর সুবিধা নিচ্ছেন। তারা তার ধারাবাহিকতা চাচ্ছেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত করহারের চেয়ে কার্যকরী কর অনেক বেশি। এগুলোকে যত সম্ভব সহজ করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ১ শতাংশ। করহার কমানোর বিষয়ে সবার কথা শুনতে গেলে অনুপাত কমে ৫ শতাংশে নামবে।