বেশির ভাগ মানুষ যখন ঈদের কেনাকাটা করছেন, বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন; শ্রমিক অঞ্চল, বিশেষত পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে তখন ঈদের আগে বেতন–বোনাস পাওয়ায় অনিশ্চয়তা। ঈদের বোনাস তো পরের কথা, বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক কয়েক মাস ধরে বেতনই পাচ্ছেন না। তাদের অনেকে রাস্তায় নেমে এসেছেন, বিজিএমইএ ভবন ও শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন; কিন্তু মালিকপক্ষ কিংবা শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।

যেমন, ১৮ মার্চ থেকে বকেয়া বেতন ও আইনানুগ পাওনার দাবিতে ঢাকার বিজয়নগরে অবস্থিত শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলন করছেন গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড গার্মেন্টের শ্রমিক-কর্মচারীরা। সরকার ও মালিকপক্ষের কাছ থেকে কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ২৩ মার্চ অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রাম প্রসাদ সিং (৪০) নামের এক কর্মী। তিনি কারখানাটির সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিন মাসের বকেয়া মজুরি ও ঈদ বোনাসের দাবিতে ২৩ মার্চ সকাল থেকে টিএনজেড গ্রুপের আ্যাপারেলস ইকো প্লাস লিমিটেডের প্রায় ৭০০ জন শ্রমিক শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান করেছেন।

এক মাসের বকেয়া বেতন ও লে-অফ ক্ষতিপূরণের দাবিতে ২৩ মার্চ থেকে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন রোর ফ্যাশনের প্রায় ২০০ শ্রমিক।

তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদের বোনাসের দাবিতে ২৫ মার্চ সকালে গাজীপুরের ‘হ্যাগ নিট ওয়্যার’ নামের কারখানার শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন।

সময়মতো বেতন বোনাস না দেওয়ার এই সমস্যা শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি কারখানার মধ্যেই সীমিত নয়। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সূত্র ধরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২৪ মার্চ নাগাদ বিজিএমইএর সদস্য ২ হাজার ১০৭টি সচল তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে বোনাস দিয়েছে ১ হাজার ৭৬৩টি কারখানা অর্থাৎ বোনাস দেয়নি ৩৪৪টি কারখানা। চলতি মাসের ১৫ দিনের বেতন দিয়েছে মাত্র ৮৪টি বা ৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর ৭৫০টি সচল কারখানার ৫০ শতাংশ কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে। (সব শ্রমিক এখনো ঈদ বোনাস পাননি, প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২৫)

অথচ গত ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি) সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০ রমজানের মধ্যেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাসসহ সব পাওনা পরিশোধ করা হবে, সেই সঙ্গে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতন দিতে হবে; কিন্তু সরকারের দিক থেকে তদারকি না থাকায় অনেক কারখানা মালিকই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি যার ফলে ঈদ যত সামনে আসছে, বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন তত বাড়ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও ঈদুল ফিতরের আগে বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ নিয়ে প্রায় ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতার আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছিল, এর মধ্যে ৩৬টি কারখানাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, সরকারের পক্ষ থেকে সেই ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো নিয়ে যথাযথ তদারকি করা হয়েছিল? মালিকপক্ষকে আলাদা করে ডেকে কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল? কোন কোন কারখানায় বেতন–বোনাস কবে দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারের কাছে কি কোনো হিসাব আছে?

ঈদের আগে পোশাক কারখানার বেতন–বোনাস বকেয়া থাকার সমস্যাটি নতুন নয়। বিগত সরকারের আমলে প্রতিবছরই আমরা দেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প খাতটির শ্রমিকদের ঈদের আগে বেতন–বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসতে দেখেছি। সারা বছর পরিশ্রম করে ঈদের আগে বেতন–বোনাসের দাবিতে নিরুপায় হয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আসা খুব “স্বাভাবিক” একটা ঘটনা হয়ে গিয়েছিল।

প্রত্যাশা ছিল বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণে সংগঠিত গণ–অভ্যুত্থানের পরে এই ‘অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতাগুলো’ আর দেখতে হবে না। অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার দায় ও দরদ নিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারটুকু বাস্তবায়িত করবে; কিন্তু আমরা দেখছি, অনেক কিছু আগের মডেলেই চলছে। আগের মতোই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় থাকছে না, বারবার তাদের রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে। আর নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমে আসা শ্রমিকদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনা ঘটছে।

মাজারে হামলা থেকে শুরু করে মব–সন্ত্রাস প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো তৎপরতা না থাকলেও অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা শিক্ষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের ওপর তারা বেশ খড়্গ হস্ত। এরই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো ২৫ মার্চ তিন মাসের বকেয়া মজুরি ও ঈদ বোনাসের দাবিতে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনা।

শ্রম ভবনের সামনে দিনের পর দিন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার পরেও বকেয়া বেতন-বোনাস বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ অ্যাপারেলস প্লাস ইকো লিমিটেড, রোর ফ্যাশন, স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস ও ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিক কর্মচারীরা শ্রম-মন্ত্রণালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে যাত্রা করে।

এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হন অন্তত ৩০ জন শ্রমিক। পুলিশের নির্মম লাঠিপেটায় আহতদের মধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি জানাতে আসা বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়ও রয়েছেন। উল্লেখ্য এই দিলীপ রায়কে ২০১৬ সালের আগস্টে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটূক্তি করার অপরাধে গ্রেপ্তার করেছিল।

গণ–অভ্যুত্থানে কত কিছু পাল্টানোর কথা শোনা যাচ্ছে; কিন্তু বকেয়া মজুরি ও বোনাসের জন্য শ্রমিকদের দিনের পর দিন রাস্তায় পরে থাকার বাস্তবতাটা পাল্টাল না, পাল্টাল না অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের পুলিশি নিপীড়নের শিকার হওয়ার বাস্তবতাটা।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স র বক য় সরক র র অবস থ ন হয় ছ ল ন র পর

এছাড়াও পড়ুন:

মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হোক

প্রতিবছরের মতো এ বছরও ঈদের আগে কারখানাশ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও বোনাস পেতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসেও বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকেরা মার্চের অর্ধেক বেতন ও বোনাস পাননি। ফলে তাঁদের ঈদ উদ্‌যাপন অনিশ্চিত। 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ কয়েকটি জেলার অন্তত ৪৩টি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের বেতন ও ভাতা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা ছিল। বৃহস্পতিবারও শ্রমিকদের দুটি গ্রুপ শ্রমভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বকেয়া বেতন–বোনাসের দাবিতে।

উল্লেখ্য, ঈদের আগে শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও ছুটিসংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য ১২ মার্চ সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ত্রিপক্ষীয় এ বৈঠকে মালিকেরা বোনাস ও মার্চের অর্ধেক বেতন ২০ রমজানের মধ্যে দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। রোজা শেষ হবে ৩০ অথবা ৩১ মার্চ। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মার্চ মাসের পুরো বেতন ছুটির আগে দেওয়ার কথা। তারপরও শ্রমিকেরা ঈদের আগে অর্ধেক বেতন নিতে রাজি হয়েছিলেন; যদিও মালিকদের সবাই তা–ও পরিশোধ করেননি। এটা শ্রমিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতাই বটে। সব মালিক শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দিলেও সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা ঠিকই আদায় করে নিয়েছেন। মালিকেরা যাতে ঈদের আগে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারেন, সে জন্য সরকার রপ্তানি প্রণোদনার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে।

প্রতিবছরই শ্রমিকদের বোনাস-বেতন নিয়ে এই সমস্যা হয় কেন? এর জন্য শ্রমিকেরা দায়ী নন। দায়ী হলেন একশ্রেণির মালিক। সরকারের সদুপদেশ কিংবা শ্রমিকদের আন্দোলনও তাঁদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে সরকার সংকটে থাকা ১২টি কারখানার মালিকদের প্রতি বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করি, এই নিষেধাজ্ঞার পর তাঁরা শ্রমিকদের সব পাওনা ঈদের আগেই বুঝিয়ে দেবেন।

মালিকদের কারখানার বাইরেও অনেক ব্যবসা আছে। কোনো কারখানা সমস্যায় পড়লে অন্য ব্যবসা দিয়ে পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকদের শ্রম বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। মাস শেষে বেতনই তাঁদের জীবিকার একমাত্র উপায়। সে ক্ষেত্রে বেতন বকেয়া পড়লে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। মালিকেরা কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি কেনেন নগদ টাকায়, কিন্তু শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে গড়িমসি করে থাকেন।

আমরা মনে করি, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের বিষয়ে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএরও দায়িত্ব আছে এবং তারা সাধ্যমতো পালন করেও থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো এই দুটি সংগঠনের বাইরেও অনেক মালিক আছেন; যঁাদের ওপর বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ চাপ দিয়ে কিছু করতে পারে না।

এবার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পেতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়েছে, পুলিশের হাতে মার খেতে হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর হলো রাস্তায় আন্দোলন করতে গিয়ে একজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। এর দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট কারখানামালিক কীভাবে দায় এড়াবেন? 

কেবল কারখানামালিক নন, আরও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা নিয়ে প্রতিবছর হাঙ্গামা হয়। অনেক খাতে নিম্নতম মজুরির বিধানও নেই। মালিকদের অনেকে বিদেশে ডলার খরচ করে কেনাকাটা ও ঈদ উদ্‌যাপন করবেন, আর শ্রমিকেরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে না খেয়ে থাকবেন, সেটা হতে পারে না। মালিকদের এই স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হোক। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা শোধ করা হোক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্ধারিত সময়ে বেতন ভাতা দেয়নি অনেক পোশাক কারখানা
  • অনেক কারখানার শ্রমিকদের বেতন ভাতা এখনো বাকি
  • মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হোক
  • অর্ধেক বেতন পরিশোধেও পিছিয়ে অনেক কারখানা