বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে শ্রদ্ধা ও সমীহের সঙ্গে উচ্চারিত একটি নাম সন্জীদা খাতুন। দেশের এই অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, সংগীতজ্ঞ ও ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে স্মরণ করে লিখেছেন কয়েকজন গুণী তারকাশিল্পী।
ফেরদৌস আরা
‘সন্জীদা খাতুন, যাঁকে আমরা চিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে প্রিয় সেই মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই।’ গতকাল বিকেলে এই দুঃসংবাদ কানে আসতেই পুরোপুরি থমকে গিয়েছি। প্রকৃতি নিয়মে আমরা সবাই চলে যাব, চলে যেতে হয়, তারপরও এই বিদায়-সংবাদ ছিল অবিশ্বাস্য। এও সত্যি, মৃত্যু চিরন্তন জেনেও কারও চলে যাওয়া কেন জানি মেনে নিতে পারি না। সন্জীদা খাতুন যে কত বড় মাপের শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, তা আসলে স্বল্প কথায় বোঝানো যাবে না। এটি ঠিকই উপলব্ধি করা যাবে যে, তিনি শূন্যতা তৈরি করে গেলেন। রবীন্দ্রসংগীত তো অনেকে গান, যাদের গায়কী শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আমার জীবদ্দশায় এখানে আর কোনো রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর দেখা পাইনি, যার সঙ্গে সন্জীদা খাতুনের তুলনা করা যায়। নিজেও যেমন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন, তেমনি যারা ভালো গায় তাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। আমিও সেই ভাগ্যবানদের একজন, যে সন্জীদা খাতুনের স্নেহের ছায়াতলে জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম। এখনও মনে পড়ে কলেজজীবনের সেই অনুষ্ঠানটির কথা, যেদিন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলাম। আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন। হেসে বলেছিলেন, ‘তুমি যখন এত ভালো গাও, তাহলে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত গাইলেই তো পারো।’ তাঁর এ কথাটাই শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে দারুণভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। তারপরও কেন জানি রবীন্দ্রসংগীতটা নিয়মিত গাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী কবির সৃষ্টির প্রেমে পড়ে নজরুলসংগীতের সাধনাই করে গেছি।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
সন্জীদা খাতুন আমাদের সংস্কৃতি জগতের মহিরুহ ছিলেন। এখন ক্রান্তিকাল চলছে। এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়ায় হতাশার মধ্যে পড়ে গেছি আমরা। তাঁর থাকাটা আমাদের জন্য একটি জোরের জায়গা ছিল। যে কোনো পরামর্শে এ মানুষটিকে আমরা কাছে পেতাম। তিনি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁকে যারা অনুসরণ করতেন, তাদের কাছে তিনি ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলেন। সবদিক থেকেই অনুসরণীয় একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর আত্মা শান্তি পাক– এটাই চাওয়া।
মামুনুর রশীদ
বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ ছিলেন সন্জীদা খাতুন। এ মানুষটিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম একটি যুগলবন্দি হিসেবে– ওয়াহিদুল হক এবং সন্জীদা খাতুন। তারা ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছায়ানটের প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল সবসময়ই। ১৯৬৬ সাল থেকে তারা রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন। শুধু রবীন্দ্রসংগীত চর্চা নয়, রবীন্দ্রচর্চাও করে গেছেন আজীবন। এ দেশে রবীন্দ্রচর্চায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা আপা। দেশের সংস্কৃতিতে যে ধরনের প্রগতিশীল ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে সন্জীদা আপা সবসময় থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের যোগ্য কন্যা তিনি। সন্জীদা আপার বাবা নজরুলের বন্ধু ছিলেন। ছোটবেলা থেকে যে আবহে তিনি বড় হয়েছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেটা অক্ষুণ্ন ছিল। সন্জীদা খাতুনের মতো এ ধরনের একজন মানুষের আবার জন্ম নেওয়া শতবর্ষের ব্যাপার। যখনই কোনো প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম, তিনি খুব ইতিবাচকভাবে দেখতেন। কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতানৈক্য হতো। আবার পরক্ষণেই তা ঠিক হয়ে যেত। তিনি রেখে গেলেন অনেক কিছু। তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। একজন সন্জীদা খাতুনের চিরবিদায় মানেই উজ্জ্বল এক জ্যোতিষ্কের নিভে যাওয়া। এই মহারথীর জীবনের সমাপ্তি প্রশান্তির হোক– এটাই আমার চাওয়া।
রামেন্দু মজুমদার
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন অর্থাৎ ১৯৬১ সাল থেকে সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে আমার পরিচয়। দীর্ঘদিন তিনি বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে গেছেন। তৈরি করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো ‘ছায়ানট’। এসবের মধ্য দিয়ে শুদ্ধসংগীতের প্রচার এবং আমাদের প্রগতিশীল ধ্যানধারণা, মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ভূমিকা– সব মিলিয়ে তিনি আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর শূন্যতা দীর্ঘদিন অনুভূত হবে। সব কাজেই তিনি গম্ভীর এবং দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি কোনো রকম আপস করতেন না। যাই করা হোক না কেন, তিনি চাইতেন সবচেয়ে ভালো কাজ।
আতাউর রহমান
আমি তাকে মিনু আপা বলে ডাকতাম। মিনু আপা নেই– ভাবতেই পারছি না। রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন আমাকে। তখন আমি বললাম, আমি তো গানের লোক নই, আমাকে কেন এর সাধারণ সম্পাদক বানানো হলো। মজা করে তাঁকে বললাম, আমাকে কী ভাড়াটিয়া হিসেবে বানানো হলো? সন্জীদা খাতুন একজন জ্ঞানী, সুগায়িকা ও সংগঠক ছিলেন। এই তিনটি গুণকে তিনি সমন্বিত করেছিলেন। এই মানুষটির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই পরিচয়। তিনি খুব কঠোর ছিলেন। কাজের বিচ্যুতি পছন্দ করতেন না।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত হয় ছ ল আম দ র ছ য় নট করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
মিয়ানমারে ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির আশঙ্কা, বিভিন্ন অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা
পরপর দুটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে মিয়ানমারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস এর তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭। এর উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের মান্দালয় যা বাংলাদেশে থেকে ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে। এতে শুধু মিয়ানমার নয়, এর প্রভাব অনুভূত হয়েছে ভারত, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত অনুসন্ধান এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে।
ভূমিকম্পে কতটা ক্ষতি হয়েছে মিয়ানমারে তার সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে মিয়ানমার থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। খবর-রয়টার্স
তবে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশটির অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির খোঁজে ইয়াঙ্গুনে অনুসন্ধান শুরু করেছি। ঘুরে ঘুরে দেখছি। এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই।’
মান্দালয় শহরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে ধসে পড়া ভবন এবং শহরের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। রয়টার্স তাৎক্ষণিকভাবে পোস্টগুলো যাচাই করতে পারেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মান্দালয়ে একাধিক ভবন ধসে পড়েছে। মান্দালয়ের তিন বাসিন্দা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় রাস্তায় লোকজন ছুটে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেশ কয়েকটি ভবন ধসে পড়তে দেখেছেন।
ফয়েজ নামে একজন বাসিন্দা জানান ভূমিকম্পের সময় তিনি একটি মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। তিনি বলেন, আমি নামাজ পড়ার জন্য হাত পরিষ্কার করার সময় কাঁপতে শুরু করে। আমরা সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসি।
আরেক বাসিন্দা হেত নাইং বলেন, রাস্তার পাশে তার একটি চায়ের দোকান ধসে পড়েছে। লোকজন ভেতরে আটকা পড়ে। আমরা ভেতরে যেতে পারিনি। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।