আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামা লেখার পর ১৯৭১ সালকে ধরে একটা উপন্যাস দাঁড় করানোর প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। তাঁর এ পরিকল্পনায় বগুড়ার একটা পীরের পরিবার ছিল কেন্দ্রে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ‘পীরবাড়ি’ বলে পরিচিত বাড়ির সাতজন ছেলেকে এক রাতে খুন করেছিল। ধর্মের নামে এ রকম অসংখ্য বর্বর হত্যাকাণ্ড করেছে তারা এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা। ইলিয়াসের পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের পুরো জগৎ, সমাজ, ইতিহাস, চৈতন্য আর পরম্পরাকে আবিষ্কার করা। সেভাবেই তিনি কাজ করছিলেন। এর জন্য পাহাড়ি এলাকাসহ বহু স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্যানসারের জন্য ইলিয়াসের পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে তখন। মহাশ্বেতা দেবীর কাছে সেই সময়ে তাঁর লেখা এক চিঠিতে তিনি যা লিখেছেন—আমাদেরও যা বলতেন—তা মোটামুটি এ রকম, ‘আমার তো পা নাই। তা-ও দেখি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কতটা পাহাড়ে উঠতে পারি, কাজ করতে পারি। সে জন্য নিজের কলেজের সিঁড়ি ভেঙে প্র্যাকটিস করছি!’
প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ওপর উপন্যাস লিখতে গিয়ে এত পেছনের মানুষদের কেন দেখতে চাইলেন ইলিয়াস? কেন এত পুরোনোকালের মানুষের লড়াই নিয়ে কাজ করতে হবে তাঁকে? কৈবর্ত বিদ্রোহের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কী সম্পর্ক? অতীতের বিদ্রোহ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মানুষের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে? পারে আসলে। একটা অঞ্চলে, একটা জনগোষ্ঠীতে যে লড়াইগুলো হয়, তা মানুষকে তার স্বপ্নের সমান বড় করে তোলে। তার স্মৃতি থেকেই যায়, ধারাবাহিকতায়, পরম্পরায়, অচেতনে—নিঃশেষ হয়ে যায় না। ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের অঞ্চলে যেমন সন্ধান পাই তেভাগা আন্দোলনের লড়াই, যা মানুষকে এখনো শক্তি দেয়। ইলিয়াসের খোয়াবনামায় তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শহীদ মজনু শাহ পাকুড়গাছে বসে এ সময়ের মানুষদের চৈতন্যকে নাড়া দিতে থাকে। অনেক ব্যর্থতার ওপরেই আসলে সাফল্য দাঁড়ায়। রোজা লুক্সেমবুর্গের একটা কথা মনে পড়ে, ‘ইউ লস, ইউ লস, ইউ লস, ইউ উইন।’ হারতে হারতে হারতে তারপরে বিজয় অর্জন করা যায়।
বাংলাদেশের মানুষ কী করে, কোন সাহসে, কোন বলে, কোন চৈতন্যে, কোন স্বপ্নের জোরে কিংবা ঘোরে একটা ভয়ংকর, প্রশিক্ষিত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারল? আসলে একটা জনগোষ্ঠীর সাহস বা শক্তি একটা নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় না। জাগরণে–স্বপ্নে–চেতনে-অচেতনে তার সুতা বাঁধা থাকে নানা কালে নানা উত্থানের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে যখন কাদাপানি, খাল-নদী, গ্রাম-শহরে আমাদের মরণপণ যুদ্ধ হচ্ছে, আমরা তখন মানুষের মুখে ক্ষুদিরামের গান শুনি কিংবা প্রীতিলতা-সূর্য সেনের গল্প শুনি। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই, ফকির-সন্ন্যাসী-সিপাহি-সাঁওতাল বিদ্রোহ, টঙ্ক-নানকার-তেভাগা আন্দোলন আমাদের শক্তি জোগায়, ভাষা আন্দোলনের সালাম-বরকত ডাক দেয়, রোকেয়ার কথা আসে। শুধু দেশের অতীত থেকে ডাক শুনি তা নয়, কাছাকাছি সময়ের সীমান্তের বাইরের ভিয়েতনামের গল্প আসে, চীন বিপ্লবের গল্প আসে, কিউবার বিপ্লবীরা আসে, ব্রিটিশবিরোধী ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যাঁরা স্মরণীয় তাঁদের কথা আসে, গল্প আসে, উপন্যাস আসে, এমনকি প্রাচীনকালের দাসবিদ্রোহ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব—সবকিছুই আমাদের কোনো না কোনোভাবে উৎসাহিত করে, শক্তি দেয়। জানা-অজানা এ যোগই আমাদের বড় করে তোলে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তাই বিশাল ঐতিহাসিক ক্যানভাসের মধ্য দিয়েই দেখতে হবে। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের মুক্তির যে যুদ্ধ, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল, যা সেই বছরে শেষও হয়নি। ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পর্ব। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাই তার উপস্থিতি পাই, অপূর্ণ প্রত্যাশার পুনরুচ্চারণ দেখি, পুনরুজ্জীবন দেখি। এ সময়ে আবার একাত্তরের গান কিংবা স্লোগান উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সে কারণেই ১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধ শুধু অতীতের বিষয় নয়, খুবই বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের বিষয়।
এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের মুক্তির যে যুদ্ধ, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল, যা সেই বছরে শেষও হয়নি। ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পর্ব। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাই তার উপস্থিতি পাই, অপূর্ণ প্রত্যাশার পুনরুচ্চারণ দেখি, পুনরুজ্জীবন দেখি। এ সময়ে আবার একাত্তরের গান কিংবা স্লোগান উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সে কারণেই ১৯৭১ বা মুক্তিযুদ্ধ শুধু অতীতের বিষয় নয়, খুবই বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের বিষয়।আমাদের ইতিহাসে সামরিক শাসনসহ নানা বর্ণের স্বৈরশাসন দেখেছি বারবার। পাকিস্তানকালে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন শুরু হলো। সেই সামরিক শাসন ১৯৬০-এর দশকজুড়ে বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা পাকিস্তানের জনগণের ওপর নিপীড়ন-আধিপত্যের পাথর হয়ে থাকল। ওই দশকে একদিকে বহু দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শাসনের বর্বরতা চলছে, আবার সেই সময়েই বিভিন্ন দেশে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলছে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও ব্যাপকতা লাভ করছে। প্রবল পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করে কিউবার অবিরাম এগিয়ে যাওয়া, ভিয়েতনামের অপুষ্ট দুর্বল মানুষদের প্রবল লড়াই বাংলাদেশের মানুষকেও অসীম সাহস জোগায় তখন।
ওই একই দশকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, টঙ্গীসহ সব জায়গায় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মতো শক্তিশালী উত্থানপর্ব তৈরি করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা আন্দোলনের কারণে এবং পরে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র আওতায় বন্দী ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিপুল জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তিনি মুক্তি পেলেন। ওই দশকে শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের প্রাধান্য ছিল, যা বিভিন্ন কারণে দ্রুত কমতে থাকে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা প্রধান ধারায় পরিণত হয়।
১৯৭০ সালের শেষ দিকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটি ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস, অন্যটি পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। সেই জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলের কত মানুষ মারা গেছেন, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট জানা যায়নি, তবে তা ১০ লাখের কম নয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কোনো মনোযোগ দেখা যায়নি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি, আমলাতন্ত্র ও বৈষম্যবাদী রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন হজমের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির জুলুম, অবহেলা, অপমানসহ জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।
সামরিক শাসনের আইনগত কাঠামোর অধীন সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তাতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সম্ভাবনায় পাকিস্তানের শাসনভিত্তি আতঙ্কিত হলো এবং কোনো সমাধানের পথে না গিয়ে আলোচনার নামে প্রতারণা চালিয়ে ২৫ মার্চ শুরু করল অভাবিত মাত্রায় নৃশংস গণহত্যা। সে রাতেই বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানকে চূড়ান্ত বিদায় জানিয়ে শুরু করেছে সর্বাত্মক বিদ্রোহ। পরের কয় মাসে দেশের সব প্রান্তে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট, ধর্ষণসহ দোজখি সব জুলুম চলেছে মানুষের ওপর। বিপরীতে সর্বস্তরের মানুষের জনযুদ্ধ দেশের সব প্রান্তে গড়ে তুলেছে অসাধারণ সশস্ত্র প্রতিরোধ।
শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হলেন ২৫ মার্চ রাতে। তিনি পুরো যুদ্ধেই অনুপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁর অনুপস্থিতির মধ্যেও তিনিই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নেতা ছিলেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ পুরো যুদ্ধকালে অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল। দেশের মানুষ যুদ্ধের পাশাপাশি তাঁর মুক্তির জন্য দোয়া-প্রার্থনা করেছেন, মুসলিম নারী-পুরুষ রোজা রেখেছেন। আবার এই শেখ মুজিবের শাসনকালই এ দেশে স্বৈরশাসনের সূচনা করেছিল। খুন, নৈরাজ্য, দুর্ভিক্ষ, বিরোধী মতের মানুষদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি মানুষের বিশাল প্রত্যাশাকে চুপসে দিয়েছিল। কিন্তু এর আগের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অতুলনীয় জনপ্রিয় নেতা। শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষাথী, নারী-পুরুষের পাশাপাশি সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর মধ্যে জিয়ার নাম বেশি আসে ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের পক্ষে’ তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য, যা হতবিহ্বল মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জিয়ার রাজনীতি নিয়েও প্রশ্ন আছে, তিনিও দেশের শাসকশ্রেণির অংশ। সামরিকীকরণ, সামরিক বাহিনীর ভেতরে অনেক হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি অনেক বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের এক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন, যা ঐতিহাসিক সত্য।
একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, যেখানে কতিপয় অপরাধী ছাড়া সমাজের সব অংশ সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছে। একটি চেতনাই তখন প্রধান হয়ে উঠেছিল যে আমরা এমন এক দেশ বানাব, যা পাকিস্তানের মতো হবে না, যেখানে ধর্মকে জালেমরা জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না, যে দেশে পাকিস্তানের মতো জাতি-বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণিগত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকবে না, যেখানে সব সম্পদ কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে না। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম ও জাতিগত বৈষম্য থেকে মুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে রাষ্ট্র এখন দেখছি, সেটির জন্য বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেনি।
মুক্তিযুদ্ধের দুর্বলতা সম্পর্কে, তার নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে, নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। এটা বলারও যুক্তি আছে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যথার্থ মুক্তির যুদ্ধ হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি। হলে দেশ আজ এ রকম অবনত, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নিপীড়নে জর্জরিত থাকত না। কিন্তু তাতে মানুষের লড়াইয়ের বিশালত্ব খর্ব হয় না।
মানুষের মুক্তির চেতনার ধার নষ্ট করার জন্য, স্বপ্নযাত্রা থেকে দেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক রকম চেষ্টা করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে শ্রেণিমৈত্রী গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত সপক্ষ শক্তি। নতুন শ্রেণিশক্তির আধিপত্য বৈষম্য বাড়িয়েছে। শাসকশ্রেণির নানা গোষ্ঠী একদিকে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যদিকে ধর্মকে জনবিরোধী রাজনীতির বর্ম হিসেবে অবাধে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন ও দুর্নীতি-দখল-লুণ্ঠন-সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে।
সে জন্যই মুক্তির যুদ্ধ আমাদের শেষ হয়নি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এই লড়াইকেই আবারও স্পষ্টভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। শোষণ-পীড়ন থেকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই, সাম্রাজ্যবাদসহ সব রকম আধিপত্য কিংবা লুণ্ঠন পাচারবিরোধী লড়াই, গণতন্ত্রের লড়াই, নারীর লড়াই, ধর্ম–লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যবিরোধী লড়াই, নতুন সমাজের লড়াই—সবই মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার অংশ। এটাই আমাদের বর্তমান এবং তৈরি করছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ধ র ব হ কত য় ১৯৭১ স ল র আম দ র কর ছ ল র জন য সময় র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ
‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমাদের চেতনায় এমন এক অনুভূতি সঞ্চারিত হয়, যা পরম আনন্দের। মুক্ত বাতাসে উড্ডীন পাখির যে অবারিত উন্মুক্ত পৃথিবী, তার নাম হয়তো স্বাধীনতা। কিন্তু এই উপমায় কি স্বাধীনতার তাৎপর্য সবটুকু বোঝা যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিই— না, বোঝা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা এমন এক মুক্তির স্বাদ যা কোনো উপমাতেই পরিপূর্ণ করা সম্ভব নয়, এ আনন্দ অনির্বচনীয়। এ কেবল অনুভব করবার বিষয়।
প্রিয় পাঠক কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। ‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান’ থেকে শুরু করে ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা মহান পুরুষ’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের তুলনা দিয়েও স্বাধীনতার আনন্দ আর বিশালতা শেষ করতে পারেননি কবি। গ্রামের পুকুরে অবাধ উচ্ছ্বল সাঁতারের উপমায়ও তা পরিপূর্ণ হয় না। তাই কবি যেমন খুশি তেমন লেখার প্রিয় কবিতার খাতার সঙ্গে উপমিত করেন প্রিয় স্বাধীনতাকে।
পরাধীনতার গ্লানির তিক্ত অভিজ্ঞতা না থাকলে স্বাধীনতার পরমানন্দ কিংবা তার মহিমা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় না। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের গ্লানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এই জনপদের মানুষকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরাধীনতার সেই গ্লানি থেকে মুক্তির আশায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল নেতাও তাঁর তরুণ বয়সে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবই প্রথম টের পেয়েছিলেন যে, এই স্বাধীনতায় অবাঙালি পাঞ্জাবি-পাঠান বেলুচসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালিদের স্বাধীনতার আনন্দ দিলেও বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। কারণ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা বন্দী হয়েছিল আরেক উপনিবেশ পাকিস্তানি অবাঙালি কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে। আর তাই ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকচক্র।
আরো পড়ুন:
অর্জন-অগ্রগতি তুলে ধরে জাতিকে সম্ভাবনার বার্তা প্রধান উপদেষ্টার
ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে নানা স্তরে স্বাধিকারের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সেই ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্তাৎপর্য।
সেই দীর্ঘ পরিসরে বিস্তৃত ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত অর্ধশতাব্দীর আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের দিকে তাকাই, তাহলেই বুঝতে পারি স্বাধীনতা আমাদের কী দিয়েছে! পঞ্চাশের দশকে যাদের জন্ম অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি পাকিস্তানি দুঃশাসনে কতটা জর্জরিত ছিল এই বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কী চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল এই জনপদ, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কেউ উপলব্ধি করবে! খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, যোগাযোগ, চিকিৎসাসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে চরম পশ্চাৎপদ ছিল এই বাংলাদেশ। অথচ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই, এমনকি উদ্বৃত্ত ফসলের অধিকারী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এই বাংলা ভূখণ্ড অর্ধাহারে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে কেবল এই ভিন্নতর সংস্কৃতির ও বাঙালি শাসকদের বৈষম্যনীতির কারণে। আর সেজন্য সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব বাংলায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। বলতে গেলে তা ভাষা আন্দোলন তথা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবদুর রশীদ তর্কবাগিশসহ বাংলাদেশের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম বৈষম্যমূলক নীতি তথা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন এ কথা সত্য, কিন্তু তার চূড়ান্ত পরিণতি দিয়েছেন অতুলনীয় দেশপ্রেমিক সাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবিচল নেতৃত্বেই প্রায় দুই দশকব্যাপী স্বাধিকারের আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল।
এ কোনো আবেগের কথা নয়, এ হচ্ছে ইতিহাসের সত্য। দুর্ভাগ্য যে ইতিহাসের এই অনির্বাণ সত্যকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে জারি আছে। যে শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই গণমুখী চেতনা থেকেও এ দেশের রাজনীতি বহু দূরে সরে যায়। পাকিস্তানি স্টাইলে স্বাধীন বাংলাদেশেও মুজিব হত্যার পর সামরিক শাসনের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। ইতিহাসের এই ঘটনা প্রবাহ স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হলো এ কারণে যে, আজ সম্পূর্ণ ভিন্নতারা প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি।
আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকী বা ৫৪তম স্বাধীনতা দিবসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন নানা চড়াই-উৎরাই এর দৃশ্যাবলী চোখের সামনে চলচ্চিত্রের পর্দার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে। একটা পরাধীন জাতি, ৪৭-এ স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েও চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত, অশিক্ষা কুসংস্কারে নিমজ্জিত! এমনকি অন্ন, বস্ত্র শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাও তার পূরণ হয় না, সে জাতিই আজ তৃতীয় বিশ্বের এক উদীয়মান বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রেই যার ঘটে গেছে অভাবিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন! পরাধীন পূর্ব বাংলার আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ আকাশ পাতাল ব্যবধান!
স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল বলেই আজ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের জৌলুস। পাকিস্তান আমলে যেখানে সমস্ত শিল্পকারখানার মালিক ছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা, যেখানে এ দেশে কোটিপতি তো দূরের কথা, লাখপতি বাঙালিও হাতে গুনে বের করার অবস্থা ছিল না, সেই দেশেই আজ হাজার হাজার কোটিপতি শিল্পোদ্যোক্তা, বড় বড় ব্যবসায়ী, বড় বড় সামরিক বেসামরিক আমলা যা পাকিস্তান আমলে ছিল কল্পনারও অতীত।
অনেকে বলবেন স্বাধীন দেশে ধনী আরও ধনী হয়েছে। এখনো চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে। গরিব ধনীর ভেদাভেদ আছে— একথা সত্য কিন্তু তারপরেও অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে না এই স্বাধীন দেশে। ধনী আরো ধনী হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু গরিব আরো গরিব হয়নি। দরিদ্র অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। এর সবই সম্ভব হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের কারণে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাবোধ দিন দিন কমে আসছে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও বিভ্রান্ত। তাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পঁচাত্তর পরবর্তী কালে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে ইতিহাস বিকৃতির এই চরম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ২৭ শে মার্চ থেকে হঠাৎ করে যেন শুরু হয়ে গেছে —ভাবটা এরকম! ৬৬ সালে শেখ মুজিব উপস্থাপিত বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা এবং তা জেনারেল ইহাহিয়া, ভুট্টোদের চক্রান্তে নস্যাৎ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র— এর কোনো কিছুই তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই!
এমনকি ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ হঠাৎ বেতার ঘোষণার মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্ধ করে দেয়ার পর পূর্ব বাংলায় যে গণ- অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল তারও কিছু ইতিহাসে নেই তাদের। তাদের ইতিহাসে নেই মার্চের ২ তারিখ থেকে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণ, যার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইহাহিয়ার ঢাকায় আগমন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি সেনা সদস্য, মারণাস্ত্র গোলাবারুদ পূর্ব বাংলায় এনে গণহত্যার নীল নকশা প্রণয়নের তথ্যও। এমনকি তারা ভুলেও উচ্চারণ করে না মানব-ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রির বয়ান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিভ্রান্তি নিয়েই একাধিক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই দেশে। একাত্তরের বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে।
প্রজন্মের মধ্যে ছড়ানো সেই বিভ্রান্তি সম্প্রতি এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি চরম আস্ফালন দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তরুণসমাজ অতীতের মতো এখন আর রুখে দাঁড়াতে পারছে না। ১৯৭১ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ এক সময় ছিল শুধু স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল বদর আর জামাত-শিবিরের মধ্যেই বিব্রতকর একটি উপসর্গ। এখন তরুণ প্রজন্মেরও একটি বিস্তৃত অংশ স্বাধীনতাবিরোধীদের দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে কিংবা বলা যায় তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করেছিলেন যারা, সেই রাজনীতিবিদরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে পারেননি সেভাবে।
আমরা যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণকারী তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৭ই মার্চের সেই উত্তাল জনসভায় শেখ মুজিবের উদাত্ত আহ্বান। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে এখনো ধনী প্রতিধ্বনিত হয় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মশিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই ছাত্র তরুণদের স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা— এসব ছবি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রজন্মের মধ্যে। সেদিন আমরা যারা কিশোর তরুণ যুবক ছিলাম তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মার্চ চিরজীবিত।
সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে মার্চ একটি ইংরেজি সাধারণ মাস। কিন্তু আমাদের কাছে যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বাস করি তাদের কাছে মার্চ এক ঐতিহাসিক গৌরবের মাস। অতুলনীয় আনন্দ বেদনার মহাকাব্য তুল্য একটি মাস। তাই মার্চ আমাদের চেতনায় সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলির ভয়াবহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে—যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানের এই অংশ একটি প্রদেশের উপর হিংস্র নেতৃত্বেও ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় তার নাগরিকদের উপর মেশিনগান কামান ট্যাংক নিয়ে নেমে পড়ে রাতের অন্ধকারে!
মার্চ আমাদের চেতনায় এবং স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনে সেই সব দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াল দিনরাত্রি—যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ফেলে সীমান্তে পৌঁছাতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়েও পথে পথে প্রাণ হারায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর এদেশে তাদের অনুচর ঘাতক-দালালদের আক্রমণে। মা-বোনেরা হারায় তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সম্ভ্রম এবং জীবন। তারপর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢোকার পরেও শত শত মানুষ শরণার্থী শিবিরে মারা যায় কলেরায়, অপুষ্টিতে অর্ধাহারে অনাহারে।
অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, শিশুখাদ্য নেই, ওষুধ নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন বাস্তবতার মধ্যেও বাংলার আপামর জনগণ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সশস্ত্র হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআর, আনসারসহ বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে যার অবস্থান থেকে। তারা তাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলার আপামর জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার।
কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে তথা মুজিবনগরে গঠিত ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অসামান্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, সেই অবিস্মরণীয় দিন-রাত্রির স্মৃতি এখনো আমাদের চেতনায় জীবন্ত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে লেখা নাটক জল্লাদের দরবার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনা সেইসব দিনরাত্রি কী করে ভুলবো আমরা! আমাদের স্মৃতিতে তা এখনো প্রতিধ্বনিময়।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না, এটাই ইতিহাসের চিরন্তন সত্য। স্বাধীনতার বিধি মূলে যারা আত্মদান করেছেন সেই লক্ষ লক্ষ বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি আজ স্বাধীনতার সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে।
লেখক: বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক
তারা//