আমি একনজরেই চিনে ফেলেছি উনি তোর আব্বা। তোর মতো মাঝারি গড়ন, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, উন্নত নাসিকা, তীক্ষ্ণ চিবুক, আয়তলোচন। আমিই এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আপনি কি ফারহানার কেউ হন? আমি ওর রুমমেট।’
‘হ্যাঁ মা, ফারহানা আমার মেয়ে। তুমি হলে ঢুকছ? তাহলে ওকে গিয়ে বলো, আমি এসেছি।’
বাপরে! ইয়াংকালে তোর আব্বা তো এক্কেরে নায়ক ছিল রে!
ফারহানা পুরোনো অ্যালবামে ওর বাবার যে ছবি দেখেছে, তার সঙ্গে রুমমেটের বর্ণনার খুব একটা মিল পেল না। উন্নত নাসিকা ঠিক আছে, কিন্তু গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল তো নয়ই; বরং বেশ কালো, আয়তলোচনও নয়। মায়ের সঙ্গে ডিভোর্সের পর তিনি তাঁর কানাডাপ্রবাসী মামাতো বোনকে বিয়ে করে সেখানেই চলে গেছেন। মাত্র চার মাস হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছে ফারহানা। রুমমেটকে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনো কিছু জানানো ফারহানার মতো অন্তর্মুখী মেয়ের ভীষণ অপছন্দের। কিন্তু রুমমেট কী ভাববে ভেবে চুলটা একটু আঁচড়ে নিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল। ওদের হলে অন্তত পনেরোজন ফারহানা আছে।
কোনো এক ফারহানার বাবা এসেছে। তার নাচুনে রুমমেট ভদ্রলোককে রুম নম্বর না জিজ্ঞাসা করেই নাচতে নাচতে এসে আবিষ্কারের আনন্দে আত্মহারা। ফারহানা ভাবল, গেস্টরুমের পাশেই ক্যানটিন, এককাপ চা খেয়ে রুমে ফিরবে, একনজরে রুমমেটের আবিষ্কৃত নায়কোচিত পিতৃমহোদয়কেও দেখে নেবে। ফারহানা ক্যানটিন থেকে চা নিয়ে গেস্টরুমের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে জানালা দিয়ে অনুসন্ধিৎসু চোখ ঘোরাল ভেতরে। হ্যাঁ, ঠিকই। অ্যানথ্রোপোলজির থার্ড ইয়ারের মহা পাজি ফারহানা আপু বাপের সঙ্গে আহ্লাদে গলে গলে কথা বলছে। পিতৃদেবকে এক পাশ দিয়ে অনিচ্ছুকভাবে দেখে ফারহানার একটু মনে হলো, ভদ্রলোকের চিবুক আর চিবুকে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ঠেসে কথা বলার ভঙ্গিটা খানিকটা ওর মতো। অমন তো হতেই পারে। ডান পায়ের ওপর বাঁ পা তুলে মোজা আর প্যান্টের খালি জায়গাটায় হাতের চেটো বোলাচ্ছেন। ওই ভঙ্গিটাও ফারহানার। হয়তো পৃথিবীর অনেকেরই। চা শেষ করে সে রিডিং রুমে গিয়ে বসল। এত তাড়াতাড়ি রুমে গেলে রুমমেট ভাববে, বাবার সঙ্গে ওর সম্পর্ক জুতসই নয়। কিন্তু রুমমেটকে সত্যিটা বলে দেওয়াই ভালো। মানে সবকিছু ভেঙে না বলে। ছোটবেলায় নানি-মা-খালাদের আলাপের মধ্যে ও যদি বিষয় না বুঝে জিজ্ঞাসা করত, লোকটা কেন ও কথা বলল নানু? নানু বলত, ‘তোমাকে এখন আঁটি ভেঙে শাঁস দিতে পারব না, ভাই।’ রুমমেটকে শাঁস না দিয়ে শুধু বলবে, উনি তার বাবা নন, অ্যানথ্রোর ফারহানা আপুর।
কিন্তু ওর মনের মধ্যে বেশ একটা গল্প দানা বাঁধে। রুমমেটের শতভাগ নিশ্চিত যে ভদ্রলোক একেবারে ওর মতো দেখতে। এক পাশ দিয়ে অতটা বোঝা না গেলেও অঙ্গভঙ্গিগুলোর সঙ্গে বেশ মিল। এমন তো হতেই পারে যে ওর মা ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রেমের অসতর্ক মুহূর্তে তাকে গর্ভে এনেছিল। তারপর কোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে ওই বদ বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু আসলে তো তা নয়। নিজের মায়ের সঙ্গে ফারহানা অতটা খোলামালা নয়, যতটা ওর টুকু খালা, মানে ছোট খালার সঙ্গে। টুকু খালা ওকে বলেছে, যতটুকু পারে।
‘মামাতো বোনের সাথে মানি ভাইয়ের অনেক আগে থেকেই প্রেম ছিল। সেটা কোনো পরিবারের কেউ জানত না। আমি জানতাম কারণ, জিনাত, মানে দুলাভাইয়ের মামাতো বোন আমার ক্লাসমেট ছিল। ও বলত, মানি ভাইয়ের ওর প্রতি দুর্বলতার কথা। কিন্তু নিজের কথা কিছু বলত না। আমি একদিন ওর গলায় লাল রক্তজমা দাগ দেখেছিলাম। ও বারবার ওড়না দিয়ে ঢাকছিল। জানি না ওদের সম্পর্ক কতদূর পৌঁছেছিল। একসময় মানি ভাইয়ের, মানে তোর বাবার মামার পরিবারের সবাই কানাডায় চলে গেলে দূরের প্রেম আস্তে আস্তে মনে হয় স্তিমিত হয়ে যায়। জিনাতের বিয়ে হয়। তারও বছর দুই পর এদিকে বুবুর সাথে তোর বাবার বিয়ে হয়।’
ফারহানাকে ওর মা বলে দিয়েছিল, হোস্টেলে কোনো ধরনের অসুবিধা হলে হাউস টিউটর রওশন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রওশন ওর মায়ের জানি দোস্ত। হাউস টিউটররা যে খাইষ্টা!‘টুকু খালা, তুমি তো দিব্যি প্রেমের বিয়েটা মেরে দিলে। মায়ের কোনো জানাশোনা ছিল না?’ জানাশোনা শব্দটা ব্যবহার করে ফারহানা। প্রেম শব্দটা মায়ের জন্য ব্যবহার করতে ওর কেমন যেন অস্বস্তি লেগেছিল। জানাশোনা শব্দটা বেশ ভদ্রজনোচিত।
‘আমি তো তখন প্রাইমারিতে পড়ি। একদিন বুবু একটা চিঠি আমার ফ্রকের নিচে প্যান্টের কোমরে ভাঁজ করে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, “পোস্ট অফিসের পেছনে মাস্টার চাচুর বাসার জানালায় দেখবি, বাবু ভাই দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই চিঠিটা ওর হাতে দিয়ে চলে আসবি।” আমি তো ওই বাসায় বাবু ভাইয়ের বোনের সাথে এক্কা–দোক্কা খেলতে যাই। বাসার কাছে গিয়েই দেখি, বেবি দাঁড়িয়ে আছে। ওখানেই আমাদের এক্কা–দোক্কার ঘর কাটা। আমি চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বেবির সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা–দোক্কা খেলতে শুরু করে দিলাম। চিঠিটা কখন যে প্যান্টের ভাঁজ শিথিল করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, টের পাইনি।’
‘তাহলে মায়ের সেই চিঠি তোমাদের বাবু ভাইয়ের হাতে পৌঁছায়নি?’
‘আরে, বিকেলে তোর নানাভাই অফিস থেকে ফিরলে মাস্টার চাচি সেই চিঠি নিয়ে এসে মা-আব্বাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে লাগল। বুবু ঘরের ভেতর বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদছিল। ওরা চলে গেলে মা-আব্বা বুবুকে কিচ্ছু বলেনি। তার কিছুদিন পর আব্বা বদলি হয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে খুলনায় চলে গিয়েছিল।’
‘চিঠিতে কী লেখা ছিল, তুমি শুনেছিলে?’
‘শুনব কী? আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। আমি বাথরুমের মধ্যে গিয়ে বসেছিলাম। পরে বুবু আমাকে অবশ্য কিছু বলেনি। ও বোধ হয় ভেবেছিল, চিঠি দিতে গেলে মাস্টার চাচি দেখে ফেলে কেড়ে নিয়েছিল।’
‘আহারে! তোমার মনে আছে টুকু খালা, তোমাদের সেই বাবু ভাইয়ের চেহারা?’
‘নেই আবার? একেবারে নাদিম কাটিং।’
‘নাদিম কে?’
‘পাকিস্তানি হিরো।’
ফারহানাকে ওর মা বলে দিয়েছিল, হোস্টেলে কোনো ধরনের অসুবিধা হলে হাউস টিউটর রওশন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রওশন ওর মায়ের জানি দোস্ত। হাউস টিউটররা যে খাইষ্টা! একমাত্র রওশন আপাই সবার মাই ডিয়ার। আজানুলম্বিত চুল খোলা রেখে আঁচল ছেড়ে রোজ সন্ধ্যায় রিডিংরুমের বারান্দা ধরে হাঁটেন। মিষ্টি হেসে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন। একদিন ডাইনিংয়ের দিকে যেতে ফারহানাকে রীতিমতো জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, ‘আজ রাতে আমার বাসায় খাবে। আমার দোস্ত যদি জানতে পারে, এক দিনও তোমাকে বাসায় ডাকিনি, তাহলে আমার চুলের বেণি দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে মেরে ফেলবে।’
টুকু খালার কাছে মা-বাবার বিচ্ছেদ সম্পর্কে ফারহানা যতটুকু জেনেছে, তাতে বাবার প্রাক্তনের সঙ্গে বাবার পুনর্মিলনকেই দায়ী করা হয়েছে। মা তো আর বিয়ে করেনি। তেমন কোনো মারাত্মক অভিযোগও ফারহানা শোনেনি। কিন্তু অতটুকুই কি সব? রওশন খালা কি আরও কিছু জানেন?
সেদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ফারহানার অনুরোধে রওশন আক্তার বলেছিল ওর জানি দোস্তের কথা। বলেছিল, ‘রুকু আসলে তোমার বাবার সাথে সুখী ছিল না। ভদ্রলোক ভীষণই ডমিনেটিং, সন্দেহবাতিক আর শূচিবায়ুগ্রস্ত ছিল। রুকু বলত, “জানিস, ওর আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত ইস্ত্রি করে দিতে হয়।” রুকু ভালো ছাত্রী ছিল। ওর খুব শখ ছিল কলেজে পড়ানোর। তোমার বয়স যখন সাত, তখন ও একটা বেসরকারি কলেজে পড়ানোর প্রস্তাব পায়। ব্যস, সেই থেকেই মনোমালিন্য চরমে। এটাও না বলে পারছি না, তোমার বাবা নাকি রুকুকে বলত, “মেয়ে আমার-তোমার কারও চেহারাই পায়নি। তাহলে ও কার মেয়ে?” আবার অনেক দিন ধরেই কানাডায় যাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালাচ্ছিল। এসব একটা ছুতোও হতে পারে। ওদিকে তার প্রাক্তন মামাতো বোনেরও ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোমার জন্ম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের পর রুকু তোমাকে নিয়ে তোমার নানির ওখানে চলে যায়। তারপরের ব্যাপার তো জানোই।’
বাবার প্রতি ফারহানার এত তীব্র ঘৃণা আগে জন্মেনি। কিন্তু মা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই রওশন খালা বলেছিল, ‘ও রকম জঘন্য মানসিকতার একটা লোকের সাথে সংসার করার চেয়ে না করাই ভালো হয়েছে। আমি অবশ্য ওকে আবার বিয়ের কথা বলেছিলাম। ও বলেছিল, বিয়ের সাধ ওর মিটে গেছে।’
‘মার কি কাউকে পছন্দ ছিল, রওশন খালা?’
‘ও কিছু বলেনি। টুকু বলেছিল, ওদের বাসার কাছে বাবু ভাই নামে এক প্রিয়দর্শন ছেলে ছিল, বুবু ওকে ভালোবাসত। তোমার নানা বদলি হয়ে চলে গেলে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।’
এক শুক্রবার সকালে রিডিংরুমে পড়বে বলে বই হাতে ঢুকতে গিয়ে ফারহানা দেখে, ওর রুমমেটকে ঘিরে ওর ক্লাসমেটরা খুব হল্লা করছে। কেউ দৈনিক পত্রিকা সামনে নিয়ে জোরে জোরে কবিতা পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ওর রুমমেটের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। তা–ই নিয়ে বন্ধুদের উল্লাস। কবিতা-টবিতা নিয়ে ফারহানার অত আদিখ্যেতা নেই। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল অব্দিই ওর পদচারণ। আর আধুনিক কবিতা? ওসবের মাথামুণ্ড বোঝার জন্য ও মাথা ঘামায় না। ওর রুমমেট আকাশে চাঁদ উঠলে কবিতা পড়ে, ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে। চমৎকার, ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’ শুনতে শুনতে ফারহানার এ দুটো লাইন একেবারে মুখস্থ। কিন্তু ওর ছাইপাঁশ কিচ্ছু বোঝে না। বন্ধুদের উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে ও পত্রিকার পাতাটা নিয়ে চোখ বোলায়।
কবিতার শিরোনাম ‘নট ও নটী’:
‘যখন তুমি নিমগ্ন হও তারই সাথে,
যেজন তোমার মন্ত্রপড়া নিয়ম সাথি
বন্ধ চোখে সবটুকু তার গ্রহণ করো?
নিভিয়ে দিয়ে বিরক্তিকর সকল বাতি
চেনা ঘ্রাণে আশ্লেষে যে মুখটি ধরো,
সে মুখ যখন বিমুখ করে অন্ধকারে
না পাওয়া সেই কাঙ্ক্ষিতজন সুদূরতম,
আলিঙ্গনের আসন পেতে বসাও তারে?
প্রতারণার বৈধ ঘরে শয্যা পেতে,
যখন তুমি নিমগ্ন হও তারই সাথে
সে-ও কি তখন না পাওয়া ধন বুকে বেঁধে,
অভিনয়ের মঞ্চ কাঁপায় গভীর রাতে?’
কবিতাটা অত কঠিন নয়। তারপরও বিষয়টা ভালোমতো বোঝার জন্য ফারহানা রুমমেটকে রাতে জিজ্ঞাসা করে। ফারহানার বিশ্লেষণের সঙ্গে মিলে গেলে রুমমেট ওকে জড়িয়ে ধরে, ‘ইউ আর গ্রেট, রুমমেট! কবিতা তো মক্তবের মেয়ে, চুল খোলা আয়েশা আক্তার’ বলে ফারহানার দিঘল চুল আঙুলে পেঁচাতে থাকে।
‘কিন্তু বুড়ি চাঁদ আর ইঁদুর ধরার কবিতাটা একদিন বুঝিয়ে দিস।’
‘হ, বোঝাব। যেদিন আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।’
বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক প্রচারিত হয়। আফজাল-সুবর্ণার নাটক হলে তো হলের মেয়েরা সন্ধ্যের পর ডাইনিং থেকে খেয়ে টিভিরুমে থালা-ঘটি-বাটি-গ্লাস চেয়ারের ওপর রেখে চেয়ার দখল করে রুমে চলে যেত। নাটক শুরু হওয়ার আগে আগে এসে নিজের প্লেট সরিয়ে আরামে বসে যেত। ফারহানা খালি চেয়ার খুঁজে পাচ্ছিল না সে রাতে। অ্যানথ্রোর সেই ফারহানা আপা জানালার চওড়া ধারির পা ছড়িয়ে ওপরে বসে ছিলেন। তিনি ডেকে নিলে ফারহানা ওর মুখোমুখি বসে। ফারহানা এই প্রথম এত কাছ থেকে অ্যানথ্রোপলজির ফারহানা আপাকে দেখে। রুমমেট যার বাবাকে ওর বাবা বলে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছিল। নাটক শুরু হতে তখনো দেরি। ফারহানা আপা বললেন, ‘দুনিয়ার ফারহানা আমাদের হলে। তোর কোনো ডাকনাম নেই?’
‘না। ফারহানাই।’
‘আমার ডাকনাম বাবুনি। এ নামেই ডাকিস।’
ফারহানা এমনিতে একটু মুখচোরা। কিন্তু ওর খুব ইচ্ছে হয় একবার জিজ্ঞাসা করতে, আচ্ছা বাবুনি আপা, আপনার বাবার নাম কি বাবু? যাহ! তা–ই কি জিজ্ঞাসা করা যায়? ওই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে গেল। মেয়েরা একসাথে হইহই করে উঠল। বাবুনি আপা দিল এক চিলচিৎকার। বিরক্তিতে যাদের কাছে স্টিলের গ্লাস–বাটি ছিল, তারা তা দিয়ে চেয়ারে বাড়ি দিতে লাগল। খাইষ্টা হাউস টিউটর হেলেনা আপা চিৎকার করতে করতে এসে বললেন, ‘এই মেয়েরা, এই মেয়েরা, থামো! ইলেকট্রিক লাইনে গন্ডগোল। এক্ষুনি ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এত বাড়াবাড়ি করতে পারে এরা!’
মেয়েরা ঘটি-বাটি পেটানো বন্ধ করল। সেই অন্ধকারে ফারহানা সাহস নিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘বাবুনি আপা, আপনার আব্বার নাম কী?’
‘গোলাম মোহাম্মদ আজমত আলী তরফদার। কেন রে?’
‘না এমনি।’ বলতেই কারেন্ট চলে এল। মেয়েরা আবার গ্লাস-বাটি পিটিয়ে বিদ্যুৎকে স্বাগত জানাল। বাবুনি মাস্তানদের মতো কানফাটানো শিস দিল।
বাবুনি উজ্জ্বল আলোয় ফারহানার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোদের বাড়ি কোথায় রে ফারহানা? তুই দেখতে ঠিক আমার এক ফুফুর মতো।’
‘যশোর। আপনার সেই ফুফু কোথায় থাকে?’
‘লে হালুয়া! সে হচ্ছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না প্রেমিকা। দু-দুবার বিয়ে–ডিভোর্স সেরে এখন প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে।’
নাটক শুরু হয়ে গেছে। একেবারে পিনপতন নীরবতা। বাবুনি আপা গোগ্রাসে নাটকের কলাকুশলীদের নাম গিলছে। ফারহানা বোধ হয় আর একবার মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি এখন কোথায়?’
‘কে জানে কোন চুলোয়? নে নাটক দেখ।’
ফারহানা নিজেই মনে মনে জবাব দেয়, ‘আমি জানি উনি কোথায়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ল র জন য এক ব র একদ ন বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
সড়কে রক্তের দাগ
ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সংক্রান্ত সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক খবরগুলো বড় বেদনার। স্বাভাবিক সময়েই অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। শহীদ রওশনের মায়ের চোখের পানি এখনও শুকায়নি। ২০১৮ সালের সেই জুলাইয়ের সকালে তিনি তাঁর ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন স্বপ্ন নিয়ে। ফিরে পেয়েছিলেন রক্তাক্ত দেহ। একটি বেপরোয়া বাসের চাকায় শুধু একটি প্রাণই নয়, একটি পরিবারের সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে গড়ে ২২ জন প্রাণ হারান। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে একটি পরিবারের অশ্রু আর অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গত দশকে আমরা হারিয়েছি ৭৫ হাজার প্রাণ, যা একটি ছোট শহরের জনসংখ্যার সমান।
আমাদের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর মিছিল চলার উন্মুক্ত প্রান্তর। প্রতি ১০০টি গাড়ির মধ্যে ৩৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ। ৪০ শতাংশ চালক বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালায়। এর পেছনে রয়েছে জটিল নেটওয়ার্ক– দুর্নীতি, অদক্ষতা। সর্বোপরি আমাদের সামাজিক অবক্ষয়।
২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। কিন্তু ছয় বছর পর আমরা কতটুকু এগিয়েছি? ডিজিটাল লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু হয়েছে, কিন্তু অনেক আবেদনকারী এখনও
দালালের কারণে হয়রানির শিকার। আইন হয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল।
আমাদের সমস্যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়। এটি মূলত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের ছাপ। আমরা যেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছি, সেখানে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ পিছিয়ে পড়ছে।
সরকারের নতুন উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন সামাজিক বিবেককে জাগ্রত করা। প্রত্যেক চালক যেন বুঝতে পারে, তার হাতে শুধু স্টিয়ারিং নয়, অসংখ্য প্রাণের দায়িত্বও রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে গাড়ি পরিদর্শন– সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু সড়ক নয়, আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত যানবাহন ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
২০১৮ সালের সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল– পরিবর্তন সম্ভব। আজ আমাদের প্রয়োজন সেই চেতনাকে আবার জাগিয়ে তোলা। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য, প্রতিটি দুর্ঘটনা অপ্রয়োজনীয়। রওশনের মায়ের মতো চোখের জল যেন আর কোনো মাকে ফেলতে না হয়। সড়কগুলো যেন আর না হয় কবরস্থান। এটি শুধু একটি স্বপ্ন নয়, অধিকার। আসুন,সবাই মিলে গড়ে তুলি এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা হবে অতীতে ঘটে যাওয়া করুণ ইতিহাস, যা বর্তমানে নেই।
মো. রাইসুল ইসলাম: স্বেচ্ছাসেবক, চট্টগ্রাম