বিশ্বমানবতার স্বাধীনতার মাস রমজান
Published: 26th, March 2025 GMT
ইসলাম সব মানুষকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লাভের অধিকার দিয়েছে। মানবতার মুক্তির সনদ আল–কোরআন আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি নাজিল হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে। রমজান মাসেই রাসুলুল্লাহ (সা.) আত্মার স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, মানুষের গোলামি বা দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘোষণা করলেন, জালিম শাহি ও জুলুমের জিঞ্জির থেকে মুক্তির ঘোষণা দিলেন। তাগুতি শাসন ও শোষণ থেকে এবং সব শয়তানি শক্তির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
‘রহমাতুল লিল আলামিন’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমানা অন্যের অধিকারের প্রাচীর দ্বারা সীমাবদ্ধ।
রমজান মাস ইসলামি দর্শনে যেমনি স্বাধীনতার মাস, তেমনি বিজয়েরও মাস। ইসলামের প্রথম জয় বদর বিজয় হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখেই। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ জয় মক্কা বিজয় হয়েছিল অষ্টম হিজরিতে ১৯ রমজানে।
শুধু জাগতিক স্বাধীনতা ও বিজয় নয়; বরং আত্মিক মুক্তি ও বিজয় সম্ভব এই রমজান মাসেই। যার জন্য প্রয়োজন যথাযথ উপায়ে সিয়াম সাধনা। তাকওয়া, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতাও বিজয়ের পূর্বশর্ত। আত্মা বা নফস মোহমুক্ত ও স্বাধীন হলেই প্রকৃত অর্থে দুনিয়ার বিজয় বা সফলতা এবং পরকালে মুক্তি বা জীবনের সার্থকতা লাভ হয়।
মনোজগতে মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য, সংযম এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসাই মানুষকে সব ক্ষেত্রে সফলতা এনে দেয়।
কোরআন মজিদে এ বিষয় বোঝাতে স্বৈরাচারী জালুতের বিপুল সৈন্যর সঙ্গে হজরত তালুতের স্বল্পসংখ্যক মুজাহিদ বাহিনীর সফলতা ও বিজয়ের কাহিনি উল্লেখ করা হয়েছে। ‘অতঃপর তালুত যখন সৈন্যবাহিনীসহ অভিযানে বের হলো, সে তখন বলল, “আল্লাহ একটি নদী দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। যে তা থেকে পানি পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে এর স্বাদ গ্রহণ করবে না, সে আমার দলভুক্ত। এ ছাড়া যে এক আঁজলা পরিমাণ পানি গ্রহণ করবে, সে–ও আমার দলভুক্ত থাকবে।” অতঃপর অল্পসংখ্যক ব্যতীত তারা তা (নদী) থেকে পান করল। সে (তালুত) এবং তার সঙ্গী ইমানদারেরা যখন তা (নদী) অতিক্রম করল, তখন তারা বলল, জালুত ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তি আজ আমাদের নেই। কিন্তু যাদের দৃঢ়প্রত্যয় ছিল আল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে।
‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। তারা যখন যুদ্ধার্থে জালুত ও তার সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হলো, তখন তারা বলল, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ধৈর্য দান করুন, আমাদের দৃঢ়পদ ও অবিচল রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” সুতরাং তারা আল্লাহর হুকুমে তাদের পরাভূত করল, দাউদ (আ.) জালুতকে হত্যা করলেন, আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন, তা তাকে শিক্ষা দিলেন।
‘আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগৎসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল। এসব আল্লাহর আয়াত, আমি তোমার কাছে তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করছি; আর নিশ্চয়ই তুমি রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৪৯-২৫৩)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স ব ধ নত স ব ধ নত র রমজ ন ম স ও ব জয় আম দ র আল ল হ ইসল ম করল ন
এছাড়াও পড়ুন:
আল কুদস দিবস ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতায় করণীয়
মসজিদুল আকসা বা আল কুদস ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে অবস্থিত। এটি বায়তুল মুকাদ্দাস নামে পরিচিত। কুদস অর্থ পবিত্র। বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত। প্রিয় নবীজি (সা.) মিরাজের রাতে প্রথমে মসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ) থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করেন। (সুরা ইসরা, আয়াত ১)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজ গমনের সময় মসজিদুল আকসায় সব নবী-রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি ইমামুল আম্বিয়া (সব নবীর ইমাম) ও সাইয়্যিদুল মুরসালিন (সব রাসুলের নেতা) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ফিলিস্তিনে বহু নবী-রাসুলের স্মৃতি রয়েছে, এর আশপাশে অনেক নবী-রাসুলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণের স্থান, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির উৎসভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। এই পবিত্র ভূমির ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত রয়েছে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর হজরত দাউদ (আ.)-এর সন্তান হজরত সুলাইমান (আ.) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর উদ্বোধন করেন।
মানবজাতির প্রথম কিবলা ছিল কাবা শরিফ, তবে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) নবুয়ত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকেই নামাজ পড়তেনমানবজাতির প্রথম কিবলা ছিল কাবা শরিফ, তবে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) নবুয়ত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকেই নামাজ পড়তেন। মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। যার স্মারক হিসেবে মদিনায় মসজিদে কিবলাতাইন (দুই কিবলার মসজিদ) এখনো বিদ্যমান। এ ঘটনাকে তাহবিল কিবলা বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৪২-১৫১)।
এ কারণেই বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত। হাদিস শরিফে এসেছে, কাবা শরিফ তথা মসজিদুল হারামে নামাজের সওয়াব এক লাখ গুণ, মসজিদে নববিতে ৫০ হাজার গুণ এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে ২৫ হাজার গুণ। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ইবাদতের উদ্দেশ্যে তিনটি মসজিদে সফর করা যায়—মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা। (মুসলিম)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৪৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) পুনরায় জেরুজালেম মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর পর থেকে খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এই উদ্দেশ্যে ইহুদিরা তৎকালীন তুর্কি সালতানাতের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের অনুমতি চায়, কিন্তু তিনি তাদের এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন দখল করে এবং ১৯২০ সালে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ইহুদিরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী জায়নবাদী অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়, যা আজও চলছে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জোরপূর্বক মসজিদুল আকসা দখল করে নেয়। এরপর মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে। দখলদার ইসরায়েল একের পর এক মুসলিম এলাকা দখল করে বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে এবং হত্যা, গুম, নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইসরায়েলের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিয়েছে।
১৯৭৯ সাল থেকে আল আকসা মসজিদ মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর রমজানের শেষ শুক্রবার ‘আল কুদস দিবস’ পালন করে আসছে। এখন এটি ফিলিস্তিন মুক্তির এবং বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সম্মিলিতভাবে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, আর বিভক্ত হয়ো না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৩)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]