সরকারি চাকরিতে ৭ শতাংশ কোটার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারের কমিটি
Published: 26th, March 2025 GMT
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কোটাপদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করেছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (বিধি অনুবিভাগ) আহ্বায়ক করে গতকাল মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) এ কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কমিটি আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করবে।
আরও পড়ুন৩ এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন, আওতার বাইরে যাঁরা২৩ মার্চ ২০২৫কমিটির সদস্যরা হলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। কমিটির সদস্যসিচিব করা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিবকে (বিধি-১ শাখা)।
আরও পড়ুনচীনের সেরা ১০ স্কলারশিপ: টিউশন ফি মওকুফ-আবাসন-চিকিৎসার সঙ্গে মিলবে মাসিক ভাতাও৩ ঘণ্টা আগেকমিটির কার্যপরিধিসরকারি চাকরিতে নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটার প্রয়োগপদ্ধতির পর্যালোচনা ও সুপারিশ প্রণয়ন করবে।
কমিটি প্রয়োজনে যেকোনো সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একজন জীবন শিল্পী
প্রথম পরিচয়
শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চারুকলায়। চারুকলা তখন ঢাকা আর্ট কলেজ। সালটা ১৯৭৪। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তখন আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। হামিদুজ্জামান খান সেই পরীক্ষায় গার্ড দিচ্ছিলেন। আমি তাঁকে খুব একটা লক্ষ্য করিনি। কিন্তু তিনি যে লক্ষ্য করছিলেন আমাকে, তার প্রমাণ মিলেছে পরে।
পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হই। তখন চারুকলায় পাঠ আজকের দিনের মতো ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ছিল না আলাদা কোনো বিভাগ। সবাইকে সব বিষয় পড়তে হতো। তৃতীয় বর্ষে কোনো একটি বিশেষ বিষয় নেওয়া যেত। হামিদুজ্জামান খান ছিলেন ভাস্কর্যের শিক্ষক। যদিও তৃতীয় বর্ষের আগে আমি তাঁর ক্লাস পাইনি।
ভর্তি পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হবো কিনা তিনি জানতেন না। যখন আমাকে ক্যাম্পাসে দেখলেন, উচ্ছ্বসিত হলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক স্যার। আমাদের আরেক কিংবদন্তি। সেই সময়ে আমার প্রতি আগ্রহের প্রতি যত্ন নেওয়ার অবকাশ হামিদের হয়নি। কারণ তিনি দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভারতের বরোদায় বিখ্যাত মহারাজা সাহজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে দুই বছর পর ফিরে এসে তিনি আমার খোঁজ করলেন। শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। আর্ট কলেজের অফিস থেকে আমার বাড়ির ঠিকানা বের করাটা তাঁর জন্য কঠিন ছিল না।
তাঁকে আমার ভালো লাগত, কিন্তু তাঁর মতো করে ভাবিনি। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোয় আমি বিব্রত হলাম। সত্যি বলতে, তখন বিয়ে আমি করতে চাইনি। কম বয়সে আর্ট কলেজের বিদ্যা, দীক্ষা এসব মাত্র বুঝতে শুরু করেছি। বাসায় বললাম, আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আমার বাবার কিন্তু এদিকে হামিদকে পছন্দ হয়ে গেছে। বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে ছেলে ভালো, তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমস্যা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘তিনি একজন শিক্ষক হয়েও কেন এমন করছেন? আমি আর্ট কলেজে আর পড়ব না।’ বাবা বললেন, ‘ওকে বিয়ে করতে পারো। চারুকলায় তোমার একজন অভিভাবক হবে।’
বলেছিলাম আর পড়ব না, কিন্তু আবার এলাম। একদিন কাজ করছি, হামিদুজ্জামান এলেন। বললেন, ‘কেমন চলছে সব?’ আমি নিরাসক্তভাবে বললাম, ‘ভালো।’ তখন আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ শেষের পথে। তৃতীয় বর্ষে নিতে হবে নতুন বিষয়। কোন বিষয় নেবো আমি ঠিক করে ফেলেছি। হামিদ বললেন, ‘কোন বিষয় নেবেন?’ বললাম, ‘প্রিন্ট মেকিং।’ হামিদের পছন্দ হলো না। প্রিন্ট মেকিং ওঁর বিষয় নয়। বললেন, ‘ভাস্কর্য নিতে পারেন। বেশি ভালো হবে।’ আমি বললাম, ‘প্রিন্ট মেকিংই নেবো। আমার ভালো লাগে।’ শেষ পর্যন্ত আমাকে ভাস্কর্যই নিতে হয়েছিল। হামিদের কথা একটা কারণ। ব্যক্তিগত কৌতূহলও ছিল। এখন বলতে পারি, সেদিন আমি ভুল করিনি।
যদিও বাসায় তখন হামিদের প্রস্তাব বাবা সদ্বিবেচনায় রেখেছেন, আমাদের আরেকটি মানসিক টানাপোড়েন ছিল। আমরা ছিলাম পাঁচ বোন। আমি ছিলাম তৃতীয়। আমার আগের দুই বোন তখনও বিয়ে করেনি। তাদের অবিবাহিত রেখে আমার বিয়ে করাটা কেমন লাগছিল। কিন্তু হামিদের চাওয়ার কাছে হার মানতে হলো। ছিয়াত্তরের ডিসেম্বরে আমরা ঘরোয়াভাবে বিয়ে করি।
বিয়ের পর চারুকলায় যেদিন প্রথম যাই, সবাই ফুল নিয়ে এগিয়ে এলেন।
সেই মুহূর্তটা ভুলব না। খুব নার্ভাস ছিলাম। আনোয়ারুল হক স্যার, আমিনুল ইসলাম স্যার, আবদুর রাজ্জাক স্যার, মোহাম্মদ কিবরিয়া স্যার, সফিউদ্দিন আহমেদ স্যার, কাইয়ুম চৌধুরী স্যার সবাই ফুল দিয়ে গেলেন। তখন শাহবাগে ফুলের বাজার ছিল না। সব ফুল ছিল চারুকলার। এবং ফুলের তোড়া মালিরা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই হামিদের খুব প্রশংসা করছিলেন। বলছিলেন, ‘ও খুব ভালো ছাত্র। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় আমরা ভীষণ খুশি। তুমি একটু দেখো, ওর কাজ যেন কমে না যায়।’ কথাগুলো আমি মনে রেখেছিলাম।
বিয়ে-পরবর্তী অনেক মজার স্মৃতিই আছে। একটা স্মৃতি বিশেষ মনে পড়ে।
শিল্পী হামিদুজ্জামান
বিয়ের প্রথম দিকে শিল্পী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে আমার ধারণা, দর্শন খুব বেশি স্পষ্ট ছিল না। হামিদের কাজ ভালো লাগত। কিন্তু কোন পথে কতটা ভালো, তা নিয়ে বলা সম্ভব হতো না। ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখলাম, তখন নতুন করে তাঁর শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করি। ওঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল। দিনরাত কাজ করতেন। কাজ ছাড়া তাঁকে কম সময়ই দেখেছি। আমার ভাস্কর হয়ে ওঠার পেছনে হামিদের অশেষ অনুপ্রেরণা রয়েছে। তাঁর কথা যেমন আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি উৎসাহিত করেছে কাজের প্রতি ওঁর অদম্য স্পৃহা।
বিবাহিত জীবনের শুরুতে আমরা রায়েরবাজারে থাকতাম। সেখান থেকে চারুকলায় আসা-যাওয়া। পরে আমরা কিছুকাল পল্টনে ছিলাম। আশির দশকের শুরুতে আমিনুল ইসলাম স্যারের ভূমিকায় হামিদুজ্জামান খান চারুকলার মেয়েদের হলের হল কিপার হয়ে এলেন। সরকারি চাকরি, বেতন কম। বেতন কম হলেও তখন টাকার মূল্য ছিল। হামিদ হল কিপার হওয়ায় আমাদের বেশ সুবিধা হয়েছিল। এমনিতেই তিনি অনেকটা সময় কাজ করতেন ডিপার্টমেন্টে। এরপর বাড়ি ফিরতেন। তখন কাজের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। বঙ্গভবনের কাজটা করলেন তখন– ‘পাখি পরিবার’। সিলেটে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে তৈরি করলেন ‘হামলা’। তখন বড় বড় কাজ শুরু তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় বড় কাজগুলো কিছু সুবিধাও পাইয়ে দিয়েছিল।
বিরাশি বা তিরাশি সালে ওঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। ততদিনে চারুকলা থেকে পাস করে আমি উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। দেশের বাইরে আরও উৎকৃষ্ট শিল্পী ও শিল্পকলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। কাজে আরও উৎকর্ষ যুক্ত হয়। ক্রমশ আন্তর্জাতিক বলয়ে কাজ বাড়তে থাকে। ১৯৮৮ সালে কোরিয়া অলিম্পিকে তাঁর শিল্পকর্ম উপস্থাপিত হলো। ভাস্কর্যের নাম ‘দ্য স্টেপস’। স্টেপস দক্ষিণ কোরিয়াতেই স্থান করে নিয়েছে।
এর কিছুকালের ভেতর আমি শান্তিনিকেতনে পড়তে গেলাম যখন, সেখানেও হামিদের সুখ্যাতি উপভোগ করেছি। সবাই বলত, হামিদ বাংলাদেশের হেনরি মুর। শুনে ভালো লাগত। সালটা সম্ভবত ১৯৮৮। হামিদুজ্জামান তখন বরদায় মাস্টার্স করছেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশে ভাস্কর্যে হামিদুজ্জামান খান প্রধান। দৃশ্যচিত্রেও তিনি প্রথম দিকেই থাকবেন। দেশের বাইরে গিয়ে আমার পক্ষে যখন তুলনামূলক শিল্পমান যাচাই করা সম্ভব হয়েছে, তখন লক্ষ্য করেছি হামিদুজ্জামানের কাজ উৎকৃষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প ভেতর থেকে আসতে হয়। তাঁর করা ভাস্কর্য ও দৃশ্যচিত্রগুলো মনের ভেতর থেকে আসা। সেখানে বাস্তব শারীরিক অবয়ব বা হুবহু বাস্তবের অনুগামী দৃশ্য নেই। ওটা হামিদুজ্জামানের একেবারে নিজস্ব। মনের ভেতর একটা মূল অবয়ব থাকে। কিন্তু কাজে সেই অবয়বকে ছাপিয়ে, কিছু চিহ্ন ও প্রতীকসহ তাঁর নিজের দেওয়া অবয়বটাই ফুটে। হামিদুজ্জামানের আঁকা পোর্ট্রেটকে ঘিরেও এ কথা বলা যায়। আমি মনে করি, যা আছে তা হুবহু ফুটিয়ে তোলা শিল্প নয়। সেটা অনুলিপি।
১৯৮৮ সালে হামিদুজ্জামান যখন বরোদায় মাস্টার্স করছিলেন, তখন দিল্লিতে এক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নেন। সেখানে মকবুল ফিদা হুসেন ওর শিল্পকর্ম দেখে আগ্রহী হয়ে দীর্ঘ সময় হামিদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ওই তরুণ বয়সে সেটা আমার ও আমাদের জন্য প্রেরণার এক প্রোজ্জ্বল মুহূর্ত ছিল, এখনও মনে পড়ে।
পরিশেষে
আমি যখন শান্তিনিকেতনে ছিলাম, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে, হামিদুজ্জামান যথারীতি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তখন আজকের মতো হ্যান্ডফোনের প্রচলন ছিল না। একমাত্র চিঠিতে আমাদের যোগাযোগ হতো। দেড় থেকে দুই মাস ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। থাকতাম সীমান্ত পল্লিতে বাড়ি ভাড়া করে। পাশেই এক বাড়িতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্রী ছিল। ওরা সংগীত ভবন ও বিদ্যাভবনে পড়ত । অধ্যাপক শর্বরী রায় চৌধুরী, অজিত বাবু, বিপিন দাস আমার শিক্ষক ছিলেন। তারা ভারতসহ সারাবিশ্বে বেশ খ্যাতিমান ভাস্কর ছিলেন। তাদের মাঝে, কাজকর্মে সময় আমারও ভালোই কাটত। কিন্তু তাঁর চিঠির অপেক্ষাতেও থাকতাম। হঠাৎ এক দুপুরে পিয়ন চিঠি নিয়ে এলো। খামটি বেশ ভারী। খুলে দেখি একসঙ্গে প্রায় ২০-২৫টি চিঠি। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে লিখে রাখতেন। এক-দেড় মাস পর একসঙ্গে পোস্ট করেছেন। প্রায়ই এমন করতেন। তখন রাগ হলো ওঁর ওপর। কিন্তু এখন মনে হয়, এই পাগলামোগুলোই তো বলার মতো গল্প হয়ে হৃদয়ে জমা থাকে।
এ বছরের ১৬ মার্চ হামিদুজ্জামান খান আশি বছরে পা রেখেছেন। আমি ওঁর দীর্ঘতম কর্ম ও ভালোবাসাময় জীবন কামনা করি।
লেখক: ভাস্কর ও হামিদুজ্জামান খানের সহধর্মিণী