তরুণদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগ
Published: 26th, March 2025 GMT
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মানিকগঞ্জের তরা ঘাটে মানুষের হাতে লোহার পেরেক গুঁজে, পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিন পর এক ফল বিক্রেতা কলার সঙ্গে বিষ খাইয়ে পাকিস্তানি সেনাকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। দুটি ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মো. মাইন উদ্দিন; কিন্তু কোনো দিন তাঁর কাছে কেউ জানতে চাননি এসব কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ঘটনাগুলোর এমন স্মৃতিই তুলে আনতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাঁরা সংগ্রহ করেছে ৫৫ হাজারের বেশি এমন সব স্মৃতিভাষ্য। তৃতীয় প্রজন্মের কলমে উঠে আসা এই ঘটনার ক্রমিক নম্বর ৪৪ হাজার ৯০২।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে প্রতিষ্ঠানের আছে বছরব্যাপী সাতটির বেশি ধারাবাহিক উদ্যোগ। গত দুই যুগে এই প্রতিষ্ঠান দেশের ১৫ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে।
গল্প তুলে আনেন শিক্ষার্থীরা
‘ছাত্র-ছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য’ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ১২ খণ্ডে প্রায় দুই হাজারের বেশি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থের সহযোগী সম্পাদক সত্যজিৎ রায় মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানের সামনে বাবাকে দুই ভাগ করা, নিজের শরীরের মাংস কেটে খেতে বাধ্য করা, জীবিত মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া; এমন সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিকের গল্প তুলে এনেছেন এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। এটি বিশাল আর্কাইভ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সবচেয়ে সফল দুটি কর্মসূচি হচ্ছে ‘আউটরিচ’এবং ‘রিচ আউট’ কর্মসূচি। আউটরিচ কর্মসূচি হলো ঢাকা শহর ও এর আশপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। রিচ আউট কর্মসূচি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিদর্শন করানো। এই দুই মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি নিয়ে ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভবত পৃথিবীর সবচাইতে বেশি মৌখিক গল্পের সংগ্রহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। এত সংগ্রহ হলোকাস্ট মিউজিয়ামেরও নেই বলে মনে হয়।
জাদুঘর পরিদর্শন
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে বানানো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আছে ১৫ হাজারের বেশি স্মারক। চারটি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী এই স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীসহ দুর্লভ সব আলোকচিত্র,দলিল ও চিঠিপত্র। জাদুঘর নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে। শিক্ষার্থীরা এখানে ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র দেখেন। এই কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে।
আউটরিচ কর্মসূচির নেটওয়ার্কের শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে এসে শিক্ষার্থীরা যাঁরা আসতে পারেন না, তাঁদের কাছে গিয়ে গল্পগুলো বলেন। একজনের অভিজ্ঞতা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।
গত বছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারি পরিদর্শন করেছেন ষাট হাজারের বেশি মানুষ।
ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর
প্রতিষ্ঠানের দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের প্রতিটি জেলায় গিয়ে এক মাস করে থাকে। এ সময়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো দেখে। ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের সঙ্গে থাকেন একজন শিক্ষক। যিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এখন পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে এ কার্যক্রম।
এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দুটি এরই মধ্যে সারা বাংলাদেশের সব জেলায় একবার করে ভ্রমণ করেছে। তরুণদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক তৈরি করতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আছে পাঠ কর্মসূচিও।
‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ’
তিন মাসব্যাপী বই পাঠের এই উদ্যোগের সূচনা হয় ২০২৩ সালে। একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি প্রয়াত আলী যাকেরের স্মৃতি রক্ষায় জাদুঘর ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ’ গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বই পড়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন ঢাকা মহানগরের ১০টি এবং সারা দেশের ৪৬টি পাঠাগারের শিক্ষার্থী, সদস্যরা। তাঁদের কাছ থেকে ৫৪৮টি প্রতিক্রিয়া জমা হয় গত বছর।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস (সিএসজিজে)। সিএসজিজে গণহত্যা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা–সংক্রান্ত জাতীয়–আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এবং গবেষণা কেন্দ্র। আছে জাদুঘরের ফিল্ম সেন্টার।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংযুক্তি ঘটিয়ে দেওয়াই জাদুঘরের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
রাজধানীর সেগুনবাগিচার পুরোনো একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সেগুনবাগিচার পুরোনো বাড়ি থেকে জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়ে আগারগাঁওয়ে যায় ২০১৭ সালে। শুরু থেকে মানুষের ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তার কথা জানিয়েছেন জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, ‘যে শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিষে হত্যা করা হয়েছিল, তার কাছেও দায় আছে আমাদের।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ জ দ ঘর র র ম ক ত য দ ধ জ দ ঘর প রথম আল ক ব যবস থ প রজন ম
এছাড়াও পড়ুন:
পঞ্চগড়ে ১ হাজার শয্যার হাসপাতালের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন
চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত এক হাজার শয্যার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পঞ্চগড়ে স্থাপনের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন করেছে জেলার বাসিন্দারা। পঞ্চগড় জেলা সমিতির আয়োজনে শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ঢাকায় অবস্থানরত জেলাটির কয়েক শতাধিক বাসিন্দা মানববন্ধনে অংশ নেন।
এতে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- পঞ্চগড় জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ ড. আব্দুর রহমান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, সমিতির সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আইনুল হক পিইঞ্জ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম, আনজারুল হক, মুক্তার আলম, মাখদুম মাসুম মাশরাফি যুক্তি, মাসুদ, সরোয়ারসহ জেলা সমিতির অন্যান্য নেতারা।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চগড় জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা
মানববন্ধনে অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ঢাকা থেকে সবচেয়ে দূরের জেলা পঞ্চগড়। এই কারণে সম্ভবত পঞ্চগড়ের মানুষের আর্তনাদ আপনাদের কানে পৌঁছায় না। আপনারা ঢাকায় বসে অনুভব করতে পারবেন না, পঞ্চগড়ের ১২ লাখ মানুষের জন্য শুধু প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এর পরের চিকিৎসার জন্য পারি দিতে হয় রংপুর অথবা দিনাজপুর। পথেই অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
তারা আরও বলেন, আমরা পঞ্চগড়ের মানুষ রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সে আর মৃত্যুবরণ করতে চাই না, চিকিৎসা নিয়ে নিজ মাটি পঞ্চগড়ে মৃত্যুবরণ করতে চাই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পঞ্চগড়ের অনেক এমপি, মন্ত্রী, স্পিকার দেখেছি, অনেক সরকার বাহাদুর দেখেছি। একটা উন্নত হাসপাতাল দেখি নাই। তাই ৫ আগস্ট এর পরের বৈষম্যহীন বাংলাদেশে বৈষম্যহীন সিদ্ধান্ত নিন, চীনা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল পঞ্চগড়ে স্থাপন করুন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, দেশের উত্তর জনপদের সম্ভাবনাময় জেলা পঞ্চগড়। সমতল ভূমিতে বিস্তৃর্ণ চা-বাগান, পাথর-নদীতে সমৃদ্ধ জেলাটির ভৌগলিক অবস্থান পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা (স্থলবন্দর) থেকে নেপালের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার, ভুটানের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটার, চীনের দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার, শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। অন্যদিকে হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পঞ্চগড়ে হলে ভুটান, নেপাল ও চীনের ছাত্রছাত্রীরা এখানে পড়াশোনা করতে আসবেন। চিকিৎসাসেবা নিতে আসবেন। পঞ্চগড়ের মানুষও বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা পাবেন।
দাবি না মানলে বড় আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন বক্তরা।