সন্জীদা খাতুন আছেন আমাদের সঙ্গে
Published: 26th, March 2025 GMT
সন্জীদা খাতুন নেই। সন্জীদা আপার কথা ভাবতে বসে সেই ষাটের দশকের অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছে।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় যে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটেছিল, সেটাই পরে ষাটের দশকজুড়ে বহু বিস্তৃত হয়ে দেশে অবিশ্বাস্য এক গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এর পেছনে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল বিরাট। সে সময়ের প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোও যৌথভাবে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এর সবকিছুই শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের এক ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে সব প্রস্তুতিতে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিল।
এসব আন্দোলনের পাশাপাশি বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও সংস্কৃতির জন্য সংগ্রামও অব্যাহত ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সে সময় একাধিক কমিটি করে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।
এর পরপরই সংগঠক ও শিল্পীরা সবাই মিলে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন আনন্দ-উত্সব করতে। সেখানেই বিকেলের আসরে মোখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া) প্রস্তাব করলেন, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই একমত হলে নতুন সংগঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। সুফিয়া কামাল সভাপতি ও ফরিদা হাসান সাধারণ সম্পাদক। কমিটিতে আরও ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সায়েদুল হাসান, শামসুন্নাহার রহমান, ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক প্রমুখ। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্জীদা খাতুনের নামটি প্রস্তাব করা হলেও তিনি কমিটিতে থাকেননি। তিনি তখন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। নবগঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক হয়েছিল—ছায়ানট।
সন্জীদা খাতুন আজীবন ছিলেন যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই পড়াশোনা, আবৃত্তি ও অভিনয়ের পাশাপাশি গানের চর্চা করেছেন। পাশাপাশি কিছু সাংগঠনিক কাজেও যুক্ত হয়েছেন।
শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মুকুল ফৌজে কাজ করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। তাঁর প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতি। পরে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত শিল্পী হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনসহ আরও অনেকের কাছে শিখেছেন রবীন্দ্রসংগীত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, অনার্সের পর শান্তিনিকেতনে যাবেন, বিশ্বভারতীতে এমএ পড়বেন। হয়েছিল তা-ই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সন্জীদা খাতুন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে বাসায় ফিরে ছাত্রহত্যার খবর পেয়েছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সবকিছু বন্ধ, সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নানা খোঁজখবর নিয়ে বিকেলে মাকে নিয়ে রওনা দিলেন অভয় দাশ লেনের এক বাসার উদ্দেশে নারীদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে। সেই ভয়াল পরিবেশে দূরপথ হেঁটে গেলেন সে বাসার চত্বরে। সেখানে গিয়ে দেখেন বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ উপস্থিত। কিন্তু সেদিন সে পরিস্থিতিতে কেউ সভার সভাপতি হতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সন্জীদা আপার মা সাজেদা খাতুনকে সভাপতির আসনে বসিয়ে দেওয়া হলো। মা গুটিসুটি হয়ে বসে থাকলেন। অন্যরা বক্তৃতা করলেন।
সেদিন সন্জীদা খাতুন প্রথম বক্তৃতা করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’
সংস্কৃতিই তাঁর সংগ্রামক্ষেত্রসন্জীদা খাতুনের সঙ্গে পরিচয় বা যোগাযোগের প্রথম স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে আমরা সে সময় ছায়ানটের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই যেতাম। সেসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সন্জীদা আপার সঙ্গে পরিচয় ও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
নানা কাজের সূত্রে সে সময়ের কিছু বামপন্থী নেতা–কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সন্জীদা খাতুনের। স্বল্প সময়ের জন্য কারও কারও গোপন আস্তানা ছিল তাঁর বাসা। সেই পঞ্চাশের দশকের কোনো এক সময় আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জি তাঁদের বাসায় থেকেছেন। সে সময়ের আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খোকা রায়ের স্ত্রী যুঁইফুল রায়—কখনো আয়েশা বা কখনো রাবেয়া পরিচয় ছিল—তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। একদিন তিনি এসে পল্টন ময়দানে শুধু নারীদের নিয়ে সভা করার জন্য সন্জীদা আপাকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন। ইতিমধ্যে বিএ অনার্স পাস করে সন্জীদা আপা শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন স্থির করে ফেলেছেন। এ সময় যুঁইফুল রায় এসে সন্জীদা আপাকে বললেন, ‘ওখানে গিয়ে কী করবে? পার্টির সদস্যপদ নাও। এখানেই কাজ করো।’
সন্জীদা আপা এ কথা শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘সেটা আমি পারব না।’ আরও বললেন, তিনি গান ছাড়তে পারবেন না। নিজের বিচার-বিবেচনা বাদ দিয়ে পার্টির নির্দেশ মেনে চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। পরে সন্জীদা আপা তাঁর আত্মজীবনী সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দেতে লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’ তিনি সেই নিজস্ব কাজের ধারা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
ছায়ানট শুধু নয়, তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় বা কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সন্জীদা আপা। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের বাংলাদেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনে ছিলেন তিনি।
যাত্রা শুরুর দিনসেদিন সকালের কথা কোনো দিন ভুলিনি। দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল, বাংলা সনের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। ছায়ানট রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছিল নববর্ষের অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেশ উত্সাহ তৈরি হয়েছিল। আমরা ৩১/১ হোসেনি দালান রোডের কার্যালয়ে সারা রাত জেগে ও আশপাশ থেকে কিছু ফুল, কিছু গাছের পাতা-ডালসহ কিছু বেলুন নিয়ে এক–দেড় শ ছাত্র মিছিল করে ছায়ানটের প্রথম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলাম। সামনে ছিল ব্যানার—‘এসো হে বৈশাখ/ এসো এসো’। দর্শক-শ্রোতারা হাততালি দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত করেছিলেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ছায়ানট বিদ্যায়তনে (ফুলার রোডের উদয়ন স্কুলে) নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছে নিয়মিত। প্রথমবারের সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছায়ানট বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর (১৯৬৭ সাল থেকে) শুধু একাত্তর সাল বাদ দিয়ে রমনার বটমূলে নববর্ষের বড় অনুষ্ঠান সফলভাবে করে চলেছে ছায়ানট। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ২০০১ সালে নববর্ষের প্রভাতের এই অনুষ্ঠানে বড় রকমের বোমা হামলা হলেও ছায়ানট বা সন্জীদা খাতুন এই অনুষ্ঠান থেকে সরে আসেননি; বরং আরও ভালোবেসে আমৃত্যু এই অনুষ্ঠান করে গেছেন। এই বিশাল সফলতার সামনে প্রথমে আছেন সন্জীদা খাতুন, যিনি অক্লান্ত এই মহৎ উদ্যোগে সর্বদা সক্রিয় থেকেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেদিন সন্জীদা খাতুন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ না করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে এ কথাও সত্য, ষাটের দশকজুড়ে ছায়ানট বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজে সে সময় বামপন্থী ছাত্র, বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক কর্মীদের তিনি তাঁর পাশে পেয়েছেন। তিনিও তাঁদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর বই, গান এবং সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধারাকে প্রভাবিত করেছে, শক্তিশালী করেছে। সে জন্য বাংলাদেশ সব সময় কৃতজ্ঞ থাকবে সন্জীদা খাতুনের কাছে।
সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীকষাটের দশকজুড়েই আমরা বাম ধারার ছাত্ররাজনীতি ও সংস্কৃতি সংসদের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। সন্জীদা খাতুন আর ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে যে আমাদের আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যোগাযোগ আছে, তা আমাদের জানা ছিল। সে জন্য ছায়ানটের নানা কার্যক্রম এবং এই সংগঠনের প্রতি আকর্ষণ ও সমর্থনও সহজাত ছিল। আসলে সেই দিনগুলোতে ছায়ানট বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
মনে পড়ে, সন্জীদা আপার আজিমপুরের ফ্ল্যাটে কত কাজে গিয়েছি। আমাদের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গোপন বৈঠকও হয়েছে সে বাসায়। সেই দিনগুলোতে সন্জীদা খাতুনকে আমরা মিনু আপা বলতাম।
ছায়ানট একটি অব্যাহত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চর্চারও একটি কেন্দ্র। ছায়ানট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে, দেশের মানুষকে সঞ্জীবিত করে এসেছে। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবিক বাংলাদেশ গঠনের কাজে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছে।
৯১ বছর ধরে সন্জীদা খাতুন বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণের কাজ করে গেছেন—এককভাবে, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। কথায়, গানে, লেখায়, সংগঠনে, আয়োজনে ও আন্দোলনে তিনি আমাদের সামনে ছিলেন সারাক্ষণ।
তিনি শারীরিকভাবে নেই; কিন্তু তিনি থেকে গেছেন আমাদের সঙ্গে, থাকবেন সব সময়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই অন ষ ঠ ন নববর ষ র আম দ র স স গঠন র র রহম ন র প রথম হয় ছ ল প রস ত র জন ত কর ছ ল ক জ কর সময় র
এছাড়াও পড়ুন:
‘মেয়েকে প্রথম বুকে নিয়ে কথা বলতে পারিনি কিছুক্ষণ’
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। চারপাশে উৎসবের রঙে রাঙানো, বৈশাখী আমেজে মাতোয়ারা জনজীবন। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে একদিকে নওগাঁয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি, ঘোড়া, পালকি, মাটির তৈরি বাসনসহ বিভিন্ন বর্ণের বেলুন ফেষ্টুন উড়িয়ে, মাথাল মাথায় দিয়ে যখন হাজারো মানুষ উল্লাস করছে। অন্যদিকে সামান্য অদূরেই ২৫০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালে সকাল ৮.৫০মিনিটে রকিবুল হাসান (২৪) ও খাদিজা আক্তার(১৯) দম্পতির কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় রিজুয়ানা হাসান। জীবনে প্রথমবার বাবা-মা হওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত রকিবুল-খাদিজা দম্পতি।
রকিবুলের বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দনগর ইউনিয়নের বেনীপুর গ্রামে। পেশায় সফটওয়ার ডেভলপার। কোরআনের হাফেজা খাদিজা আক্তারের বাড়ি জেলার মহাদেবপুর উপজেলার সুরান্দপুর গ্রামে। ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের দেড় বছর পরে রিজুয়ানা হাসানের জন্ম। এটি তাদের প্রথম সন্তান।
সদ্যজাত কন্যাকে নার্সের কাছ থেকে কোলে তুলে নেন বাবা রকিবুল হাসান। এসময় আপ্লুত হয়ে পড়েন রকিবুল। কোলে নিয়েই শিশুর কানে আজান দিতে থাকেন। পাশেই শিশুটির নানি শেফালী বেগম ও দাদি রহিমা বিবি আনন্দে অশ্রুপাত করেন।
বৈশাখের প্রথম দিনে সন্তান জন্মগ্রহণ করায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রকিবুল হাসান এবং খাদিজা আক্তার। রকিবুল বলেন, বৈশাখের প্রথম দিনে আমি প্রথম কন্যার সন্তানের জনক হয়েছি এতে আমি ভীষণ খুশি। সন্তান জন্মের পর পরই আমি কোলে নিয়েছি এ এক অন্যরকম অনুভূতি যা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি নিজেই আমার মেয়ের কানে আজান দিয়েছি। বাসায় গিয়ে সবার আগে মেয়ের নামে আকিকা দিয়ে আমার সন্তানের নাম রাখা হবে রিজুয়ানা হাসান। আমার নামের শেষ অংশ হাসান যুক্ত করে আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে এই নাম রেখেছি। মেয়েটিকে মাদরাসায় পড়াশোনা করাবো। আলেম বা হাফেজা বানাবো। আমার এ সন্তানের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
তিনি বলেন, স্ত্রীকে ৭মাসের সাতোসা খাওয়ানোর মতো কুসংস্কার এবং বাসায় রেখে ডেলিভারীতে বাধ্য করানোর মতো কুসংস্কারে আমি বিশ্বাসী নই। আমরা এযুগের আধুনিক চিন্তার মানুষ। তাই কোন কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনা। আমার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে মহাদেবপুর সদরের কাজীর মাস্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডা. কামরুন্নাহারের কাছে নিয়মিত চেকআপ করিয়েছি। তার পরামর্শেই স্ত্রীকে আমার কাছে নওগাঁ শহরের বাসায় রেখেছিলাম।
নওগাঁ ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা ফারুক তন্দ্রা বলেন, এটি নরমাল ডেলিভারি। জন্মের সময় সন্তানের ওজন তিন কেজি হয়।
তিনি বলেন, সন্তান জন্মের ২দিন আগে থেকে সন্তানের মা ব্যাথা অনুভব করায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। শেষের দিকে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছিল। পরিস্থিতি ক্রমশ ঝুঁকির দিকে গিয়েছিল। সিজারের সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য নরমালেই হয়েছে।
এখন সন্তান এবং মা দু’জনেই সুস্থ আছেন ভালো আছেন বলে জানান তিনি।
সন্তানের মা খাদিজা আক্তার বলেন, পহেলা বৈশাখে যে তার সন্তান ভূমিষ্ট হবে-এমনটা আগেই জানা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পেইন এবং পানিশূন্যতার জন্য মনে হয়েছে হয়তো দু’একদিন আগেই হবে। এক পর্যায়ে ব্যথা সহ্য সীমার বাইরে চলে যায়। বাধ্য হয়ে দু’দিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হই। বাকিটা আলহামদুলিল্লাহ। প্রথম ওকে যখন আমার বুকের ওপর রাখা হয় তখন আমি অনুভূতিহীন হয়ে পড়ি। কথা বলতে পারিনি কিছুক্ষণ।
তিনি বলেন, রকিবুলের নীল রঙ খুব পছন্দের। তাই আমার অধিকাংশ কাপড় নীল রঙের। আমাদের মেয়ে জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই রকিবুল মেয়ের জন্য এক জোড়া নীল রংয়ের জামা কিনে এনেছে। তিনি হাসতে হাসতে বলেন জামা দুটিই মেয়ের বড় হয়েছে।
রকিবুলের বাবা আব্দুল মোত্তালেব জানান, গর্ভবর্তী হওয়ার পর থেকেই স্ত্রীর প্রতি ছিল রকিবুলের বিশেষ যত্ম। ভারী কাজ করতে দিতো না। ডাক্তারি চেকআপ করাতো নিয়মিত। গ্রামের বাড়ি নিয়ামতপুর থেকে তার বৌমাকে ছেলে নওগাঁ শহরে নিজের কাছেই রেখেছে।
শিশুর নানী শেফালী বেগম বলেন, চিকিৎসক আর নার্সের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শরীরের রক্ত পরিষ্কার করে টাওয়াল দিয়ে জড়িয়ে দেন নার্স। পরে ওর বাবার কোলে দেওয়া হয়। এরপর আমি কোলে নেই। এ সময় ডাক্তার ও নার্সরা শিশুটিকে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানায়।
শিশুর দাদী রহিমা বিবি বলেন বলেন, আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া। আমার ছেলের ঘরে সিজার ছাড়াই আল্লাহ একটি কন্যা দিয়েছে। সেটাও আবার পয়লা বৈশাখের দিন। তারিখটা মনে রাখার মতো।
নওগাঁ ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আবু জার গাফ্ফার বলেন, পহেলা বৈশাখে প্রথম সন্তান রকিবুল-খাদিজা দম্পতির। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বাব-মা ও মেয়েকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। এ দিন আরো কয়েকজন শিশুর জন্ম হয়েছে। প্রত্যেককেই আমরা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছি।