দিনে ব্যাংকে চাকরি, রাতে ইজিবাইক চালান খসরু
Published: 26th, March 2025 GMT
একটি বেসরকারি ব্যাংকের পিয়ন হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি। দিনের বেলা সেখানে চাকরি করেন। সন্ধ্যার পর থেকে করেন আরেকটি খণ্ডকালীন চাকরি। ওই চাকরিতে একটি ক্লাবে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। সেখানে থাকতে হয় রাত প্রায় ১১টা-১২টা পর্যন্ত। এরপরও ঘরে ফেরেন না। আরও প্রায় ২-৩ ঘণ্টা ইজিবাইক চালিয়ে রোজগার করেন যুবক আমির খসরু চৌধুরী (৩২)।
খসরুর বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার বাহুলী গ্রামে। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে পটিয়া পৌর সদরের ব্যস্ত সড়কে যাত্রীর জন্য ইজিবাইক নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় আমির খসরুকে। এ সময় তাঁর সঙ্গে গিয়ে কথা হয়। আলাপে নিজের জীবনযুদ্ধের কথা তুলে ধরেন খসরু।
পরে তাঁর কথার সূত্র ধরে গত রোববার রাতে যাওয়া হয় উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পটিয়া ক্লাবে। সেখানে একটি কম্পিউটারে ক্লাবের হিসাব-নিকাশ করতে দেখা যায় আমির খসরুকে। দুই দফা খসরুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর বাবার নাম শওকত আলী চৌধুরী। বাবা ২০০৪ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চাকরি করেছেন। পরে দেশে এসে জমি কেনাবেচায় সহায়তা করতেন। ২০০৯ সালে তিনি নানা ধরনের অসুস্থতায় কর্মহীন হয়ে পড়েন। এর পর থেকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল।
পরিবারের খরচ চালানো একসময় আর সম্ভব হচ্ছিল না। এমনই দুঃসময়ে উপার্জনে নামতে হয় আমির খসরুকে। তখন খসরু একটি কলেজের স্নাতকের ছাত্র। ২০১৫ সালে পটিয়া ক্লাবের খণ্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেন তিনি। পটিয়া ক্লাব থেকে শুরুতে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা পেতেন, যদিও এখন বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার টাকা।
চাকরির কারণে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম নগরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে পিয়ন পদে যোগদান করেন খসরু। সেখান থেকে বর্তমানে মাসে ২৪ হাজার টাকা করে পান। তবে পটিয়া থেকে নগরের অফিসে যাতায়াত, দুপুরের খাবারে প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। বাকি টাকা সংসারে খরচ করেন তিনি।
আমির খসরু চৌধুরী জানান, ২০১৭ সালে তিনি বিয়ে করেছেন। তাঁর দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ভাইদের মধ্যে একজন আড়াই বছর ধরে পটিয়া সদরের একটি জুতার দোকানে চাকরি করেন। একজন বিয়ে করে আলাদাভাবে থাকেন। অপর দুই ভাই এইচএসসিতে পড়েন, যাঁদের পড়ালেখার খরচও চালাতে হয় খসরুকে।
খসরু বলেন, ২০২২ সালে তাঁর বাবার পিত্তথলির অস্ত্রোপচার হয়। তবে আবারও সমস্যা দেখা দেওয়ায় সম্প্রতি চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন আবারও অস্ত্রোপচার করতে হবে। একদিকে পরিবারের খরচ, অন্যদিকে বাবার নিয়মিত চিকিৎসা ব্যয়, সব মিলিয়ে বাড়তি উপার্জনের জন্য দুই মাস আগে ইজিবাইক কেনেন। এ জন্য একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১ হাজার টাকা করে।
খসরু বলেন, প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমান। বাকি সময়টা উপার্জনের পেছনে ব্যয় করেন। ঘুম কম হওয়ায় অনেক সময় খারাপ লাগে তাঁর। তবু বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু করতে পারছেন, এতেই শান্তি।
পটিয়া ক্লাবে আমির খসরুর বিষয়ে কথা হয় ক্লাবের অ্যাডহক কমিটির সদস্যসচিব মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমির খসরু সুনামের সঙ্গেই দীর্ঘদিন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ প্রশংসার দাবিদার। তবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে কাজের পেছনে এত বেশি সময় দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র র ন খসর খসর ক
এছাড়াও পড়ুন:
প্ল্যাটফর্মে একা
তখন আমি বোর্ডিং স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সেদিন আম্বালা স্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি উত্তরমুখী ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। মনে হয়, আমার তখন বয়েস বারো বছর হবে। বাবা-মা ভাবতেন, একা একা ট্রেনে ক’রে চলার মতো যথেষ্ট বয়েস আমার হয়েছে। সেদিন আমি বাসে ক’রে সন্ধ্যের বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আম্বালা স্টেশনে। আমার ট্রেন আসার অনেক দেরি। তা প্রায় রাত বারোটা বাজবে। আমি আর কোনো কাজ না পেয়ে প্ল্যাটফর্মের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত পায়চারি করছিলাম, মাঝে মাঝে বইয়ের স্টলে গিয়ে বই ঘাঁটছিলাম আর বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে ভাঙা বিস্কুটের টুকরো খাওয়াচ্ছিলাম। এক এক করে ট্রেন আসছিল, যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ প্ল্যাটফর্মটা থাকছিল নীরব, তারপর যখন আর একটি ট্রেন আসছিল, অমনি মানুষের হৈ হল্লা, চেচামেচি আর মানুষের ব্যস্ততায় জমজমাট হয়ে উঠছিল জায়গাটা। গাড়ির দরজা খোলা মাত্র সেখান থেকে নেমে আসছিল একটা মানুষের স্রোত আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল গেটে দাঁড়ানো হাঁপিয়ে ওঠা বেচারা টিকিট কালেক্টরের ওপর। প্রতিবার এমনটি ঘটার সাথে সাথে আমিও মানুষের স্রোতের সাথে মিলেমিশে একেবার বেরিয়ে আসছিলাম স্টেশনের বাইরে। শেষমেশ এমনটি করতে করতে হাঁফিয়ে উঠলাম আমি। না পেরে শেষে এসে বসে পড়লাম প্ল্যাটফর্মে রাখা আমার স্যুটকেসটার ওপর। সেখানে বসে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তাকিয়ে থাকলাম রেললাইনের ওপাশের দিকে।
এক একটা ট্রলি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই আমি মন দিয়ে শুনছিলাম প্রত্যেক বিক্রেতার হাঁকডাক। একজন বেচছিল দই আর লেবু, অন্য একজন মিষ্টি বিক্রেতা, একজন খবরের কাগজের হকার– কিন্তু আমি কিছুতেই সেই হাঁকডাক আর ব্যস্ততায় মনোসংযোগ করতে পারছিলাম না। রেললাইনের ওপাশেই আমি চেয়েছিলাম একদৃষ্টে। এইসব একঘেয়েমির মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল।
আমার পেছন থেকে কোমল সুরে একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘খোকা, তুমি কি একা একাই যাচ্ছ?’
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, একজন ভদ্রমহিলা। তিনি আমার পেছন থেকে ঝুঁকে আমাকে দেখছিলেন। তার মুখটা বিবর্ণ, চোখ দু’টো মমতা মাখানো। তার গায়ে কোনো অলংকার ছিল না, পরনে অতি সাদাসিধে একটা সাদা শাড়ি।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি স্কুলে যাচ্ছি।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট সম্মানের সাথেই বললাম কথা কয়টা। দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি বেশ দরিদ্র। কিন্তু তার সমস্ত অবয়বে ছিল একটা সম্ভ্রমের প্রলেপ, যা দেখে তাকে সম্মান না করে পারা যায় না।
তিনি বললেন, ‘আমি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তোমাকে লক্ষ্য করছি। তোমার মা-বাবা কেউ তোমাকে বিদায় জানাতে আসেন নি?’ আমি বললাম, ‘আমি এখানে থাকি না। ট্রেন পাল্টে তবে আমি এখানে এসেছি। তারপরও, আমি একা একাই চলাফেরা করতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই তুমি তা পার।’ তার এ কথাটা আমার ভালোই লাগল, আরও ভালো লাগল তার ওই সহজ সরল পোশাক আর তার নরম, কোমল কণ্ঠস্বর, তার বিষণ্ন মলিন মুখ।
উনি বললেন, ‘তোমার নাম কি?’
আমি বললাম ‘অরুণ’।
‘কতক্ষণ তোমাকে তোমার ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে?’
‘আমার মনে হয়, প্রায় এক ঘণ্টা। গাড়িটার এখানে আসার সঠিক সময় রাত বারোটা।’
‘তাহলে তুমি আমার সাথে এসো, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।’
আমি চেয়েছিলাম না বলতে। একটু লজ্জা করছিল, আবার মনে মনে একটু সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু উনি আমার হাত ধরে টান দিলেন। তখন আমার মনে হলো আর প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না। উনি একজন কুলিকে বললেন আমার স্যুটকেসটা একটু দেখে রাখতে। তারপর তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে চললেন প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে। নরম ছিল তার হাতটা, আমার হাতটাকে ধরে ছিলেন আলগা করেও না আবার শক্ত করেও নয়। আমি আবার মাথা উঁচু করে তাকালাম তার মুখের দিকে। তিনি মোটেও তরুণী নন এবং মোটেও বৃদ্ধ নন। তার বয়েস অবশ্যই ত্রিশের বেশি, পঞ্চাশও হতে পারে, তবে আমার মনে হয়, বয়েস তার ওপর ছাপ ফেলতে পারেনি।
তিনি আমাকে নিয়ে ঢুকলেন স্টেশনের ডাইনিং রুমে, সেখানে চা, শিঙাড়া আর জিলিপি অর্ডার দিলেন। আমি তখনই মনোযোগ দিয়ে সেই মমতাময়ী মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। এই অদ্ভুত যোগাযোগটা আমার ক্ষুদপিপাসার ওপর প্রভাব ফেলেছিল সামান্যই। আমি ছিলাম একজন ক্ষুধার্ত স্কুলের ছাত্র, আর মোটামুটি ভদ্রভাবে প্রাণপণে যতটা সম্ভব গলধঃকরণ করে ফেললাম। স্পষ্টভাবে দেখলাম তিনি আমার খাওয়া দেখে যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করছেন। আর আমার মনে হয় কি, ওই খাবারগুলোই আমাদের দু’জনের মধ্যকার বন্ধন আরো দৃঢ় করে তুলেছিল, আমাদের দু’জনের নৈকট্যকে করেছিল আরো সংহত। চা আর মিষ্টিই আমকে করে তুলেছিল আরো সহজ এবং স্বচ্ছন্দ। আমি তাকে বলতে লাগলাম আমার স্কুলের নাম, আমার বন্ধুদের গল্প, আমার ভালোলাগা মন্দলাগার কথা। তিনি মাঝে মাঝেই নানা ব্যাপারে প্রশ্ন করছিলেন আমাকে, কিন্তু তার শোনার ব্যাপারেই আগ্রহ ছিল বেশি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমি আমার ব্যাপারে সবকিছুই তুলে ধরলাম তার সামনে, আমরা তখন আর দু’জন দু’জনের মোটেও সদ্যপরিচিত নই। কিন্তু তিনি কখনও আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করলেন না বা কোথায় আমি থাকি সে কথাও জানতে চাইলেন না। আমিও তার কাছে জানতে চাইলাম না, তিনি কোথায় থাকেন। আমি, যেমন তিনি, তেমনভাবেই তাকে গ্রহণ করেছিলাম– একজন মিতবাক, মমতাময়ী এবং শান্ত ভদ্রমহিলা, যিনি আমার মতো একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত বালককে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চা, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন।
আধাঘণ্টা পরে আমরা বেরিয়ে এলাম ডাইনিং রুম ছেড়ে, হাঁটতে লাগলাম প্ল্যাটফর্ম ধরে। ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে একটা ইঞ্জিন বারবার সামনে পেছনে যাতায়াত করছিল। একবার ইঞ্জিনটা আমাদের অতিক্রম করে গেল, একটা ছেলে প্ল্যাটফর্ম থেকে লাফ দিয়ে রেললাইনের উল্টো পাশে চলে গেল। ওটা ছিল তার পাশের প্ল্যাটফর্মে যাবার সহজ, সংক্ষিপ্ত পথ। ছেলেটা ইঞ্জিনটা থেকে নিরাপদ দূরত্বেই ছিল, সে পড়ে না গেলে তার কোনো বিপদ ঘটত না। কিন্তু ছেলেটা লাফ দেবার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা শক্ত করে ধরে ফেললেন আমার হাত। তার আঙুলগুলো চেপে বসেছিল আমার হাতে, তাতে আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছিলাম। আমি তার হাতের আঙুলগুলো ধরে মাথা তুলে তার মুখের দিকে তাকালাম। সেখানে আমি দেখতে পেলাম যেন একটা ভয়, দুঃখ এবং ব্যথার ঝলক খেলে গেল। তিনি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন তার অন্য প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ওঠার দৃশ্য। ছেলেটা যতক্ষণ না ওই প্ল্যাটফর্মে মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়, ততক্ষণ তিনি সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তিনি আমার ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিলেন। তিনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকালেন আমার দিকে এবং আবার তিনি ধরলেন আমার হাত, কিন্তু তার হাতের হাতের আঙুলগুলো তখন কাঁপছিল।
‘ও ঠিকমত পৌঁছে গেছে’, আমি বললাম। আমার মনে হচ্ছিল তিনি যেন কারও কাছ থেকে আশ্বাস খুঁজছিলেন। তিনি আমার হাতে চাপ দিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন। নিঃশব্দে হেঁটে চললাম আমরা। এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম আমার রেখে যাওয়া স্যুটকেসগুলোর কাছে। সেখানে দেখা হলো আমার এক স্কুলের বন্ধুর সাথে। সে তার মাকে সাথে করে এসেছে। ওর নাম সতীশ। ওর বয়েস আমারই মতো।
ও বলে উঠল, ‘হ্যালো, অরুণ! ট্রেনটা বোধ হয় অন্যদিনের মতো আজও দেরি করে আসছে। তুমি কি জান, আমাদের একজন নতুন হেডমাস্টার এসেছেন এ বছর?’
আমরা হ্যান্ডশেক করলাম। ও তখন ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, এ হচ্ছে অরুণ। ও আমার বন্ধু। জান, ও আমাদের ক্লাসের সেরা বোলার।’
‘খুব ভালো লাগল শুনে’, তিনি বললেন। তার চোখে চশমা এবং তিনি একজন ভারিক্কি ধরনের মহিলা। যে মহিলা আমার হাতটা ধরেছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি বোধ হয় অরুণের মা?’
এ কথার উত্তরে আমি যেই কিছু ব্যাখ্যা দিতে যাব, অমনি আমার বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, আমি অরুণের মা।’
আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। আমি তক্ষুণি মহিলার দিকে তাকালাম। তাকে মোটেও বিব্রত বোধ হচ্ছিল না বরং তিনি হাসছিলেন সতীশের মায়ের দিকে চেয়ে।
সতীশের মা বললেন, ‘মাঝরাতে এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে দারুণ খারাপ লাগে। একজন ছেলেকে একা একা এখানে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এরকম বড় স্টেশনে ওদের মতো ছোট একটা ছেলের যা কিছু ঘটে যেতে পারে। এখানে কত সন্দেহভাজন লোক চারদিকে ঘোরাফেরা করছে। আজকাল সবরকমের মানুষের কাছ থেকে সাবধানে থাকতে হয়।’
আমার পাশ থেকে সেই মহিলা বলে উঠলেন, ‘যদিও অরুণ একা একাই যাতায়াত করতে পারে।’ এই কথাগুলো বলায় আমি একদিক থেকে মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। ততক্ষণে আমি তার মিথ্যা ভাষণের জন্য মনে মনে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। অপরপক্ষে, অন্যদিকে আমি সতীশের মায়ের প্রতি খুবই বিরক্ত বোধ করছিলাম।
‘যাই হোক, অরুণ খুব সাবধানে থেকো’– সতীশের মা তার চশমার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে বললেন কথাক’টি। ‘সাবধানে থেকো, তোমার মা থাকছেন না তোমার সাথে। কখনও কোনো অচেনা মানুষের সাথে কথা বলবে না!’
আমি সতীশের মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যে মহিলা আমাকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন তার দিকে তাকালাম, তারপর আবার আমি ফিরে তাকালাম সতীশের মায়ের দিকে।
আমি বলে উঠলাম, ‘অচেনা নতুন মানুষকে আমি পছন্দ করি।’ এতে সতীশের মা অবশ্যই বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন, কারণ তিনি কিছুতেই ছোট ছেলেদের তার কথার প্রতিবাদ করাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারতেন না।
‘ও, এই কথা! তুমি যদি তাদের ভালোভাবে না চেনো তাহলে একসময় তারা তোমার বিপিত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সবসময় তোমার মায়ের কথা শুনে চলবে,’ একটা মোটা খাটো আঙুল নাড়াতে নাড়াতে কথা কয়টি আমার উদ্দেশ্যে বললেন তিনি। ‘আর কখনও অচেনা মানুষের সাথে কথা বলবে না।’
আমি বেশ বিরক্তির সাথে তাকালাম তার দিকে, আর সরে গেলাম তার কাছে, যিনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। সতীশ ওর মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল আমার দিকে তাকিয়ে। ওর মায়ের আর আমার বিবাদ দেখে ও বেশ খুশি হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, ও ছিল আমারই দলে।
ঘণ্টা বেজে গেল স্টেশনের, মানুষেরা যারা প্ল্যাটফর্মের ওপর ইতস্তত অলস ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করছিল, ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। সতীশ চেচিয়ে বলল, ‘দেখ, গাড়ি এসে গেছে।’ তীব্র স্বরে ইঞ্জিন থেকে বেজে উঠল হুইসেল, রেললাইনের ওপর দূরে ফুটে উঠল হেডলাইটের আলো।
আস্তে আস্তে চলছিল ট্রেনটা, একসময় এসে ঢুকে গেল স্টেশনের ভেতর। হিস্ হিস্ শব্দ করে ইঞ্জিনটা ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডলী। গাড়িটা থামা মাত্রই সতীশ একটা আলোজ্বলা কম্পার্টমেন্টের পাদানিতে উঠে গেল লাফ মেরে, আর সেখান থেকে চেচাতে লাগল। ‘অরুণ, এদিকে এসো! এই কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা আছে!’ আমি স্যুটকেসটা তুলে দিয়েই ছুটলাম দরজাটার দিকে।
আমরা দেখেশুনেই জানালার পাশে আমাদের সিট করে নিলাম। আর দু’জন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে, প্ল্যাটফর্মের ওপর। সেখান থেকেই তারা আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। সতীশের মাই বেশি কথা বলছিলেন।
তিনি বললেন, ‘এখন আর হুট হাট করে ট্রেন থেকে লাফ দিও না, ঠিক এখন যেমনটা করলে। জানালা দিয়ে তোমাদের মাথা বাইরে বের করে দিও না, আর পথে যা তা কিনে খেও না।’ তিনি আমাকেও তার উপদেশমালার অংশভাগী করলেন। কারণ তিনি আমার ‘মা’-কে সম্ভবত এসব পরামর্শ দেবার মতো উপযুক্ত মানুষ বলে মনে করছিলেন না। তিনি সতীশের হাতে এক থলি ফল, একটি ক্রিকেট ব্যাট আর একটা চকোলেটের বাক্স দিয়ে সেটা দু’জনে ভাগ করে খেতে বললেন। তারপর তিনি সরে দাঁড়ালেন জানালার কাছ থেকে। তিনি দেখতে চাইছিলেন, আমার ‘মা’ আমার জন্যে কী করেন।
আমি সতীশের মায়ের গুরুজনী, সর্দারি কণ্ঠস্বরকে মোটেই সহ্য করতে পারছিলাম না; কারণ উনি স্পষ্টত মনে করেছিলেন আমি যেন খুব একটা দরিদ্র পরিবারের ছেলে। আমি চাইছিলাম না অন্য ভদ্রমহিলা ওই স্থান ছেড়ে চলে যান। আমি তাকে আমার হাতটা ধরে থাকতে দিলাম, কিন্তু কিছুই বলার মতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম সতীশের মা বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছেন আমার দিকে আর আমি ততক্ষণে সতীশের মাকে মনে মনে দারুণ ঘৃণা করতে শুরু করেছি। গাড়ির গার্ড প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁশি বাজিয়ে সংকেত দিলেন গাড়ি ছাড়ার। আমি সরাসরি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকালাম। তিনি তখনও আমার হাত ধরে ছিলেন। তার মুখের শান্ত হাসি বলে দিচ্ছিল, তিনি সবই বুঝতে পারছেন। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে তার ঠোঁটের ওপর রাখলাম আমার ঠোঁট দুটো। আমি তাকে চুম্বন করলাম।
তখনই গাড়িটা ঝাঁকা দিয়ে নড়েচড়ে উঠে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ভদ্রমহিলা ছেড়ে দিলেন আমার হাত।
সতীশ বলে উঠল, ‘বিদায়, মা।’ আর তখনই একটু একটু করে সামনের দিকে চলতে লাগল গাড়িটা। সতীশ আর তার মা দু’জনেই পরস্পরকে উদ্দেশ করে হাত নাড়তে লাগল।
‘বিদায়,’ আমি অন্য ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ করে বললাম। ‘বিদায়– মা...।’
আমি হাতও নাড়লাম না চীৎকারও করলাম না, চুপ করে বসে থাকলাম জানালার পাশে, শুধু তাকিয়ে থাকলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলার দিকে। সতীশের মা ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলছিলেন, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল, কিছুই শুনছেন না তিনি, তিনি তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, ট্রেনটা এগিয়ে চলল আমাকে নিয়ে। ওই ব্যস্ত প্ল্যাটফর্মে ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, একজন সাদা শাড়ি পরা মিষ্টি, বিবর্ণ মহিলা, আর আমি তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে, যতক্ষণ না মানুষের ভিড়ে মিশে যান তিনি। v