হাতি মৃত্যুর মামলায় দোকানি জেলে, চাপা কান্না পরিবারে
Published: 25th, March 2025 GMT
‘এই জমির জন্য আমার সোয়ামি (স্বামী) মরে গেছে, নিজে পঙ্গু হইছি, আত্তির (হাতি) মুখ থেইকা ফসল বাঁচাইতে গিয়ে পুলা (ছেলে) এখন জেলে।’ এভাবেই নিজের ক্ষেতে বুক চাপড়ে আহাজারি করে কথাগুলো বলেছেন বৃদ্ধা জুলেখা বেগম।
নালিতাবাড়ী সীমান্তের পূর্ব সমশ্চুড়া এলাকায় বসবাস করেন জুলেখা বেগম। তাঁর সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়ে সবাই বিবাহিত। স্বামীর রেখে যাওয়া দুই একর আবাদি জমি রয়েছে। বনের জমিতে বাড়ি করে ছেলেদের নিয়ে কোনোমতে বসবাস করছেন।
জমির ফসল ও ছেলেদের উপার্জন থেকে কোনোরকম একটি মাটির ঘরে দিনাতিপাত করেন এই বৃদ্ধা। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর জমির পাশে দেওয়া বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে একটি বন্যহাতির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বড় ছেলে জিয়াউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুক্রবার আটক কৃষকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বন্যহাতি হত্যার অভিযোগে থানায় মামলা করেন বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ শেরপুরের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল আমিন। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। বন বিভাগের মামলায় জেল খাটছেন জিয়াউর রহমান।
স্থানীয়রা জানান, পূর্ব সমশ্চুড়া গুচ্ছগ্রাম-সংলগ্ন এলাকার ময়েজ উদ্দিনের ছেলে জিয়াউর রহমান। ময়েজ উদ্দিন ধারদেনা করে নিজের নামে গুচ্ছগ্রাম-সংলগ্ন পাহাড়ের ঢালে দুই একর জমি কেনেন। জমির ফসলে সংসার ভালোই চলছিল। ২০১৬ সালের একদিন ওই জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে গেলে স্থানীয় একজনের সঙ্গে ঝগড়া বাধে ময়েজ উদ্দিনের। এক পর্যায়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ময়েজকে। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরেন জিয়াউর রহমান। সম্প্রতি মধুটিলা ইকোপার্ক-সংলগ্ন সীমান্ত সড়কে একটি দোকান ঘর নির্মাণ করেন তিনি। দোকানের আয় ও বাবার রেখে যাওয়া জমির ফসল থেকে দুই সন্তানের পড়াশোনা ও সংসার খরচ চলে যেত। এখন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় মানবেতর দিন
কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। হাতি মৃত্যুর মামলায় জেলে থাকায় স্বামীকে কিভাবে মুক্ত করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না স্ত্রী রেখা খাতুন।
এলাকাবাসী জানান, ধান পাকার মৌসুম এলেই সীমান্তজুড়ে হাতির উপদ্রব শুরু হয়। দেড় সপ্তাহ ধরে ২০-২৫টি বন্য হাতি গারো পাহাড়ের বিভিন্ন টিলায় ও জঙ্গলে অবস্থান করছে। দিনের বেলায় টিলা বা জঙ্গলে অবস্থান করলেও সন্ধ্যা নামার পর হাতির পাল দল বেঁধে ধানক্ষেতে, লোকালয়ে নেমে আসে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও পূর্ব সমশ্চুড়া গুচ্ছগ্রাম-সংলগ্ন পাহাড়ের ঢালে থাকা কৃষক জিয়াউর রহমানের বোরো ক্ষেতে হানা দেয় বন্যহাতির পাল। এ সময় একটি মাঝ বয়সী পুরুষ হাতি ওই ক্ষেতের পাশে দেওয়া বৈদ্যুতিক জিআই তারে আটকে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
জিয়াউর রহমানের বোন মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘এই জমি রক্ষা করতে গিয়ে মাইনসের (মানুষের) হাতে বাবা প্রাণ হারিয়েছেন। এখন ফসল বাঁচাতে গিয়ে হাতি মৃত্যুর মামলায় ভাই জেলে।’ আক্ষেপ করে জানান, হাতির জন্য কোনো বছরই ফসল ঘরে তোলা যায় না। তাই তাঁর ভাই ক্ষেতের পাশে বিদ্যুতের তার দিয়েছিল, যেন হাতির পাল কষ্টের ফসল নষ্ট করতে না পারে। তিনি বলেন, ‘বছর বছর যদি আত্তি ফসল খেয়ে যায়, তাহলে বাঁচমু কেমনে।’
স্থানীয় যুবক স্যামুয়েল চাম্বুগং জানান, সন্ধ্যার পর পরই হাতির পাল হাঁক-ডাক শুরু করে। সীমান্তের কৃষকের গলার কাঁটা এই হাতি।
শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক সাদেকুল ইসলাম খানের ভাষ্য, জেনারেটরের
বিদ্যুৎ দিয়ে বন্যহাতি হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিয়াউর রহমান জিয়া নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মামলা করা হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ফসল
এছাড়াও পড়ুন:
‘সন্তানের উসিলায় আজীবন পহেলা বৈশাখ ভিন্নভাবে পালন করতে পারব’
বাড়ির পাশে মুরগির খামার। খামারে স্বামী মমিনুল ইসলামকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী রত্না বেগম। দীর্ঘ কয়েক মাস তিনি একাই চালিয়ে যাচ্ছেন খামারের সব কাজ। কারণ, রত্না বেগম এখন হাসপাতালের বেডে। রোববার মধ্য রাতে হঠাৎ প্রসব বেদনার যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না। স্বজনদের পরামর্শে বাধ্য হয়ে রাতেই তাঁকে রংপুর নগরীর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পহেলা বৈশাখ সকাল ৬টায় তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় পুত্রসন্তান। শিশুটির জন্মগ্রহণের খবরে চারদিক সরব হয়ে ওঠে। কিন্তু মমিনুলের মুখে হাসি নেই। কারণ তিনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন সন্তান সুস্থ থাকলেও প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী।
হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. ফারহানা ইসলাম জানান, অস্ত্রোপচার করতে হয়নি। স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে রত্নার। তিনি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। তাঁর শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। সন্তান সুস্থ-স্বাভাবিক রয়েছে, মায়ের দুধ পান করছে।’
‘পর পর দুটি কন্যাসন্তানের পর ছেলে হইল, আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করেছে। পহেলা বৈশাখ সকালে সন্তানের জন্ম হওয়ায় আমরা খুবই খুশি। সন্তানের উসিলায় আজীবন আমরা পহেলা বৈশাখ ভিন্নভাবে পালন করতে পারব।’ সন্তান কোলে তুলে আনন্দের এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের বাবা মমিনুল ইসলাম।
রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া গঞ্জিপুর গ্রামের বাসিন্দা মমিনুল ২০১২ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের রত্না বেগমকে পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে করেন। খেটে খাওয়া দম্পতির পর পর তাদের দুটি কন্যাসন্তান হয়। তৃতীয় সন্তানের আশায় প্রহর গুনছিলেন পরিবারের সবাই। যদিও অন্তঃসত্ত্বাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেননি তারা। জানতেন না সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিনক্ষণ। ভরসা করেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। তবে তারা মনে করেন সন্তান নেওয়ার আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এতে অনেক জটিলতা কমে আসে।
বাড়ির খামারের আয় দিয়েই মূলত পাঁচ সদস্যের সংসার চলে। ধর্মভীরু মা-ই তাদের দুই কন্যাসন্তানের নাম রেখেছেন। বড় মেয়ে জান্নাতুল মুনতাহার বয়স ১১ বছর। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাঁচ বছর বয়সের জান্নাতুল মাওয়া স্থানীয় মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করে মাত্র। তৃতীয় সন্তান এলো এবার। হিসাব অনুযায়ী এ মাসের যে কোনো সময় সন্তান প্রসব হতে পারে ধারণা ছিল এ দম্পতির। বাংলা নববর্ষের দিনই হবে এমন ধারণা ছিল না।
এটি শুভ লক্ষ্মণ উল্লেখ করে মমিনুল ইসলাম জানান, ভালো দিনেই ছেলের জন্ম হয়েছে। বাংলা বর্ষবরণে যেদিন বাঙালিরা তাদের প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে; এমন উৎসবের দিনে সন্তান জন্ম হওয়ায় তার জন্মদিন যেমন সহজে মনে থাকবে, তেমনি প্রতি বছর উৎসবের মধ্যেই জন্মদিন পালন হবে।
সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান মমিনুল। তিনি বলেন, ছেলেকে কুরআনের হাফেজ বানিয়ে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে জীবনে কত কষ্টই না করেন বাবা-মা। কিন্তু এক সময় বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়ার মতো সময় থাকে না ওই সন্তানের। সবকিছু থাকার পরও শেষ সময়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয় অনেক বাবা-মাকে। তাই সন্তানকে মানবিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে তৈরি করতে চাই।
তিনি আরও জানান, রোববার রাতে রত্না বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে ভাড়া করা গাড়িতে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানকার ডাক্তার-নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। প্রসবের ব্যবস্থা করেন। অবশেষে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। পহেলা বৈশাখ সকালে সন্তান জন্ম নিলেও কেউ আমাদের কোনো শুভেচ্ছা জানায়নি। দৈনিক সমকাল নবজাতকসহ আমাদের সন্তানকে ফুল দিয়ে বরণ করেছে, তা আজীবন মনে থাকবে।’
পহেলা বৈশাখ সকালে ওই হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, রত্না বেগম বেডে শুইয়ে থাকলেও মমিনুল ইসলাম ওয়ার্ডের মধ্যে সন্তানকে কোলে জড়িয়ে পায়চারি করছেন। নবজাতকের শরীরে তখন শুধুই টাওয়াল জড়ানো। তবে খবর পাওয়ার পর বাড়ি থেকে স্বজনরা এসে তাকে জামা পরিয়েছে। বাজার থেকে কিনে পহেলা বৈশাখের লাল টুকটুকে জামা পরাবেন বলে জানান মমিনুল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁর কোলেই প্রথম উঠেছে এই নবজাতক।
শিশুর নাম রেখেছেন মোহাম্মদ রাইয়ান। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন বলে জানান। মমিনুলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন কোনো কথা না বললেও হাসপাতালের বেডে শুইয়ে সন্তানের মা রত্না বেগম সবকিছু দেখছিলেন এবং শুনছিলেন। তাঁর কাঙ্ক্ষিত সন্তানকে বরণ করে নেওয়ায় যেন চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন তিনিও।
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে সন্তান ও মায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা করেন মমিনুল। আমার খামারের সঙ্গী এখন হাসপাতালে। তাকে সুস্থভাবে নিয়ে যেন দ্রুত হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারি এটাই এখন চাওয়া।