আ’লীগ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবেছে কালুহাটি পাদুকাপল্লি
Published: 25th, March 2025 GMT
কয়েক দিন পরই ঈদুল ফিতর। এ সময়ে আগে দম ফেলানোর ফুরসত থাকত না কারখানা মালিক ও কারিগরদের। হাজারো শ্রমিক, ক্রেতা ও বিক্রেতায় মুখর বড়াল পারের এ পল্লিতে এখন সুনসান নীরবতা। প্রতিমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে বসেছে চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী কালুহাটি পাদুকাপল্লি।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত পাদুকাপল্লিতে পর্যায়ক্রমে ৮২টি কারখানা গড়ে ওঠে। বর্তমানে চালু আছে মাত্র ১১টি কারখানা। ১০ হাজার শ্রমিক যুক্ত ছিলেন এ পেশায়। যার মধ্যে ২ হাজার নারী। ঈদের মৌসুমে ৬০-৬৫ কোটি টাকার জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি হতো। বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যেতেন। কালুহাটি পল্লির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে।
কারখানা মালিকরা বলছেন, শাহরিয়ার আলম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর পাদুকাপল্লির আলো ফিকে হতে শুরু করে। বিভিন্ন কোম্পানির মেশিনে তৈরি জুতা-স্যান্ডেল বাজারে নিয়ে আসেন। এতে কালুহাটির হাতে তৈরি জুতা-স্যান্ডেলের চাহিদা কমতে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকতে মালিকরা ছোটখাটো মেশিন কিনতে ঋণের আবেদন করেন। এ সুযোগে প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন ইউপি সদস্য জেলা যুবলীগের সহ-সম্পাদক কামাল হোসেন ও তাঁর ভাগিনা সোহেল রানা কোনো কারখানার না থাকলেও পাদুকা সমবায় সমিতি গঠন করেন।
প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে কারখানা মালিকদের নামে এসএমই ফাউন্ডেশন ও সমবায় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাতে দুই মামা-ভাগিনার পকেট ভারী হলেও মালিকদের কোনো উপকারে আসেনি। করোনাকালে সমিতির নামে বিভিন্ন সুবিধা এনে নিজেরা ভোগ করেছেন। করোনাকালে ৬০-৬৫ কোটি টাকার ব্যবসা নেমে আসে ১৫-২০ কোটিতে।
পাদুকাশিল্প বাঁচাতে এসএমই ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে ৬৩ লাখ টাকায় ১৩টি অত্যাধুনিক মেশিনসহ দেশের প্রথম পাদুকা কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার (সিএফসি) স্থাপন করে। প্রকৃত কারখানা মালিকদের না জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী যুবলীগ নেতা কামাল হোসেন ও তাঁর ভাগিনাকে সিএফসি স্থাপনের জমি নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়। কামাল হোসেন কালুহাটি বাজারে বিএনপির সমর্থক মফিজ উদ্দিনের জমি দখল করে সিএফসি স্থাপনে এসএমই ফাউন্ডেশনকে চুক্তিবদ্ধ করে। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার দাপটে সেখানে সিএফসি স্থাপন করা হয়। সিএফসিকে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন কামাল হোসেন।
এদিকে ভুয়া কারখানা দেখিয়ে কামাল হোসেন ও সোহেল রানা নামে-বেনামে এসএমই ফাউন্ডেশন ও সমবায় থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেনি। তাদের কারণে প্রকৃত কারখানা মালিকরা সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করেও পাঁচ বছরে ঋণ সহায়তা পাননি। পুঁজির অভাবে কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়। গত জুন মাসে বিসিক কর্তৃপক্ষ পাদুকাপল্লি পরিদর্শন করে প্রতিটি কারখানাকে পাঁচ লাখ টাকা হারে ঋণের অনুমোদন দেয়। আগস্ট মাসে সেই ঋণ ছাড় করার কথা ছিল। কিন্তু পাঁচ আগস্টের সেই ঋণও বন্ধ হয়ে যায়। শাহরিয়ার আলম, যুবলীগ নেতা কামাল হোসেন ও সোহেল রানা আত্মগোপনে চলে যান। সিএফসি দখলে নেন মফিজ উদ্দিন ও তাঁর ছেলে শাহ আলম। বিএনপি সমর্থকরা সিএফসির সেন্টারের ভেতরেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। বর্তমানে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
মণ্ডল শুজ কারখানার মালিক জাকারিয়া হোসেন বলেন, ছয় মাস বন্ধ রাখার পর ঈদকে কেন্দ্র করে কারখানা চালু করেছি। আগে রোজার এক মাসে ১৫-২০ লাখ টাকার ব্যবসা করতাম। কিন্তু এ বছর পাঁচ লাখ টাকার ব্যবসাও হবে না। বাইরের জেলার ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
স্মার্ট শুজ কারখানার মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, টাকা পরিশোধ করেও নতুন ঋণ পাচ্ছি না। সিএফসিও বন্ধ রয়েছে। হাত দিয়ে আধুনিক জুতা তৈরি সম্ভব নয়। তাই কারখানাও বন্ধ রেখেছি। আমার মতো অনেকেই কারখানা চালু করতে পারেননি।
পাদুকা কারিগর আবদুল মতিন বলেন, কাজ নেই। বাধ্য হয়ে সকালে দিনমজুর হিসেবে ও বিকেলে কারখানায় টুকটাক কাজ করছি। বেকারমুক্ত গ্রামটিতে এখন অসখ্য বেকার।
জেলা যুবলীগের সহ-সম্পাদক কামাল হোসেন বলেন, নিজের জমিতে সিএফসি স্থাপন করেছি। অন্যের জমি দখলের অভিযোগ মিথ্যা। অন্যান্য বিষয় সমাধানের জন্য একাধিকবার বসতে চেয়েছি, কোনো পক্ষই রাজি হয়নি।
কালুহাটি পাদুকাশিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, আমি কোনো অনিয়ম করিনি। বরং সরকার পতনের পর আমার কারখানার মালপত্র লুট হয়েছে। সিএফসি স্থাপনের সময় ব্যক্তিগত যে টাকা খরচ করেছি, সে টাকাও সমিতি এখনও ফেরত দেয়নি। এলাকায়ও যেতে পারছি না।
এসএমই ফাউন্ডেশনের উপমহাব্যবস্থাপক (ক্লাস্টার উন্নয়ন) আবু মঞ্জুর সাঈফ বলেন, সমিতির সভাপতি-সম্পাদক কারোরই কারখানা ছিল না। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে সমিতি গঠন করেছিলেন। এ জন্য সিএফসিকে তারা কখনোই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ব যবস বন ধ র য বল গ সমব য় স এফস
এছাড়াও পড়ুন:
রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নিন
স্টেশন বন্ধ। কিন্তু ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। যাত্রীরাও ওঠানামা করেন। তবে টিকিট ছাড়া। কারণ, স্টেশন বন্ধ থাকায় কোনো টিকিট বিক্রি হয় না। কুমিল্লার লাকসাম থেকে রেলপথে নোয়াখালী পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটারের দূরত্বে এ রকম ছয়টি স্টেশন আছে। প্রায় দুই দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে স্টেশনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতগুলো স্টেশন থেকে বিনা টিকিটে যাত্রী ওঠানামা করেন। ফলে প্রতিনিয়ত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দীর্ঘ রেলপথটিতে মোট ১২টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে লাকসামের দৌলতগঞ্জ, মনোহরগঞ্জের খিলা ও বিপুলাসার, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বজরা, নোয়াখালী সদরের মাইজদী ও হরিনারায়ণপুর স্টেশনের কার্যক্রম ২০০৩ সালের পর থেকে পর্যায়ক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আগে এই রেলপথে প্রতিদিন আন্তনগর, এক্সপ্রেস, লোকাল, ডেমুসহ অন্তত ১২টি ট্রেন চলাচল করত। এ রেলপথে এখন আন্তনগর উপকূল এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন চলাচল করে। আর তিনটি ভিন্ন নামে আরেকটি এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে, যেটি স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে লোকাল ট্রেন হিসেবে পরিচিত।
পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, জনবলসংকটসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে এসব স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মানুষের কথা চিন্তা করে এখনো ট্রেনসেবা চালু রাখা হয়েছে। এসব স্টেশনে বিনা টিকিটে যাত্রী ওঠার পাশাপাশি বুকিং ছাড়াই মালামালও পারাপার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও প্রতিনিয়ত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয় যে মানুষের কথা চিন্তা করে ট্রেনসেবাটি তারা বন্ধ করেনি। তবে স্টেশনগুলো আবার চালু করাও সময়ের দাবি। কারণ, স্থানীয় লোকজনই বলছেন স্টেশনগুলো দিয়ে বিপুল মানুষ যাতায়াত করে থাকেন। এক ব্যক্তি বলছেন, ‘খিলা ও বিপুলসার স্টেশন আমাদের গ্রামের দুই দিকে কাছাকাছি। একসময় এই স্টেশনগুলো জমজমাট ছিল। দিনরাত ট্রেনের হুইসেল বাজত। কিন্তু এখন জৌলুশ নেই। স্টেশনগুলো বন্ধ থাকায় রাতে সেখানে মাদকসেবীদের আড্ডাসহ অসামাজিক কার্যক্রমও চলে। আমরা চাই, রেলের সোনালি দিনগুলো ফিরে আসুক।’
দৌলতগঞ্জ স্টেশনটি দেড় দশক আগেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্টেশনটি ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় নদীপথে আসা মালামাল ট্রেনে আনা-নেওয়ার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হতো। এখন টিকিট বেচা ও মালামাল পরিবহনে বুকিং কার্যক্রম বন্ধ। কিছু জায়গা এখন দখল হয়ে কয়েক শ অস্থায়ী দোকান বসে গেছে, যার মধ্যে গড়ে উঠেছে লাকসামের বৃহৎ কাঁচাবাজার।
আমরা আশা করব, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে স্টেশনগুলো আবারও চালু করা হবে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে আমরা জানতে পারছি। এখন কবে নাগাদ পরিবর্তন দেখতে পাব আমরা, সেটিরই অপেক্ষা।