Samakal:
2025-04-15@14:43:26 GMT

‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’

Published: 25th, March 2025 GMT

‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধদিনের কথা মনে হলে এই পড়ন্ত বয়সেও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ফিরে যাই আজ থেকে ৫৪ বয়স আগে। যৌবনের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে হতেই শিহরণ জাগে। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে সেদিন জীবন উৎসর্গ করতেও যেন কোনো দ্বিধা ছিল না। ‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’-এর মাঝামাঝি আর কিছুই যেন ওই সময় চিন্তা করতে পারতাম না। 
২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছাত্র, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দলে দলে সাধারণ মানুষ  জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আলী আজম ভূঁইয়া এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুর বাসভবনে জড়ো হতে থাকেন।  সবাই দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। নেতৃবৃন্দের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে নেতৃবৃন্দ টেলিফোনে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন। যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু ঢাকা থেকে তাঁর এক আত্মীয়ের ফোনের মাধ্যমে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়ে যাওয়ার খবর পান। তিনি ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে খবর চাউর হতে থাকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর ও কুমিল্লা সেনানিবাস দখল করে নেয়। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে, বিভিন্ন পুলিশ, ইপিআর ও আনসার ক্যাম্পগুলোয় আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পাকিস্তানি বাহিনী অনুরূপ আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এলাকার সংগ্রামী জনতা প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সে উদ্দেশ্য নস্যাৎ করে দেয়। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনামাফিক কথিত ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাতে ১ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর সাদেক নেওয়াজের (পাকিস্তানি) নেতৃত্বে দুটি কোম্পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ওয়াপদা রেস্টহাউসে অবস্থান করছিল। পরে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক খিজির হায়াত খান (অবাঙালি) ব্যাটালিয়নের বাকি সৈনিকদের নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন।
পরদিন ২৬ মার্চ সকাল থেকেই সেনাবাহিনীবোঝাই ট্রাক রাস্তায় নেমে আসে। ট্রাক থেকে শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। জনতাকে বাড়িঘরে ফিরে যেতে বলা হয়। না হলে দেখামাত্র গুলি করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় প্রাথমিকভাবে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলেও জনতা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আলী আজম ভূঁইয়া ও লুৎফুল হাই সাচ্চুর বাসভবনে সমবেত হতে থাকে। এদিকে অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ একটি জিপগাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁর হাতে একটি হ্যান্ডমাইক। সারাশহরে তিনি কারফিউর বিরুদ্ধে পাল্টা ঘোষণা দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা লাঠিসোটা, কাঠের টুকরা, বাঁশ, রামদা, বল্লমসহ নানা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিছিলের পদভারে আর স্লোগানে স্লোগানে সারাশহর প্রকম্পিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন প্রতিবাদের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২৭ মার্চ সকালে নাশতার টেবিলে বসার সময় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা অধিনায়ক খিজির হায়াত খান, মেজর সাদেক নেওয়াজসহ তিন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সংবাদ শুনে ওখানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে তারাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এদিকে বিদ্রোহের খবর পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছামাত্র দুই কিলোমিটার দূর থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।  তাদের আসার লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে বাঙালি জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণ করানো। খবর পেয়ে সংগ্রামী জনতা মিছিল নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানায়। এরই মধ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ সিলেটের শমশেরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছান। এসেই তিনি প্রথমে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানদের নিয়ে এক জরুরি সভায় মিলিত হন। ওই সভায় মেজর খালেদ মোশাররফকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং উপ-অধিনায়ক করা হয় মেজর শাফায়াত জামিলকে। এখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশ এলাকা শত্রুমুক্ত রাখার নানা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।  
এদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পাকিস্তানি বাহিনী দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থলপথে সুবিধা করতে না পেরে তারা বিমান হামলা শুরু করে। ২ এপ্রিল থেকে তারা উপর্যুপরি বিমান হামলা শুরু করে। বিমান হামলার মধ্যে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমাংশের বিভিন্ন জায়গায় হেলিকপ্টারযোগে সৈন্য নামিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখলে চেষ্টা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিল উপর্যুপরি বিমান হামলা চালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখলে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। পর্যায়ক্রমে ১৯ এপ্রিল আখাউড়া, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তবর্তী আজমপুর এলাকাসহ পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাই দখলে নেয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের বিমান হামলায় টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসের দিকে কুমিল্লা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে হোমনা, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর হয়ে সরাইল-আশুগঞ্জ এলাকায় আসি। যুদ্ধকালীন সরাইলের প্রত্যন্ত অরুয়াইল, পাকমিল, আশুগঞ্জের পাকশিমুল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছি। ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হবে, কল্পনাও করেনি। তখন পণ করেছিলাম– ‘হয় বিজয় নয়তো মরণ’। এর মাঝে আর কিছুই নেই। ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর মুক্ত হওয়ার সময় আমি ও সহযোদ্ধা হাবিব (কামাউড়া) শহরতলির ঘাটুরা দিয়ে মেড্ডা হয়ে শহরে প্রবেশ করি। ওই দিনই মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কের ওপর বসে আশুগঞ্জের দিকে রওনা দিই। ৮ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। মেঘনার অপর পার ভৈরবে পাকিস্তান বাহিনীর শক্ত অবস্থান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা  আশুগঞ্জে জড়ো হলে তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়।  
ভৈরব ও আশুগঞ্জ থেকে তাদের কামানের গোলার আঘাতে যৌথ বাহিনী সামনের দিকে এগোতে পারছিল না। ৯ ডিসেম্বর বিকেলে যৌথ বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো লক্ষ্য করে ভারী মেশিনগান, কামান ও বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। ওই সময় আমি ছিলাম ট্যাঙ্কের ওপরে। এক পর্যায়ে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে লাফ দিয়ে রাস্তার খাদে পড়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করি। পরক্ষণেই দেখি, ট্যাঙ্কটি বিধ্বস্ত হয়। পরে ওখান থেকে দীর্ঘ পথ ক্রলিং করে জীবন রক্ষা করি। ব্যাপক হতাহতের পর পাকিস্তান বাহিনী পিছু হটে ভৈরব গিয়ে আশ্রয় নিলে ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হয়। 
অনুলিখন
আবদুন নূর 
নিজস্ব প্রতিবেদক ব্রাহ্মণবাড়িয়া

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় কর মকর ত ড স ম বর অবস থ ন র কল প

এছাড়াও পড়ুন:

অর্থের অপচয় করে তিস্তায় আর অকার্যকর প্রকল্প নয়

তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনাসহ যে পরিকল্পনা করা হোক না কেন, নদীর স্বাস্থ্য রক্ষাসহ প্রাণ-প্রকৃতি ও নদীপারের মানুষের স্বার্থের কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থের অপচয় করে তিস্তায় আর কোনো অকার্যকর প্রকল্প আমরা দেখতে চাই না।

রংপুরে আয়োজিত তিস্তা কনভেনশনে এসব কথা বলেছেন বক্তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ এ কনভেনশনের আয়োজন করে। বক্তারা পানিচুক্তি ছাড়া কোনো প্রকল্প কার্যকরের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ মন্তব্য করে বলেন, ঋণ নিয়ে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে হবে না, সেই ঋণ পরিশোধের বিষয়টিও ভাবতে হবে।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি হলরুমে আয়োজিত কনভেনশনে প্রধান আলোচক ছিলেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান। আলোচক ছিলেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আলী রায়হান সরকার, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পল্টু ও নদী বিশেষজ্ঞ শেখ রোকন।

বক্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে তিস্তাসহ ৫৪টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে ভারত ৪৯টিতে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভাটির দেশের প্রাপ্যতা ও নদীতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রেখে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া উজানের দেশ একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ তুলে তিস্তা সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বক্তারা।

রংপুর জেলা বাসদের আহ্বায়ক কমরেড আব্দুল কুদ্দুসের সভাপতিত্বে কনভেনশনে তিস্তা ইস্যু নিয়ে আরও বক্তব্য দেন ভাষাসংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফজাল, সিপিবি রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন রংপুর জেলা নির্বাহী মুনির চৌধুরী, ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান, সাংবাদিক স্বপন চৌধুরী প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ