Samakal:
2025-04-15@19:50:44 GMT

ইতিহাসই স্বাধীনতার প্রেরণা

Published: 25th, March 2025 GMT

ইতিহাসই স্বাধীনতার প্রেরণা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি পুরোমাত্রার সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। 
এর আগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য। মুজিবের সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, খন্দকার মোশতাক প্রমুখ। শেখ সাহেব বক্তব্যে অটল ছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল– আমরা ইলেক্টেড হয়েছি; পূর্ব পাকিস্তানে সব সিটে আমাদের প্রার্থী জিতেছে। আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম– ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান পাকিস্তানের জন্য রচনা করা হবে। আমরা এই কর্মসূচি দিয়ে জনসমর্থন পেয়েছি। এখন আমরা ছয় দফাকে ভিত্তি হিসেবে রেখে নতুন সংবিধান করব। 

পশ্চিম পাকিস্তানের বড় দল ছিল জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরও ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ কতগুলো ছোট ছোট কমিউনিস্ট গ্রুপ। আরও ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি। একটা যুদ্ধ ধেয়ে আসছে– এটা আসলে কেউ কল্পনা করেনি। ইয়াহিয়া তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আলাপ করতে এসেছেন; শেখ মুজিবও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আলাপের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। দু’জনের ভেতর একান্ত বৈঠকও হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভাষ্য ছিল একটাই– আমরা ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছি বলেই জনগণ আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে; আমাদের নির্বাচিত করেছে। আমরা জনসাধারণের মাঝে এই কর্মসূচি প্রচার করেছি; আমাদের সমর্থন জোগাতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। তারা সাড়া দিয়েছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তো আমরা ভঙ্গ করতে পারি না। ছয় দফার ভিত্তিতেই আমাদের সরকার গঠিত হবে। 

ইয়াহিয়া খানের ভাষ্য ছিল– ছয় দফা তো পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলবে। যদিও আপনি বলছেন, পাকিস্তানের সংহতির জন্য ছয় দফা প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, এতে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। আপনার পরিকল্পনা পরিবর্তন করুন। শেখ সাহেব বক্তব্য পরিবর্তন করতে রাজি হলেন না। তাজউদ্দীন আহমদের লেখা আওয়ামী লীগের লিখিত বক্তব্য ইয়াহিয়া খানকে দেওয়া হয়। ইয়াহিয়া খান সেটা পড়েন নাই। ফাইলে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, আপনাদের প্রস্তাব আমি বিবেচনা করব। আমি চাইব যে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের এই আলোচনার মাধ্যমেই এমন সিদ্ধান্ত আমি দেব, যেখান থেকে সবাই উপকৃত হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া বাস্তবে তা করেননি। কারণ তাদের মনে ভয়– ছয় দফা, ১১ দফা পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার কর্মসূচি। শেখ মুজিব পাকিস্তান রাখতে চায় না। স্বাধীন বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। 

শেখ সাহেব তাঁর বক্তব্য থেকে সরেননি; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, ভুট্টো সাহেবও সরেননি। সুতরাং বিষয়টি অমীমাংসিত থাকে। ভুট্টো ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু। তিনি এক সময় বলতে শুরু করলেন দুই মেজরিটির পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। রাষ্ট্র একটা। এই রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাধিক্য আওয়ামী লীগের, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য না পেলেও মোটামুটি সংখ্যাধিক্য অর্জন করে পিপলস পার্টি। ভুট্টোর শেষ কথা ছিল ওটাই। দুই দলকে ক্ষমতা দিয়ে পাকিস্তান একটা পরিণতিতে পৌঁছাক। শেখ সাহেব তখন অতি-জরুরি মিটিং ছাড়া বের হতেন না। তবে তাঁর বাড়িতে প্রায় সবসময় গোটা পঞ্চাশেক মানুষ থাকত। আওয়ামী লীগের লোকেরা আসত, বসত; আলাপ করত। সবাই জানতে চায়– ‘কী করতে হবে।’

শেখ সাহেব একটা প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করেছিলেন এবং কর্মসূচি হিসেবে হরতাল ঘোষণা করেছিলেন। এই কর্মসূচি পালিত হওয়ার স্বার্থে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রথম সারির সব নেতৃত্বকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, আপনারা সবাই যান, এই কর্মসূচি সফল করেন। তাজউদ্দীন আহমদ, ড.

কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন– এই পন্থায় এগিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারব না। আন্দোলন নষ্ট করে দেবে। আমাদের অবশ্যই কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে ছয় দফা নিয়েই এগোতে হবে। আমাদের দেশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ছিলেন সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খানের ছেলে আবদুল ওয়ালী খান। তিনি বলেছিলেন, এত দৃঢ় অবস্থানে থাকলে আমাদের চলবে না। শেখ মুজিবের সঙ্গে আরও আলাপ করে মীমাংসা করতে হবে। জনসাধারণ যদি না চায়, তাহলে আমরা কেন তাদের ধরে রাখব– এ রকম বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। আরেকজন নেতা ছিলেন নৌবাহিনীর। তিনিও প্রশ্ন রেখেছিলেন– পূর্ব পাকিস্তানে কেন আমরা জবরদস্তি করব। তারা বলেছিলেন, যদি জনগণ আলাদা হতে চায়, তাহলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটা আমরা সব দল মেনে নেব। 
ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। ২৫ মার্চ মাগরিবের নামাজের পর তিনি বিশেষ বিমানে ইসলামাবাদ চলে যান। এখানকার গভর্নর যিনি ছিলেন তাঁকে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব দিয়ে যান। তিনি চলে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর, রাত সাড়ে ১১টায় এই সামরিক অভিযান শুরু হয়। 

পরে আমরা জেনেছি, এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল– যারা শেখ মুজিবের পক্ষে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে; তাদের আক্রমণ ও হত্যা করা। এখানকার সামরিক সরকার সেই অভিযান পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালানো হয়। সাতজন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তন্মধ্যে যাদের নাম স্মৃতিতে আসছে– ছিলেন ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরিসংখ্যান বিভাগের মনিরুজ্জামান। একই সঙ্গে আলাদা ট্রুপে বিভক্ত হয়ে সামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলে অভিযান চালিয়েছে। ফজলুল হক হল, ঢাকা হল (এখন শহীদুল্লাহ্ হল), সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলে ৪০ জন ছাত্রকে পেয়েছিল। সেই ৪০ জনকেই মেরে ফেলে। আরও দুয়েকজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন, তাদেরও মেরে ফেলে। দুটো মেয়েদের হল ছিল– রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল। এসব জায়গাতেও মিলিটারিরা গেছে, কিন্তু কেউই ছিল না। ছাত্রীরা আত্মরক্ষার্থে আগেই হল ছেড়েছিল। আত্মীয়স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠেছিল। বহু মানুষ, আমরাও তখন ‍পুরান ঢাকায় গিয়ে স্বজন, সুহৃদদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। যাদের সুযোগ ছিল তারা গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। 

প্রান্তিক অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখন পুরোনো হয়ে গেলেও তখন কমলাপুর রেলস্টেশন নতুন ছিল; সুন্দর দেখাত। রেললাইনের দু’পাশের কিছু অংশের জমি সরকারি। ওই জায়গার ভেতর প্রচুর বস্তি তৈরি হতো। মিলিটারিরা রেললাইনের দু’পাশের বস্তিতে অগণিত শ্রমজীবী, দিনমজুর ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করে।  রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রেলওয়ে এলাকা, সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠান– সর্বত্র চলে নিধনযজ্ঞ। আমার মনে হয়েছে, এই নিধনযজ্ঞের পেছনের মনস্তত্ব জানতে আমাদের ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কালে যেতে হবে। পরবর্তী সময়ে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ঠিকই, কিন্তু অনেক সংকট রয়ে যায়। সেসব সংকটের হাত ধরে ক্রমশ দেশভাগ, দেশভাগের অগ্র ও পশ্চাৎ-সহিংসতা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মানসিকতা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। 
আমাদের দেশে বড় নেতাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে, ভালো-মন্দে মিলিয়ে নির্মোহ গবেষণা হয়নি। এটা হওয়া দরকার। ইতিহাসের কোন অংশটি, কাকে, কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে, কেমন প্রভাবিত করেছে; বিশ শতকের বিভিন্ন বাঁকে রাজনৈতিক আবহ বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণে কোন চিন্তা, দর্শন কোন বলয়ে অলক্ষ্যে কী ভূমিকা রেখেছে; কেন ২৫ মার্চ রাত্রিতে সহিংসতার কিছু পূর্বানুমানের পরও পাকিস্তান কিংবা স্বদেশনীতির প্রশ্নে আমাদের বড় নেতাদের ভেতর দ্বিমত উপস্থিত হলো– বিশ্লেষণ করা দরকার। আমাদের অতীতের স্বাধীনতা অর্জনের অনেক অনালোকিত দিক উন্মোচন ও ভবিষ্যতের স্বাধীনতা রক্ষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বসিদ্ধান্ত গ্রহণে তা সহায়ক হবে।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন ইসল ম আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

পুলিশের কাছ থেকে ছাত্রলীগ নেতা ‘ছিনতাই’, গ্রেপ্তার ৪

বড়লেখায় রাজনৈতিক মামলার আসামি এক ছাত্রলীগ নেতাকে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ কাজে তাঁর স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

শনিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার কলাজুরা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরই পুলিশ অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন– উপজেলা কলাজুরা গ্রামের তাজুল ইসলাম, জামিল আহমদ, গৌরধন সিংহ ও মুরাদ আহমদ। স্থানীয়দের অভিযোগ, মূল অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করে পুলিশ নিরীহ তিন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে।

এ ঘটনায় শনিবার রাতেই বড়লেখা থানার এসআই দেবল চন্দ্র সরকার বাদী হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

থানা পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার কলাজুরা গ্রামের বাসিন্দা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজির উদ্দিনের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মাসুম আহমদ হাসানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা রয়েছে।

শনিবার রাতে বড়লেখা থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই তৌহিদুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ কলাজুরা বাজারে অভিযান চালিয়ে মাসুমকে গ্রেপ্তার করে। পরে গাড়িতে তোলার সময় স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে তাঁকে ছিনিয়ে নেন। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা মাসুম পালিয়ে যান। পরে বড়লেখা থানার ওসি আবুল কাশেম সরকারসহ অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

মামলার বাদী বড়লেখা থানার এসআই দেবল চন্দ্র সরকার রোববার দুপুরে জানান, ছাত্রলীগ নেতা মাসুমকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয় এবং আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

বড়লেখা থানার ওসি আবুল কাশেম সরকার জানান, রোববার বিকেলে গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখার বিষয়টি মানব সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত
  • মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আর নেই
  • মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আহমদ বাদাওয়ি মারা গেছেন
  • আওয়ামী রাজনীতির মৃত্যু ঢাকায়, দাফন দিল্লিতে: সালাহ উদ্দিন
  • জাতি এবার হিন্দুত্ববাদ প্রভাবমুক্ত বাঙলা নববর্ষ উদযাপন করল: ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ
  • নারায়ণগঞ্জে খেলাফত মজলিস ফিলিস্তিন-বাংলাদেশ সংহতি সমাবেশ
  • বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে বর্ষবরণ
  • নববর্ষের ঐতিহ্যকে একটি গোষ্ঠী কুক্ষিগত করে রেখেছিল: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
  • অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম আর নেই
  • পুলিশের কাছ থেকে ছাত্রলীগ নেতা ‘ছিনতাই’, গ্রেপ্তার ৪