গকসু নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক, বয়কটের ডাক
Published: 25th, March 2025 GMT
দীর্ঘ ৭ বছরের স্থবিরতা কাটিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন করতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক।
জানা গেছে, গকসু নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে কমিশনের সদস্যদের তালিকা প্রকাশের পরপরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে তীব্র সমালোচনার ঝড়। শিক্ষার্থীরা এ কমিশন বয়কটের আল্টিমেটামও দিয়েছেন।
গত রবিবার (২৩ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো.
সংশ্লিষ্ট নোটিশটি প্রকাশের পর থেকেই ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস অনুষদসহ সব বিভাগের শিক্ষক প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ভেটেরিনারি অনুষদসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা বলেছেন, কিছু মুখ নিয়মিত নীতি-নির্ধারণী পদে প্রাধান্য পেলেও ভেটেরিনারি অনুষদ বরাবরই অবহেলিত। এছাড়াও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা আগামী এক কর্মদিবসের মধ্যে কমিশনে তাদের অনুষদের একজন শিক্ষক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত না করলে আসন্ন গকসু নির্বাচন বয়কট করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাজেদ সালাফি বলেন, “প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবির ভেটেরিনারি অনুষদ অন্যতম হলেও এ অনুষদ এবং শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের অবহেলার শিকার। যোগ্যতা ও পরিশ্রমের বিচারে সবার আগে থাকার কথা থাকলেও যেকোনো কর্মসূচিতে আমাদের পিছিয়ে রাখা হয়। একটি চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর কারণে পুরো অনুষদ জিম্মি হয়ে আছে, শিক্ষার্থীরা হিংসার শিকার হচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী এক কর্মদিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে আমাদের অনুষদের শিক্ষক নিযুক্তসহ তালিকা সংশোধন না করা হলে আমরা অনুষদের শিক্ষার্থীরা আসন্ন গকসু নির্বাচন বয়কট করতে পিছপা হব না।”
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম বলেন, “নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসনের উচিত ছিল প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা। প্রতিটি বিভাগ থেকে শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে নির্বাচন আরো স্বচ্ছ হবে। তবে তা সম্ভব না হলে, অন্তত প্রতিটি অনুষদ থেকে একজন করে শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত করে কমিশন গঠন করা উচিত। ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষক না থাকা সত্যিই বিস্ময়কর।”
নবীন শিক্ষকদের কমিশনের তালিকায় নাম না থাকায় সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী আবির আহম্মেদ বলেন, “আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা চান, দেশ সংস্কারে যেমন নবীনরা নেতৃত্ব দিয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিগুলোতেও নবীন শিক্ষকরা নেতৃত্বে আসুক। কোনো শিক্ষককে একাধিক কমিটিতে না রেখে নবীব শিক্ষকদের নেতৃত্বে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হোক। নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের পাশাপাশি কয়েকজন নবীন শিক্ষকেও দায়িত্বে রাখা জরুরি।”
এ বিষয়ে গকসু উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. জহিরুল ইসলাম খান বলেন, “এখানে বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপককে প্রাধান্য দিয়ে কমিটি করা হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গকসুর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, “গকসু নির্বাচন কমিশন সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্র (২০২২) অনুযায়ী উপদেষ্টা পরিষদের সম্মতিক্রমে গঠন করা হয়েছে। এ নির্বাচন কমিশন কোনো বিভাগ অনুযায়ী তালিকা করা হয়নি।”
ঢাকা/সানজিদা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
রাতে শুনি ‘গেম ওভার’, সকালে শুনি কী
শেক্সপিয়ারের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকের একটি চরিত্র হলো ‘গুজব’।
সেখানে গুজব নিজের সম্পর্কে বলে, ‘হাওয়া আমার ঘোড়া, হাওয়াই ঘোড়ায় চড়ে পুবের আকাশ থেকে আমি পশ্চিমেতে যাই। সব ঘটনা, সব রটনা ছড়িয়ে দিই তাবৎ বিশ্বময়। মিথ্যা-বিষে পূর্ণ করি সব মানুষের কান।’
আজকের দিনে গুজব হাওয়াই ঘোড়া থেকে নেমে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ নামের ঘোড়ায় চেপেছে। সে ঘোড়া আরও জোরে ছোটে।
তবে কিনা এই ভাটির দেশে খাঁটি গুজব বলে কিছু নেই; এখানে সব গুজবেই সত্যের মিশেল থাকে। এখানে হিউমারাসলি সব রিউমারই ফ্যাক্ট।
এখানে যা রটে, তার অনেকটাই ঘটে। সে কারণে এখানে শুধু মানুষের ওপর নয়, গুজবের ওপরও বিশ্বাস হারানো পাপ।
কিন্তু সাত-আট মাস ধরে কিছু লোক গুজব ছড়ানোর নামে দেশে যে গজবের পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে সত্যিকারের গুজবের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনসবখানে গুজব ও অপতথ্যের বিষ, প্রতিষেধক কোথায়৩০ জানুয়ারি ২০২৫কাল (২৩ মার্চ দিবাগত রাত) সারা রাত ছিল গুজবের রাত। রাতদুপুরে এক বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙল। সে বলল, ‘ঘটনা যা শুনলাম সত্যি নাকি? সকালে নাকি ইমার্জেন্সি দিচ্ছে? ঢাকা নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে?’
আমি আধা ঘুম আধা জাগরণের কণ্ঠে বললাম, ‘তোরে এই কথা “সোর্স চালাই দেন” বলল?’
সে বলল, ‘না, খুবই রিলায়েবল সোর্স জানাইছে। ঘটনা সত্য।’
রাত দুইটায় ঘুমের বারোটা বাজল। ফেসবুকে ঢুকলাম। দেখলাম, আওয়ামী সমর্থক এক বন্ধু লিখেছেন, ‘গেম ওভার!’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’; একজন লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’; একজন লিখেছেন, ‘এই সরকারের সব কয়টার হিসাব নেওয়া হবে’।
একজন আবার আনন্দের চোটে আবেগ দমন করতে না পেরে এমন অশ্রাব্য ভাষায় সম্ভাব্য ‘বিজয়’কে উদ্যাপন করেছেন, যা এখানে উল্লেখ করাটা ঠিক হবে না।
আরও পড়ুনকানে গুজব, হাতে আইন২৩ জুলাই ২০১৯৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক আছেন, এমন এক বন্ধু লিখেছেন, ‘একটাকেও পালাতে দেওয়া হবে না। সকালে সবাই এয়ারপোর্টে যান।’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘ইনশা আল্লাহ ভাই, জয় বাংলা!’; একজন লিখেছেন, ‘ভোরেই বিমানবন্দরে থাকব ভাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
একজন লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত সকালেই সুখবর আসছে!’; একজন ছাত্র-জনতা আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘সুরা-কালাম যা পড়ার পড়ে নে, সময় শেষ!’
একজন লিখেছেন, ‘কাল সকালে ঢাকা শহরের মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যাবে। সকাল দশটার আগে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে রাখেন।’
সরকারি কিছু নথিপত্র এবং চিঠিজাতীয় কাগজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে একজন আবার জানিয়ে দিয়েছেন, আজ ২৪ মার্চই অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ দিন। সেই স্ট্যাটাস কয়েক শ জন শেয়ার করেছেন।
আরও পড়ুন১৩ তারিখ গেল, বাংলাদেশে তো কিছু ওল্টাল না!১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন হোয়াটসঅ্যাপে ভারতের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র একটি খবরের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং, ‘থমথমে ঢাকা, ইউনূস উচ্ছেদ ও সেনাশাসন চেয়ে মিছিল’।
আরেকজন ভারতের আরেকটি নিউজ পোর্টালের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং—‘গৃহযুদ্ধে গোটা বাংলাদেশ; হাসিনাকে ঢোকাতে আর্মি নামালেন সেনাপ্রধান ওয়াকার।’
কেউ কেউ আবার সকাল হওয়ার পর কয়টা কত মিনিটে কোন কর্মকর্তা কী ঘোষণা দেবেন, ঠিক কয়টায় কী ঘটনা ঘটবে, সুনির্দিষ্ট করে তা ঘণ্টা–মিনিট উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন।
আগের দিন হলে এসব দেখার পর উদ্বেগে-চিন্তায় ঘুম আসত না। কাল রাতেও ঘুম আসেনি। তবে উদ্বেগে বা চিন্তায় না; ঘুম আসেনি মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণে।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়। কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?মেজাজ খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে গুজব ছড়ানোরও তো একটা আদবকায়দা আছে; একটা ‘গোল্ডেন রুল’ আছে। এরা তো সেই নিয়ম কানুনের ধারেকাছেই থাকছে না।
পাবলিক যাতে গুজবটা গেলে, তার জন্য মিনিমাম ‘ফ্যাক্ট’ তো মেশাতে হবে!
কয়দিন পরপর নিঝুম রাতে শিয়ালের মতো কেউ একজন ‘গেম ওভার, কেউ যেন পালাতে না পারে’ মার্কা হুক্কা হুয়া দিচ্ছে। বাদ বাকিরা ‘হুয়া হুয়া’ বলে ‘ধুয়া’ দিচ্ছে।
পরে যখন সকাল হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে, নিঝুম রাত উধাও, শিয়ালের হুক্কা হুয়াও নেই।
ফেসবুকভিত্তিক এই গুজবগুলো সাধারণত সূক্ষ্মভাবে একটি পক্ষকে লক্ষ্য করে রাতে ছড়ানো হয়। তখন সেই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল জোশ আসে।
এটা অনেকটা এনার্জি ড্রিংকের মতো কাজ করে। গুজব-জুসের পীযূষ পান করে হুঁশ হারিয়ে তাঁরা বিপুল বিক্রমে রাজা-উজির মেরে ফেলেন।
অমুকের পতন আর তমুকের প্রত্যাবর্তনে তাঁরা দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়ে সমানে স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।
পরে যখন সকাল হয়; পরে যখন ‘ঘটনা ঘটার’ সময় পার হয়ে যায়, তখন জুসের ঘোর কাটে। তাঁরা তখন বেহুঁশ থেকে হুঁশে আসা শুরু করেন।
আবার কয়েক দিন পর নতুন করে নতুন এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানো হয়। আবার ভাঙা মন চাঙা করা হয়।
কিন্তু বারবার একই জিনিস একই কায়দায় খাওয়ানোর কারণে নেতা-কর্মীরা আর আগের মতো চাঙা হচ্ছেন না।
গুজবমতো পাশের দেশ থেকে কেউ চট করে ঢুকে পড়ছেন না বা অবস্থা জরুরির দখলে যাচ্ছে না দেখে তাঁদের অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন।
ইন্টারনেট আসার আগে হুইসপারিং ক্যাম্পেইনের চল ছিল। ‘ওয়ার্ডস অব মাউথ’ বা মুখে মুখে ফিসফাস করে গুজব ছড়ানোর ধারা ছিল।
ফেসবুক সেই ধারায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন কারেন্টের গতিতে ভুয়া খবর ভাইরাল হয়ে তা খবরের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে।
ঘটনা সত্যি নাকি ভুয়া, তা যাচাই করার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই বেশির ভাগ মানুষের থাকছে না।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়।
কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?
দুই দিন পর পর গুজবসেবীরা রাতভর গুজব ছড়াচ্ছেন, আর রাজনীতি সচেতন বন্ধুরা ফোন করে ‘ঘটনা সত্যি নাকি?’ বলে কাঁচাঘুম ভাঙাচ্ছেন, ব্যাপারটা কি ভালো হচ্ছে?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]