ডামি রাইফেলগুলো ছুঁয়ে শিশুরা এক ভিন্ন শিহরণ অনুভব করে। পাশে সাইক্লোস্টাইল যন্ত্র, মর্টার শেল—এগুলোও ভিন্ন আবেগ-অনুভূতি তৈরি করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারকের প্রদর্শনী। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যার দলিল, আলোকচিত্র ও তথ্যভিত্তিক নানা কিছু প্রদর্শন করা হচ্ছে। আয়োজন করা হয়েছে শিশুদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।

নগরের সদর রোডের বিবির পুকুরের পূর্ব পাড়ে রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ের মিলনায়তনে এই প্রদর্শনী দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন তরুণ–যুবকেরা। তাঁরা সেখানে এসব ছুঁয়ে দেখেছেন, আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। দুপুরে প্রদর্শনী দেখতে ও চিত্রাঙ্কনে অংশ নিতে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন নাসরিন নাহার নামের এক নারী। তিনি বললেন, ‘একসঙ্গে এখানে বরিশাল বিভাগের গণহত্যাস্থল ও বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। এটি আর অন্য কোথাও আমরা দেখিনি, এই প্রদর্শনী সবখানে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।’

শিশু এবং এই প্রজন্মের তরুণেরা প্রদর্শনীতে এসে তাঁদের আবেগ-অনুভূতির কথা প্রথম আলোকে জানান। প্রদর্শিত ডামি রাইফেল, সাইক্লোস্টাইল যন্ত্র ছুঁয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছিল দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী অতনু। প্রদর্শনীতে আসা খুদে শিক্ষার্থী সাইফান ইসলাম বলে, ‘‌মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার এত ছবি একত্রে আমি আগে কখনো দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধে এমন বর্বরতা হয়েছে, এসব ছবি না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।’

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৬ মার্চ বরিশাল শহরের বগুড়া সড়কে বর্তমান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম স্বাধীনবাংলা সচিবালয়। এখান থেকেই পরিচালিত হয় এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। এই সচিবালয়ের আদেশ-নির্দেশগুলো প্রিন্ট করা হতো তৎকালীন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একমাত্র সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি দিয়ে। ঐতিহাসিক নিদর্শন সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি ১৫ বছর ধরে সংরক্ষণ করছে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি।

গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বরিশালে তিন দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারকের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। সেখানে আয়োজন করা হয়েছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। গতকাল বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ট র স ইউন ট প রদর শ গণহত য বর শ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ভয় শব্দ দিয়ে গাজার পরিস্থিতি তুলে ধরা যায় না

গত সপ্তাহে আরেকটি ভয়াবহ রাত গেল। প্রায় চার বছর বয়সী আমার এক ভাতিজি একটি প্রশ্ন করেছিল, যা আমি কখনও ভুলব না। ‘যদি আমরা ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যাই... তাহলেও কি ব্যথা হবে?’ আমি বুঝতে পারছিলাম না এ প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায়। তুমি কীভাবে একটা শিশুর মুখোমুখি হবে, যেখানে ঘুমের মধ্যে মৃত্যুবরণ করাটা এক ধরনের দয়া? যে শিশু দিনের আলোর চেয়ে বেশি মৃত্যু দেখেছে। 
তাই আমি তাকে বললাম, ‘না। আমার মনে হয় না। তাই আমাদের এখন ঘুমিয়ে পড়া উচিত।’ সে চুপচাপ মাথা নাড়ল এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে আমার কথা বিশ্বাস করল। তার চোখ বন্ধ করলো। আমি অন্ধকারে বসেছিলাম, আর বোমার শব্দ আমার কানে বাজছিল। ভাবছিলাম রাস্তার ধারে কত শিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে।

আমার ১২ জন ভাতিজা-ভাতিজি। সবার বয়স ৯ বছরের কম। এই অন্ধকার সময়ে তারা আমার সান্ত্বনা এবং আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাবা-মায়ের মতো আমিও চারপাশে কী ঘটছে তা বুঝতে তাদের সাহায্য করার জন্য সংগ্রাম করি। তাদের কাছে আমাদের অনেকবার মিথ্যা বলতে হয়েছে। তারা প্রায়ই আমাদের বিশ্বাস করত, কিন্তু কখনও কখনও তারা আমাদের কণ্ঠস্বর বা আমাদের দৃষ্টিতে অনুভব করত যে, ভয়ংকর কিছু ঘটছে। তারা বাতাসে ভয়াবহতা অনুভব করত।

কোনো শিশুকে কখনও এমন বর্বরতার মুখোমুখি করা উচিত নয়। কোনো বাবা-মায়েরই হতাশায় কাতর হওয়া উচিত নয়। কারণ, তারা জানে, তারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারবে না। গত মাসে যুদ্ধবিরতি শেষ হয় এবং সেই সঙ্গে বিরতির মায়াও দেখা দেয়। এরপর যা ঘটল, তা কেবল যুদ্ধের পুনরায় শুরু বলা যায় না। বরং এটি ছিল আরও নৃশংস ও নির্মম। 
তিন সপ্তাহের ব্যবধানে গাজা আগুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে কেউ নিরাপদ নয়। ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি পুরুষ, নারী ও শিশু হত্যা করা হয়েছে। প্রতিদিনের গণহত্যা আমাদের আশার আলো ভেঙে দিয়েছে। কেবল মানসিকভাবে নয়। শারীরিকভাবেও। এর মধ্যে কিছু বাড়িতে হামলা হয়েছে। গতকালের কথাই বলা যাক। কয়েকটি রাস্তা বাতাসের ধুলোয় ভরে গিয়েছিল এবং রক্তের গন্ধ ভেসে আসছিল। ইসরায়েলি বাহিনী গাজা শহরের আল-নাখিল স্ট্রিটকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল, যার মধ্যে পাঁচ শিশুসহ ১১ জন নিহত হয়।

কয়েকদিন আগে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর আশ্রয়স্থল দার আল-আরকাম স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলো ইসরায়েলি বিমান হামলায় ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়, যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তারা নিরাপত্তার খোঁজে সেখানে এসেছিল। তারা ভেবেছিল, নীল জাতিসংঘের পতাকা তাদের রক্ষা করবে। তা হয়নি। আমার বাড়ি থেকে স্কুলটির দূরত্ব ১০ মিনিটেরও কম।
একই দিনে নিকটবর্তী ফাহাদ স্কুলেও বোমাবর্ষণ করা হয়। এতে তিনজন নিহত হয়। এক দিন আগে জাবালিয়ার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায়। ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত বেসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়স্থল এক ক্লিনিকেও ইসরায়েলিরা হামলা চালিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ক্লিনিকজুড়ে দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে পড়েছে। শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এমনকি এক শিশুর শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। পোড়া মাংসের গন্ধে বেঁচে যাওয়াদের শ্বাসরোধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছিল সুপরিকল্পিত গণহত্যা, যেখানে তারা বেঁচে যাবে, তবে শান্তি পাবে না। এসব কিছুর মধ্যে গাজা শহরের কিছু অংশ সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সরিয়ে নিন। কিন্তু কোথায় সরাবে? গাজায় কোনো নিরাপদ অঞ্চল নেই। উত্তরাঞ্চল সমতল এবং দক্ষিণে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।
সমুদ্র একটা কারাগার। রাস্তাঘাট হলো মৃত্যুফাঁদ। আমরা এখান থেকে সরে যাইনি। এ কারণে নয় যে, আমরা সাহসী। কারণ আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। গাজায় আমরা যা অনুভব করি তা বর্ণনা করার জন্য ভয় সঠিক শব্দ নয়। ভয় অতিক্রম করা যায়। 

আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর ও নীরব আতঙ্ক অনুভব করি, যা আপনার বুকের ভেতরে চেপে থাকে এবং কখনও চলে যায় না। এটি একটি ক্ষেপণাস্ত্রের বাঁশি এবং আঘাতের মধ্যবর্তী মুহূর্ত, যখন আপনি 
কিছু একটা ভাবছেন তখনই আপনার হৃদযন্ত্র থমকে গেল। এটি ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে শিশুদের কান্নার শব্দ। বাতাসের সঙ্গে রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
আমার ভাতিজি এ প্রশ্নটিই জিজ্ঞাসা করেছিল। বিদেশি সরকার ও রাজনীতিবিদেরা এটিকে ‘সংঘাত’ বলে। একটি ‘জটিল পরিস্থিতি’। একটি ‘ট্র্যাজেডি’ কিন্তু আমরা যা পার করছি তা জটিল নয়।
এটি সরাসরি একটি গণহত্যা। আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি, তা কোনো ট্র্যাজেডি নয়। এটি একটা যুদ্ধাপরাধ। আমি একজন লেখক। একজন সাংবাদিক। আমি কয়েক মাস ধরে লিখেছি, তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমার কথার মাধ্যমে বিশ্বকে আহ্বান জানিয়েছি। আমি বার্তা পাঠিয়েছি। আমি এমন গল্প বলেছি, যা অন্য কেউ বলতে পারেনি। তবুও প্রায়ই আমার মনে হয় আমি শূন্যে চিৎকার করছি।

নূর এলাসি: কবি ও লেখক; আলজাজিরা থেকে 
ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফেনীতে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে মানুষের ঢল
  • জুলাই আন্দোলনে গুলির নির্দেশ: সহকারী কমিশনার ও অতিরিক্ত এসপি গ্রেপ্তার
  • ট্রাইব্যুনালের মামলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অনির্বান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার
  • ‘মার্চ ফর গাজা’ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঐক্য: সারজিস
  • দেলপাড়া গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ
  • ঢাকা জনসমুদ্র, গণহত্যার প্রতিবাদ
  • গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাজধানীতে জনতার ঢল
  • গণহত্যার প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশ
  • ভয় শব্দ দিয়ে গাজার পরিস্থিতি তুলে ধরা যায় না
  • গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন দাবি