গণতন্ত্রবিনাশী শক্তির চক্রান্ত থেমে নেই: তারেক রহমান
Published: 25th, March 2025 GMT
গণতন্ত্রবিনাশী শক্তির চক্রান্ত এখনও থেমে নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, একটি শোষণ, বঞ্চনাহীন, মানবিক সাম্যের উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দেশের মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু বারবার ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী ও অবৈধ শক্তি আমাদের সে লক্ষ্য পূরণ করতে দেয়নি। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফলে আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হোঁচট খেয়েছে এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার এক বাণীতে এসব কথা বলেন তারেক রহমান।
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। হাজার বছরের সংগ্রামমুখর এ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
তারেক রহমান বলেন, জিয়াউর রহমানকে চক্রান্তমূলকভাবে হত্যার পর খালেদা জিয়ার সফল ও সার্থক নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ধারা সূচিত হলেও, গণতন্ত্রের শত্রুদের কারণে স্থায়ী ও মজবুত গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি সম্ভব হয়নি। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার হীন লক্ষ্যে পলাতক অবৈধ সরকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আজও তাই দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের পর এখন সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলা নিশ্চিত করা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সংহত করা। এটিই হচ্ছে স্বাধীনতার মূল চেতনা। জাতির সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বহুমত ও পথের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত র ক রহম ন র জন ত ত র ক রহম ন গণত ন ত র ক গণতন ত র স ব ধ নত র গণত
এছাড়াও পড়ুন:
একাত্তরই জাতির পথনির্দেশক
মুক্তিযুদ্ধ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এটি পূর্বাপর কোনো ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সব আমলেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের বয়ানগুলো পক্ষপাতদুষ্ট। যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, তখন তাদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে।
স্বাধীনতার পর বেতার-টেলিভিশন খুললে মনে হতো, মুক্তিযুদ্ধ যেন আওয়ামী লীগের একার যুদ্ধ ছিল। তখন বেতার-টেলিভিশন-রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অন্য দল ও ব্যক্তির ভূমিকা স্থান পেত না। অথচ অন্যান্য দলও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল। ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফ্ফর), কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) ও মনোরঞ্জন ধরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মণি সিংহ ও মনোরঞ্জন ধর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এর বাইরে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিসহ আরও বেশ কিছু বাম সংগঠন মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে একটি র্যাডিক্যাল ধারা ছিল, যারা স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে নতুন দল জাসদ গড়ল; তখন তাদের অবদানও উল্লেখ করা হতো না। তাজউদ্দীন আহমদ যেদিন মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে মন্ত্রিত্ব হারালেন, সেদিনই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা মুছে গেল!
একাত্তরে বাঙালি অফিসার ও সিপাহিরা সেনা ছাউনি থেকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা করেছিল। তারাই ছিল রণাঙ্গনের মূল শক্তি। স্বাধীনতা-উত্তর তাদের কথাও বেতার-টেলিভিশন বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শোনা যেত না।
একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে সৈনিক-ছাত্র-জনতা অস্ত্র তুলে ধরেছিল। কৃষকের পর্ণ কুটির পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। লাখ লাখ নরনারী-শিশু প্রাণ দিয়েছিল; অগণিত নারী ধর্ষণের নির্মম শিকার হয়েছিল; এক কোটি লোক উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল; অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যার কেউ হিসাব রাখেনি। তবে আন্দাজ করা যায়, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের চেয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা দুই/তিন গুণ। জনগণের এই গৌরবময় ভূমিকা সব আমলেই উপেক্ষিত।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে অবস্থা বদলে গেল। বেতার-টেলিভিশন-রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের কথা ঘটা করেই প্রচার হতে লাগল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে রাজনৈতিক যুদ্ধ; দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল– সেই ইতিহাস চাপা পড়ে গেল। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ কারও নাম উচ্চারিত হতো না। উচ্চারিত হতো না মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথাও। মনে হতো, মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেন কেবলই সামরিক যুদ্ধ।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকে দেশে নানা কারণে ভারত-বিদ্বেষ বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে হোক বা অন্য কারণে; মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অবদানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হতো। এখনও হয়। এটি অর্থহীন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের এক শ্রেণির জেনারেল-সাংবাদিক-লেখকের ভূমিকাও অগ্রহণযোগ্য। তারা বিস্মৃত হয়েছেন– ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নিয়েছিল। এসব জেনারেল-সাংবাদিক-লেখক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলছেন। তারা এও বলছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আসলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় বাহিনী) সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল; ভারতীয় বাহিনীর কাছে নয়। এ অপতথ্যের প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সর্বদাই উদাসীন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা অপতথ্যের সুযোগ নিয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেছিল। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট প্রভৃতি অপকর্মে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। তাদের অন্যতম জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে এখনও বহাল তবিয়তে। দলটি কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপির সঙ্গে মিলে শক্তি সঞ্চয় করেছে। বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও তারা অতীতে তা আমলে নেয়নি, এখনও নিচ্ছে না। জামায়াত শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল। সেই সুবাদে নিজেদের এখন দেশপ্রেমিক বলে পরিচয় দিচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়াচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপতথ্য-অপপ্রচারে তরুণ প্রজন্মের কোনো কোনো অংশ বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির পেছনে শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসন বড় ফ্যাক্টর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় ও পারিবারিকীকরণ করেছিলেন। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা তারস্বরে চিৎকার করে যা বলতেন, তার মর্মকথা এই– ‘স্বাধীনতা এনেছেন বঙ্গবন্ধু। আর দেশ চালাবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।’ নির্বাচন, গণতন্ত্র কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালে ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করেছে। এসব অপকর্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের নামে। তাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ উগরে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরালের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারক হয়েছিল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার লক্ষ্যবস্তু। এসব ধ্বংসযজ্ঞের নেপথ্যে হয়তো স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত ছিল; সেই সঙ্গে ছিল জন-আক্রোশ।
এটি দুঃখজনক যে, অন্তর্বর্তী সরকারও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুল রাজনীতিতে পা দিয়েছে। গত ২২ মার্চ সমকালে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী চারশ রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না। তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। সমকালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১০ মার্চ কার্যপত্রে (খসড়াসহ অন্যান্য বিষয়) স্বাক্ষর করেছেন। এখন এটি নাকি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার না জানার কথা নয়– মুক্তিযুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক যুদ্ধ। রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানকারী নেতারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। কী হাস্যকর ব্যাপার!
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ‘স্বাধীনতা পেয়েছি’ বলে বক্তব্য শুনেছি। তখন মনে হয়েছিল, বিষয়টি আবেগতাড়িত। পরে যখন দ্বিতীয় রিপাবলিকের বক্তব্য শুনলাম; দাবি উঠল দ্বিতীয় রিপাবলিকের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য, তখন এটি আবেগের ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রশ্ন জাগে, এর পেছনে অন্য কোনো রাজনীতি আছে কিনা!
মুক্তিযুদ্ধের ফসল ১৯৭২ সালের সংবিধান। এর মানে এই নয় যে, সংবিধানটি একশ ভাগ নির্ভুল। তা ছাড়া স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সংবিধান অনেক সংশোধনীর কাঁচিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিছু অগণতান্ত্রিক বিধি-বিধান যুক্ত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পথে বাধা। তাই বিগত ১৫ বছর এবং তারও আগে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দাবি রয়েছে– সংবিধান সংশোধন করতে হবে; সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। বলা বাহুল্য, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেশ পরিচালনার মূলনীতি বাতিলের দাবি করা হয়নি; কখনও কোনো রাজনীতিকের মনে দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের চিন্তাও উদয় হয়নি। অথচ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে প্রজাতন্ত্রের নাম ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার কথা বলা হয়েছে। তবে ওই প্রস্তাব অনুসারে ইংরেজিতে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ পরিবর্তন হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) স্থলে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রস্তাবিত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের’ বিরোধ নেই। বরং সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত।
ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের সুপারিশ করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা হয়েছে। প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ ৫.২-এ বলা হয়েছে– ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহু জাতি, বহু ধর্মী, বহু ভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ; সেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদায় আসীন রেখে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়কে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?
বলা হচ্ছে, ‘দেশ পরিচালনার এই চার মূলনীতি নাকি আওয়ামী লীগের নীতি। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের উৎখাতের মধ্য দিয়ে চার মূলনীতির প্রতি অনাস্থা প্রকাশিত হয়েছে।’ এই চার মূলনীতির অন্যতম গণতন্ত্র নিয়ে কমিশনের আপত্তি নেই (কমিশন সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র সন্নিবেশিত রাখার সুপারিশ করেছে)। তাদের যত আপত্তি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে গণপরিষদের ভেতরের ও বাইরের কোনো দল প্রশ্ন তোলেনি। পাকিস্তানের ২৩ বছর ধরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম ছিল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের ঘোষণায় ছিল শোষণমুক্তি ও সমাজতন্ত্র। তারই প্রতিফলন ষাটের দশকের সেই হৃদয়মথিত ধ্বনি– কেউ খাবে, কেউ খাবে না/ তা হবে না, তা হবে না; মুক্তির একই মন্ত্র/ সমাজতন্ত্র সমাজতন্ত্র। শুরুতে আওয়ামী লীগ এ ধ্বনি তোলেনি। বামরা তুলেছিল; আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা কণ্ঠ মিলিয়েছিল। এ দাবি বুকে ধারণ করেই একাত্তরের তরুণ-অরুণেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল; জীবন উৎসর্গ করেছিল। সেই রক্তে-লেখা জাতীয় দাবি মুছে ফেলা কি এত সহজ!
বিগত শতাব্দীর চল্লিশ দশকজুড়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ছিল; রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৪৭-উত্তর পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের কাফেলায় শরিক হয়েছিল। রাজপথে একযোগে আওয়াজ তুলেছিল– ধর্মের নামে শাসন করা চলবে না; ধর্মের নামে শোষণ করা চলবে না। এ ধ্বনির মর্মবাণী অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। একাত্তরে মানুষের যেমন আরাধ্য ছিল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তেমনি আরাধ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র; ধর্মরাষ্ট্র নয়। আন্দোলনের ফসল হিসেবেই ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র সংবিধানে এসেছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
ভাষা থেকেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি, যা ছিল মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে তা বহু ধর্ম ও জাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি করা উচিত কিনা– এ নিয়ে ১৯৭২ সালেই মতদ্বৈধতা ছিল। গণপরিষদ অধিবেশনে জাতীয় পরিচয় বাঙালি করার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি নই। আমাদের বাপ-দাদা কখনও বলেন নাই যে, আমরা বাঙালি।’ তিনি বাংলাদেশি পরিচয়ের কথা তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তিযুক্ত। সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সত্য, তবে একাত্তরে মুক্তিসংগ্রাম কেবল বাঙালির সংগ্রাম থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশাপাশি গারো, সাঁওতাল, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খাসিয়া, মণিপুরিসহ এই জনপদের সব জাতিগোষ্ঠী যোগ দিয়েছিল। তাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ নেশন’ ধারণাই বিকশিত হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগত দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।
পরবর্তী সময়ে রাজনীতিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন ঘটেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬.২-এ রয়েছে– ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ এ অনুচ্ছেদে নাগরিক পরিচয়ের সমাধান মিলেছে। সমস্যা হয়ে আছে জাতি হিসেবে বাঙালি– এই একক পরিচয়টি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি ও আদিবাসী অথবা গারো, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরি, খাসিয়া প্রভৃতি জাতির নাম সংযুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে অনুচ্ছেদ ৯-এ জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যায়ও বাঙালির পাশাপাশি আদিবাসীর কথা উল্লেখ করাও সংগত। আদিবাসী জনগোষ্ঠীও অনুরূপ দাবি করে আসছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬.২ ও ৯ সংশোধনের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সুরাহা সম্ভব।
আমি মনে করি, দেশের সাংবিধানিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রাজনীতির আলোচিত ইস্যুর দিকেই নজর দেওয়া প্রয়োজন। সরকার ও সংসদের মেয়াদ চার বছর করা; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা; দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা; দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা; সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি; নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন; বিরোধী দল থেকে সংসদে ডেপুটি স্পিকার, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান করা ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা সংগত। এসব বিধিবিধান সংযোজন জাতীয় সংসদই করতে পারে। এ জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন নেই।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসৈনিক তরুণদের একাংশ সংবিধান বাতিল, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। তারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশপ্রেমের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, তা অনন্য। এই তরুণ তুর্কিদের নিয়ে আমরা গর্ব করি। তবে একাত্তর তারা দেখেনি; তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তির বর্বরোচিত ভূমিকাও প্রত্যক্ষ করেনি। তাই একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সতর্ক নয়। এ অপশক্তি একাত্তরের বদলা নিতে; মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন মুছে ফেলতে স্বাধীনতার পর থেকেই তৎপর। ১৯৭২ সালের সংবিধানসহ মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন, সব স্মারক ধ্বংস করা তাদের এজেন্ডা। তাই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী তরুণ বীরদের প্রতি আমার মিনতি– ‘তোমরা একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ো না; একাত্তরের আলোতে পথ চলো। এই পথেই তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।’
যে জাতি তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরব গাথা ধারণ করতে পারে না, সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। উজ্জ্বল আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের বারবার একাত্তরের কাছে ফিরে যেতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা ধারণ করেই পথ চলতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই।
আবু সাঈদ খান: মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল