ট্রাইব্যুনালের সামনে বিশৃঙ্খলার পেছনে উসকানি থাকতে পারে: চিফ প্রসিকিউটর
Published: 25th, March 2025 GMT
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে বিশৃঙ্খলা করলে তা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হবে বলে মন্তব্য করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটা (ট্রাইব্যুনালের সামনে বিশৃঙ্খলা) জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে—কোথাও ভালো চোখে দেখা হবে না। এর পেছনে বিশেষ মহলের উসকানি থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম এ কথাগুলো বলেন।
গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত বিচারের দাবিতে গতকাল সোমবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে বিক্ষোভ করেন জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামেরও পদত্যাগ দাবি করেন তাঁরা।
আজ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চিফ প্রসিকিউটর একজন আইনজীবী। চিফ প্রসিকিউটরের ক্ষমতা, দায়িত্ব আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা আছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যখন তদন্ত সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন দেবে, সেটার পর থেকে চিফ প্রসিকিউটরের কাজ শুরু হবে। তদন্ত করার কাজটা কমপ্লিটলি (সম্পূর্ণভাবে) তদন্ত সংস্থার ওপর। সে কারণে তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটর তাড়াতাড়ি করে মামলা হেয়ারিং (শুনানি) করতে পারেন না। যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁরা হয়তো না বুঝে করেছেন।’
প্রথমে তদন্ত শেষ হতে হবে, তারপর চিফ প্রসিকিউটরের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন আসবে, চিফ প্রসিকিউটর ওইটার ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক চার্জ (অভিযোগ) দাখিল করবেন, এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন আসার পরও চিফ প্রসিকিউটর কোনো কারণ ছাড়া সময় নিলে, মামলার শুনানি পিছিয়ে দিলে, তখন বলা যাবে তাঁদের (প্রসিকিউশন) দায় আছে।
জুলাই শহীদ পরিবারের আবেগ–অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, তাঁরা স্বজনদের হারিয়েছেন, দ্রুত বিচার চাইবেন, এতে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে এই বিচারটা আইনের একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে। এটা মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) না যে আমি বললাম আসামি ওমুক, তাঁকে ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলাম।’
তদন্তকাজ চার–পাঁচটা মামলার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে একটি খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন এসেছে, অন্যগুলো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, যাঁরা চিফ প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁরা না বুঝে বলছেন, অথবা কোনো একটা বিশেষ মহল তাঁদের উসকানি দিচ্ছে। যেহেতু এই শহীদ পরিবারদের আবেগ–অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ আছে, তাঁরা তাঁদের (শহীদ পরিবার) উসকিয়ে আদালতের সামনে নিয়ে এসেছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা (উসকানি দিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে আনা) উচিত হয়নি। কারণ, আদালতের সামনে মিছিল করলে আদালতে বিচার করা যায় না। এটা তদন্ত সংস্থা যদি কাজ না করে, সরকারের কাজে যদি ধীরগতি থাকে, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের সামনে এসে কোনো বিশৃঙ্খলা করাটা, এটা শোভনীয় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করব যে, এটা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার একটা প্রচেষ্টা হবে। এটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে—কোথাও এটা ভালো চোখে দেখা হবে না।’
শহীদ ও ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য ট্রাইব্যুনালের দরজা সব সময় খোলা বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গতকালের বিক্ষোভে দু–তিনটি শহীদ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে বাড়ি থেকে অনুরোধ করে এনে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন তাঁরা প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন।
শহীদ পরিবারের অনেকেই তদন্ত সংস্থার কাছে বক্তব্য দেন না, কোনো তথ্য–প্রমাণাদিও দেন না উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু বলবে, আসামিদের ফাঁসি দাও।’ ১৪০০ শহীদ পরিবারের মধ্যে এক–দেড় শ শহীদ পরিবারও ট্রাইব্যুনালের কাছে আসেনি বলে জানান তিনি।
ট্রাইব্যুনালের সামনে এ ধরনের শোডাউন প্রত্যাশিত নয় উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কারণ, আমরা সবাই মিলে একটা সঠিক বিচার করতে চাই। সেই বিচারটা যাতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সেরকম একটা বিচার করার জন্য সবারই সহযোগিতা প্রয়োজন। স্বজন হারানোর বেদনা যেমন সত্য, তেমনি বিচারটাকে সঠিক রাস্তায় নিতে হবে, এটাও সত্য।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: তদন ত স স থ ত কর র কর ছ ন অপর ধ উসক ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘সন্তানের উসিলায় আজীবন পহেলা বৈশাখ ভিন্নভাবে পালন করতে পারব’
বাড়ির পাশে মুরগির খামার। খামারে স্বামী মমিনুল ইসলামকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী রত্না বেগম। দীর্ঘ কয়েক মাস তিনি একাই চালিয়ে যাচ্ছেন খামারের সব কাজ। কারণ, রত্না বেগম এখন হাসপাতালের বেডে। রোববার মধ্য রাতে হঠাৎ প্রসব বেদনার যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না। স্বজনদের পরামর্শে বাধ্য হয়ে রাতেই তাঁকে রংপুর নগরীর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পহেলা বৈশাখ সকাল ৬টায় তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় পুত্রসন্তান। শিশুটির জন্মগ্রহণের খবরে চারদিক সরব হয়ে ওঠে। কিন্তু মমিনুলের মুখে হাসি নেই। কারণ তিনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন সন্তান সুস্থ থাকলেও প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী।
হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. ফারহানা ইসলাম জানান, অস্ত্রোপচার করতে হয়নি। স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে রত্নার। তিনি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। তাঁর শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। সন্তান সুস্থ-স্বাভাবিক রয়েছে, মায়ের দুধ পান করছে।’
‘পর পর দুটি কন্যাসন্তানের পর ছেলে হইল, আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করেছে। পহেলা বৈশাখ সকালে সন্তানের জন্ম হওয়ায় আমরা খুবই খুশি। সন্তানের উসিলায় আজীবন আমরা পহেলা বৈশাখ ভিন্নভাবে পালন করতে পারব।’ সন্তান কোলে তুলে আনন্দের এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের বাবা মমিনুল ইসলাম।
রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া গঞ্জিপুর গ্রামের বাসিন্দা মমিনুল ২০১২ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের রত্না বেগমকে পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে করেন। খেটে খাওয়া দম্পতির পর পর তাদের দুটি কন্যাসন্তান হয়। তৃতীয় সন্তানের আশায় প্রহর গুনছিলেন পরিবারের সবাই। যদিও অন্তঃসত্ত্বাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেননি তারা। জানতেন না সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিনক্ষণ। ভরসা করেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। তবে তারা মনে করেন সন্তান নেওয়ার আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এতে অনেক জটিলতা কমে আসে।
বাড়ির খামারের আয় দিয়েই মূলত পাঁচ সদস্যের সংসার চলে। ধর্মভীরু মা-ই তাদের দুই কন্যাসন্তানের নাম রেখেছেন। বড় মেয়ে জান্নাতুল মুনতাহার বয়স ১১ বছর। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাঁচ বছর বয়সের জান্নাতুল মাওয়া স্থানীয় মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করে মাত্র। তৃতীয় সন্তান এলো এবার। হিসাব অনুযায়ী এ মাসের যে কোনো সময় সন্তান প্রসব হতে পারে ধারণা ছিল এ দম্পতির। বাংলা নববর্ষের দিনই হবে এমন ধারণা ছিল না।
এটি শুভ লক্ষ্মণ উল্লেখ করে মমিনুল ইসলাম জানান, ভালো দিনেই ছেলের জন্ম হয়েছে। বাংলা বর্ষবরণে যেদিন বাঙালিরা তাদের প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে; এমন উৎসবের দিনে সন্তান জন্ম হওয়ায় তার জন্মদিন যেমন সহজে মনে থাকবে, তেমনি প্রতি বছর উৎসবের মধ্যেই জন্মদিন পালন হবে।
সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান মমিনুল। তিনি বলেন, ছেলেকে কুরআনের হাফেজ বানিয়ে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে জীবনে কত কষ্টই না করেন বাবা-মা। কিন্তু এক সময় বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়ার মতো সময় থাকে না ওই সন্তানের। সবকিছু থাকার পরও শেষ সময়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয় অনেক বাবা-মাকে। তাই সন্তানকে মানবিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে তৈরি করতে চাই।
তিনি আরও জানান, রোববার রাতে রত্না বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে ভাড়া করা গাড়িতে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানকার ডাক্তার-নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। প্রসবের ব্যবস্থা করেন। অবশেষে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। পহেলা বৈশাখ সকালে সন্তান জন্ম নিলেও কেউ আমাদের কোনো শুভেচ্ছা জানায়নি। দৈনিক সমকাল নবজাতকসহ আমাদের সন্তানকে ফুল দিয়ে বরণ করেছে, তা আজীবন মনে থাকবে।’
পহেলা বৈশাখ সকালে ওই হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, রত্না বেগম বেডে শুইয়ে থাকলেও মমিনুল ইসলাম ওয়ার্ডের মধ্যে সন্তানকে কোলে জড়িয়ে পায়চারি করছেন। নবজাতকের শরীরে তখন শুধুই টাওয়াল জড়ানো। তবে খবর পাওয়ার পর বাড়ি থেকে স্বজনরা এসে তাকে জামা পরিয়েছে। বাজার থেকে কিনে পহেলা বৈশাখের লাল টুকটুকে জামা পরাবেন বলে জানান মমিনুল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁর কোলেই প্রথম উঠেছে এই নবজাতক।
শিশুর নাম রেখেছেন মোহাম্মদ রাইয়ান। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন বলে জানান। মমিনুলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন কোনো কথা না বললেও হাসপাতালের বেডে শুইয়ে সন্তানের মা রত্না বেগম সবকিছু দেখছিলেন এবং শুনছিলেন। তাঁর কাঙ্ক্ষিত সন্তানকে বরণ করে নেওয়ায় যেন চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন তিনিও।
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে সন্তান ও মায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা করেন মমিনুল। আমার খামারের সঙ্গী এখন হাসপাতালে। তাকে সুস্থভাবে নিয়ে যেন দ্রুত হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারি এটাই এখন চাওয়া।