নারীর প্রতি সহানুভূতি, নাকি অনুভূতির রাজনীতি
Published: 25th, March 2025 GMT
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে সে ধরনের কিছু আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে অনেকটা তাড়াহুড়া করেই। ২০ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
২০২৫–এর অধ্যাদেশে ধারা ৯ (খ) নামের একটি নতুন ধারা সংযোজনের মাধ্যমে বলা হয়েছে, প্রণয়ের সম্পর্ক থাকাকালে বিয়ের প্রলোভন বা অন্যবিধ প্রতারণার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি যদি ১৬ বছরের অধিক বয়সী কোনো নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন, তাহলে সেই যৌনকর্ম ‘ধর্ষণ’ বলে বিবেচিত হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘অপরাধ’ প্রমাণিত হলে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
এটি একটি সমস্যাযুক্ত ধারা। কারণ, যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ থেকে আলাদা করা হয় কেবল ‘সম্মতি’ নামক শর্তটি দিয়ে। এ ক্ষেত্রে অপরাধটিকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বিয়ের সম্পর্ক বা প্রেমের সম্পর্ক আছে বা ছিল কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আগে ঘটিত কোনো ধর্ষণের অপরাধকে পরবর্তী সময়ে বিয়ের মাধ্যমে যেমন জায়েজ করা যায় না, ঠিক তেমনি প্রণয়ের সম্পর্কে সম্মতিসহ স্থাপিত যৌন সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে ধর্ষণ হয়ে যায় না। এটি খুবই সরল একটি বিষয়।
এটিকে বর্তমান অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করে পুরুষদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বলে মনে করি। কারণ, বিয়ের সম্পর্ক তালাকের মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার অধিকার থাকলেও প্রণয়ের সম্পর্ক শেষ করার অধিকার এখন আর কোনো পুরুষের থাকল না। কেননা, নারী সঙ্গী যেকোনো সময় মামলা করে বলতে পারেন, তিনি বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। অথচ অন্যদিকে আমাদের ১৮৬১ সালের দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫–এ ধর্ষণের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তা ‘ম্যারিটাল রেপ’ বা বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দেয় না। এটাই সবার আগে পরিবর্তন করা উচিত ছিল।
এবার বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ দেখা যাক। ৬৮ ডিএলআর ১৮৫ (২০১৬)–এর একটি মামলায় হাইকোর্ট বলেন, যদি একটি পূর্ণবয়স্ক মেয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে যৌনমিলনে সম্মতি দেন এবং এ ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত থাকেন, তবে এটিকে ধর্ষণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। আদালত অন্য একটি মামলায় বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি সচেতনভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে মিশেছিলেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি যদিও ভুক্তভোগী মেয়েটির অবাধ সম্মতি ও মেলামেশার সুযোগটি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা কোনো আইনি অপরাধের আওতায় পড়ে না (৬১ ডিএলআর ৫০৫)।
আরও পড়ুন‘ফাঁসি’ নয়, ইনসাফ চাই১৫ মার্চ ২০২৫এ ক্ষেত্রে একটি যুক্তি আসতে পারে, ২০০০ সালের আইনের ১৭ (১)–এর ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য অনধিক ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান ছিল। নতুন অধ্যাদেশে ধারা ১৭–এর নতুন উপধারা ৩ সংযোজনের মাধ্যমে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের কাছে সন্তোষজনকভাবে যদি প্রমাণিত হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ওই ট্রাইব্যুনাল মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারীকে কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদানপূর্বক অভিযুক্ত ব্যক্তি বরাবর ক্ষতিপূরণের আদেশ প্রদানের পাশাপাশি অনধিক দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার আদেশ প্রদান করতে পারবেন। প্রণয়ের সময়, যৌন সম্পর্ক স্থাপনকালে বিয়ের প্রলোভন দেখানো হয়নি, তা আদালতকে অভিযুক্ত ব্যক্তি কী করে ‘সন্তোষজনকভাবে’ প্রমাণ করবেন, সেটি বোধগম্য নয়। এ ছাড়া মিথ্যা মামলাকারীর ক্ষতিপূরণের পরিমাণও অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়নি। বরং আগে মিথ্যা অভিযোগকারীর শাস্তি অনধিক সাত বছর থাকলেও এখন তা কমিয়ে দুই বছর করা হয়েছে।
নতুন অধ্যাদেশে ধারা ২০–এ নতুন উপধারা ৯ সংযোজিত করে বলা হয়েছে, এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কেবল ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল উপযুক্ত মনে করলে মেডিকেল সার্টিফিকেট ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারবেন। এ ছাড়া নতুন ৩২(ক) ধারায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা না করার সিদ্ধান্ত, তদন্তকারী কর্মকর্তা কারণসহ লিখিতভাবে ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমত, এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে পারবেন। এ সংযোজন দুটিও অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেননা, ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল সাধারণত ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মাগুরার শিশুটির মুমূর্ষু মুহূর্তে আমরা দেখেছি, সরকারের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই তাকে দেখতে গিয়েছেন। ফলে গণমাধ্যমকর্মীসহ উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে। সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমরা যেন অনুভূতির রাজনৈতিকীকরণ করে না ফেলি। ‘পরিদর্শনের’ চেয়েও অনেক জরুরি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের মাত্রা সমাজে কমিয়ে আনা এবং পপুলিস্ট চিন্তা থেকে আইন বা আইনের ধারা সংযোজন না করে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়ের সঠিক বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা।২০২৫–এর অধ্যাদেশে বিভিন্ন ধারায় মৃত্যুদণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে, যদিও মৃত্যুদণ্ড এই আইনে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এমন কোনো গবেষণা করে কি এই তথ্য পাওয়া গেছে যে কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রণয়ন করার ফলে সেই অপরাধের মাত্রা কমে এসেছে? জানামতে এমন কোনো তথ্য কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি।
প্রয়োজন ছিল ধর্ষণের মতো একটি অপরাধের পেছনের রাজনৈতিক-অর্থনীতির নিয়ামকগুলো বিচার–বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর মাত্রা সমাজে কমিয়ে আনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বা সাজার মাত্রা বাড়িয়ে খুব কম সময়ের জন্য একটি নিম্নগামী প্রভাব দেখা গেলেও তা কখনোই স্থায়ী সমাধান আনবে না।
নতুন অধ্যাদেশের ধারা ১৪ (১) অনুযায়ী ভুক্তভোগীর নাম ও পরিচয় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রকাশের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ নিষেধ অমান্য করলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রত্যেককে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ধারার কোনো বাস্তবায়ন কি আমরা দেখতে পাই আদৌ? মাগুরার শিশুটির নাম মুখে মুখে থাকলেও ধর্ষকের নাম মনে রাখি না আমরা কেউ।
মাগুরার শিশুটির মুমূর্ষু মুহূর্তে আমরা দেখেছি, সরকারের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই তাকে দেখতে গিয়েছেন। ফলে গণমাধ্যমকর্মীসহ উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে। সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমরা যেন অনুভূতির রাজনৈতিকীকরণ করে না ফেলি। ‘পরিদর্শনের’ চেয়েও অনেক জরুরি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের মাত্রা সমাজে কমিয়ে আনা এবং পপুলিস্ট চিন্তা থেকে আইন বা আইনের ধারা সংযোজন না করে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়ের সঠিক বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত র জন ত ক অপর ধ র স য জন অনধ ক
এছাড়াও পড়ুন:
একঝলক (২৫ মার্চ ২০২৫)
ছবি: সাদ্দাম হোসেন