দুর্নীতিমুক্ত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনো গতি নেই: প্রধান উপদেষ্টা
Published: 25th, March 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে, আমরা জাতি হিসেবে সততার পরিচয় বহন করি না। এটা শুধু জাতীয় কলঙ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটা আত্মঘাতী বিষয়। দেশবাসীর মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় আমরা দুর্নীতিমুক্ত হই, কারণ তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চায়।”
তিনি বলেন, “দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই চলবে না। দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনও গতি নেই।”
মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।
আরো পড়ুন:
জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা: ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন
অর্থনৈতিক অবস্থা ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে: প্রধান উপদেষ্টা
ড.
তিনি বলেন, “নাগরিককে এই অদৃশ্য জগতের সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকার বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার সাধনা করতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকা এবং সাফল্য অর্জনের জন্য একটা নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে হয়। চারদিকে কী শব্দ বলা হচ্ছে, কাগজে কী লেখা হচ্ছে-তা মনে মনে দ্রুত অনুবাদ করে তার মর্মার্থ বুঝে নিতে হয়, তা নাহলে দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় মুশকিল হলো-এর কোনও অভিধান নেই। কারণ ব্যক্তি বিশেষে, স্থান বিশেষে, পরিস্থিতি বিশেষে এর অর্থ ক্রমাগতভাবে পাল্টে যায়।”
অন্তর্বর্তী সরকার সব কাজ দুর্নীতিমুক্ত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সরকারের মেয়াদকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার চেষ্টার পাশাপাশি আগামী দিনেও দেশের নাগরিককে যেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে পারি, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুর্নীতি ও হয়রানি রোধে আমরা একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকারের সঙ্গে দৈনন্দিন, মাসিক বা বার্ষিক রুটিন কাজের জন্য যেন কোনও নাগরিককে সশরীরে কোনও সরকারি অফিসে উপস্থিত হতে না হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সরকারি সব অফিসে ই-ফাইলিং চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু হলে দুর্নীতি কমে আসবে। এতে করে কোন অফিসের কোন ডেস্কে কোন ফাইল আটকে আছে, তা সহজেই জানা যাবে।”
সরকারি যতগুলো কার্যক্রমে অনলাইন সেবা চালু করা সম্ভব সবখানেই এ সেবা চালুর বিষয়ে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে অসহায় নাগরিকের টুঁটি চেপে ধরে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। টাকার লেনদেন ও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। সেটা থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। অনলাইনে সেবা পাওয়ার পদ্ধতিটি আরো কীভাবে সহজ করা যায়-এ ব্যাপারে আমাদের কাছে পরামর্শ জানিয়ে লিখুন, ই-মেইল করুন। আপনি বা আপনার পরিবারের যে কেউ এই সেবা বাণিজ্যিকভাবে দিতে চাইলে, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পৃথিবীর যেকোনও স্থান থেকে এই সেবা নিতে পারবেন।”
বিগত সরকারের আমলে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য মিথ্যা মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই বাছাই করে আমরা এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছি। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলোর মধ্যে সারা দেশে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ২৯৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্য সব হয়রানিমূলক মামলাও ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এছাড়া এ পর্যন্ত সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে বিচারাধীন স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত ৪১৩টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল করে নাগরিক বান্ধব সাইবার সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “মানুষের ভোগান্তি রোধেও আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। জিডি করার সময় স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য এখন আর থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা অনলাইনেই করা যাবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হয়রানি লাঘব করা হয়েছে। সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে নো ভিসা রিকয়ার্ড স্টিকার থাকলে, কিংবা জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেই-তিনি বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর বিমানের টিকিট কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে নিয়ে যাওয়ায় ফলে বিমানের টিকিটের দাম শতকরা ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ কমে গেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচের প্রবাসী ভাই-বোনেরা এতে করে স্বস্তি পাচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য এয়ারলাইনে টিকিটের দামও কমে গেছে। নাগরিকদের হয়রানিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানের জন্য সরকার ভূমি সেবা ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয় অনলাইনে ঘরে বসেই জমির খাজনা প্রদান, নামজারি, জমাখারিজ, খতিয়ান বা পরচা সার্টিফায়েড কপি ও মৌজা ম্যাপ বা নকশা প্রদানের কার্যক্রম চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে ভোগান্তি, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অবসান হবে। বর্তমানে সারা দেশে পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্যক্রম চালু হয়েছে। এগুলোকে ক্রমান্বয়ে আরো জনবান্ধব করে স্থায়ী রূপ দেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “এর লক্ষ্য হবে ক্রমাগতভাবে এসব দায়িত্ব সরকারের হাত থেকে নিয়ে সেবাদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেওয়া। গ্রামের স্কুল-কলেজ পাস করা ছেলে-মেয়েরা, গৃহিণীরা ঘরে বসে সারা দেশে এই সেবা দান করবে এবং অনেকে তাদের কৃতিত্বের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে পড়বে। তারা সারা দেশের গ্রাহকদের সেবা নিজের গ্রাম থেকেই প্রদান করবে।”
ঢাকা/হাসান/সাইফ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র হয়র ন ম সরক র র র জন য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তান জন্মের সময় ভেসে আসছিল নববর্ষের গান
মেহেরপুর শহরে সূর্যের হাসি ক্লিনিকে হাসি ফুটে উঠল গোলাম মর্তুজা ও নাসরিন আক্তার দম্পতির মুখে। তাদের কোলজুড়ে এলো কন্যাসন্তান। বাংলা নববর্ষে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো এই দম্পতির।
মর্তুজা ও নাসরিনের বাড়ি একই গ্রামে, মেহেরপুর সদর উপজেলার চকশ্যামনগরে। সেই কবেকার কথা। পরস্পরের সঙ্গে দেখা, কথা। এরপর ভালো লাগা, ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে এক যুগ আগে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়েতে রূপ দেন তারা। বিয়ের পর কেটে যায় পাঁচটি বছর। এ সময় তাদের একটি ছেলের জন্ম হয়। এরপর থেকেই তাদের প্রত্যাশা ছিল মেয়ের। অবশেষে এবার নববর্ষের প্রথম প্রহরে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
শিশুটির বাবা মর্তুজা বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ সবসময়ই আমার মধ্যে আলোড়ন তুলত। মনে মনে বাসনা ছিল যদি বৈশাখের প্রথম দিন আমাদের সন্তান জন্ম হয় তাহলে খুব ভালো হতো। তবে সব কিছু তো পরিকল্পনা করে হয় না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা কবুল করায় পহেলা বৈশাখে আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এতে আমাদের পরিবারের লোকজন সবাই খুব খুশি। আমরা দু’জনই কৃষক পরিবারের সন্তান। দু’জনই স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় সেই অর্থে লেখাপড়া হয়নি। তবে কৃষক পরিবারে পহেলা বৈশাখের যে আমেজ আনুষ্ঠানিকতা তা সবসময় আমার কাছে প্রিয়।’ সন্তান ও মায়ের জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন তিনি।
শিশুটির মা নাসরিন বলেন, ‘জন্মের পরপরই নার্সরা আমার বোনের কোলে তুলে দেয় আমার নাড়িছেঁড়া মামণিকে। মেয়ের বাবা ও খালা খুশিতে ভরে যায়। তোয়ালে জড়ানো মেয়েকে রাঙাতে দ্রুত বাজার থেকে একটি গোলাপি রংয়ের জামা কিনে এনে গায়ে পরিয়ে দেন মেয়ের বাবা। তখন আমার মেয়েকে দেখে পরীর মতো মনে হচ্ছিল। তখনও আমার শরীর অনেকটাই অবশ। হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে। পাশেই দেওয়া হলো আমার রাজকন্যাকে। শরীরে যন্ত্রণা থাকলেও মেয়েকে দেখে মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। যন্ত্রণাও যেন কমে গেল অনেকটাই।’
নাসরিন জানান, সন্তান গর্ভে থাকাকালে তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না। নিয়মিত চিকিৎসক দেখাতেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন যত এগিয়ে আসছিল ততই তাঁর স্বামী বলতে লাগলেন, তাদের সন্তান ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন যদি পহেলা বৈশাখে হয় তাহলে সেটি হবে একটি স্মরণীয় ঘটনা। অবশেষে নববর্ষের দিন সকালেই তাঁর ব্যথা ওঠে। তাদের গ্রাম থেকে হাসপাতাল ছয় কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় বাহন নসিমনে করে তাঁকে হাসাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক বলছিলেন মায়ের স্বাস্থ্য ভালো আছে। নরমাল ডেলিভারি হয় কিনা সেই চেষ্টা করা যাক। তবে প্রথম বাচ্চা সিজারিয়ান হওয়ায় ব্যথা ওঠার ছয় ঘণ্টা পর স্বাভাবিক ডেলিভারি না হওয়ায় আবার সিজার করে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই হাসপাতালের মাইকে আজান দেওয়া হয়েছে। তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি পরে জেনেছেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই বারান্দায় অপেক্ষারত সন্তানের বাবা, চাচা, খালারা পরস্পরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
নাসরিন বলেন, ‘আমি যেখানে সন্তান জন্ম দিয়েছি, সেখান থেকে অল্প দূরেই শহরের শহীদ সামসুজ্জোহা পার্ক। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ওই পার্কে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। সেই অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছিল নববর্ষের গান। মনে মনে ভাবছিলাম এমন স্মরণীয় দিনে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে খুব ভালো হবে। আমার রাজকন্যা পৃথিবীতে এলো। হাসপাতাল থেকে আমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা দিতে এলে মনে হচ্ছিল আমার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্নপূরণ হলো। আমাদের দু’জনেরই সিদ্ধান্ত মেয়েকে প্রথমে কোরআনের হাফেজ বানাব। এরপর সে স্কুলে পড়ালেখা করবে। মেয়েকে নিয়ে তেমন বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। তার ভাগ্যে যেটা আছে সেটাই হবে তার পেশা। তবে সে যেন মানুষর মতো মানুষ হয়, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। পহেলা বৈশাখ সন্তান জন্ম হওয়ায় আমি ও আমার স্বামী দু’জনই খুব খুশি।’
মেহেরপুর ম্যাটার্নিটি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও সার্জন রামানা হেলালী জুসি বলেন, ‘মর্তুজা-নাসরিন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান পহেলা বৈশাখ দুপুর আড়াইটার সময় সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এদিন পহেলা বৈশাখ হওয়ায় হাসপাতাল থেকে সন্তানের মাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। শিশুটির মা ম্যাটার্নিটি হাসপাতালে তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতেন। শিশুটির বাবা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা করাতেন। তিনি স্ত্রীর প্রতি খুবই যত্নশীল বলে তাঁর মনে হয়েছে। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো ছিল। কোনো সমস্যা ছিল না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শিশুটির ওজন ছিল তিন কেজি। তার রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। মা ও মেয়ে দু’জনই সুস্থ আছে।